“গণ্ডগোল তোপসে! বিস্তর গণ্ডগোল…!”
সিরিজ : সাবাশ ফেলুদাপরিচালক : অরিন্দম শীলঅভিনয় : পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, ঋত্বিক চক্রবর্তী, সৌরসেনী মিত্র প্রমুখমাধ্যম : জি ফাইভ
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বিভিন্ন কাহিনিভিত্তিক কবিতা লিখে ইংল্যান্ডের পাঠকসমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন লর্ড বায়রন। শোনা যায়, ব্রিটিশ যুবসমাজের কেউ কেউ নাকি বায়রনের এতোটাই অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েন যে নিজেরা যেহেতু কবিতা লিখতে পারতেন না, তাই বায়রনকে অনুসরণ করবার এক অদ্ভুত পন্থা আবিষ্কার করেন। বায়রনের এক পায়ে একটু অসুবিধে থাকার ফলে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন, এই যুবকেরা ‘বায়রনীয়’ হয়ে উঠবার আশায় তাঁর খুঁড়িয়ে হাঁটার ধরনটিকে নকল করে করে মোটামুটি ফ্যাশনের পর্যায়ে নিয়ে যান!
বর্তমান বাঙালি পরিচালকদের অবস্থা অনেকটা এইসব খুঁড়িয়ে চলা যুবকদের মতো। নিজেদের মনে সত্যজিৎ রায়ের মতো বিখ্যাত হবার আশা ষোল আনা, এদিকে সেই পড়াশোনা, সেই চিন্তার গভীরতা বা সামাজিক বীক্ষণের ধারেকাছে যাবারও সাধ্য নেই। অতএব এঁরা প্রয়োগ করেন একটি সহজ যুক্তি- সত্যজিৎ গোয়েন্দা ছবি তৈরি করেছিলেন, আমিও গোয়েন্দা ছবি বানাব, তার মানে আমিই সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের দাড়ি আছে, ছাগলেরও দাড়ি আছে, অতএব…।
এর সঙ্গে যোগ করুন বাঙালি ভদ্রলোকের ভয়ানক একচোখা গোয়েন্দাপ্রীতি। ঔপনিবেশিক সমাজের ফলশ্রুতি ভদ্রবিত্ত জীবনদর্শনের ফসিল আঁকড়ে পড়ে থাকা একটা ফাঁকা নস্টালজিয়া, যা দর্শককে শাসকের দুর্নীতি, বেকারত্ব, গ্রামীণ অচলাবস্থা, বুনিয়াদী শিক্ষাব্যবস্থার নাভিশ্বাস প্রভৃতি বর্তমান সমাজের জ্বলন্ত সমস্যাকে উপেক্ষা করে বারবার অমুক বাড়ির সোনার গোপাল বা তমুক পরিবারের খানদানি সম্পত্তি উদ্ধারের ছকবাঁধা গল্পে বুঁদ হয়ে থাকবার প্রলোভন জোগায়। মন্ত্রী সান্ত্রীদের ঘর থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে কোটি কোটি টাকার স্তূপ বেরোচ্ছে, এদিকে বাঙালি গোয়েন্দা ধোপদুরস্ত পোশাক পরে উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে সাতপুরুষের ছাতা পড়ে যাওয়া গুপ্তধন হাতড়াচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনে জেল খেটে এসেছে, এমন বাঙালি অভিনেতাও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দুনিয়ায় ভুরু কুঁচকে এঁদো রাজবাড়ির ছেঁদো সিন্দুকের পাশে কুড়িয়ে পাওয়া সঙ্কেতের অর্থ ভেবে চলেছে। এর সঙ্গে উপরি পাওনা পরীক্ষা নিরীক্ষা। নিজের মতো করে খেটেখুটে মৌলিক গল্প তৈরিতে অনেক চাপ, তার থেকে চেনা গোয়েন্দাকে নিয়ে এসে যত ইচ্ছে আগডুম বাগডুম মশলা ঢুকিয়ে দাও, প্রচারসর্বস্ব যুগের শর্টকাট রাস্তা তৈরি।
অরিন্দম শীলের ‘শাবাশ ফেলুদা’ এই লিস্টে নবতম সংযোজন। বর্তমান ইন্ডাস্ট্রিতে গোয়েন্দার রোল অনেকটা পাড়ার বাচ্চারা মিলে চোরপুলিশ খেলার মতো, ঘুরেফিরে সবার ভাগ্য খোলে। পরমব্রত তোপসে ছিলেন, বিমল হয়েছেন, ব্যোমকেশ হয়েছেন, এবার ফেলুদা হয়েছেন। আশা করা যায় আগামীতে গোঁফ লাগিয়ে কাকাবাবু বা পরচুলা পরে মিতিনমাসিও হবেন। ফেলুদার প্রথম প্রবেশ ঘটে যক্ষীর মাথা বগলে দৌড়তে দৌড়তে, প্রখর রুদ্রের স্টাইলে কয়েক গণ্ডা দুষ্টু লোককে ঠেঙিয়ে তিনি যেভাবে সিগারেটের প্যাকেটের মতো যক্ষীর মাথাখানা পুলিশ ইনস্পেক্টরের হাতে ছুঁড়ে দেন, দেখে যেকোনো স্থাপত্যশিল্পরসিকের হেঁচকি উঠে যেতে পারে। সত্যজিতের ফেলুদা ছিল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির প্রতিভূ, পড়াশোনা নিয়ে মনে হাল্কা গর্ব থাকলেও সদা বিনয়ী, এবং সাধারণ মানের জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী। কাশীর সাদামাঠা হোটেল বা কেদারনাথের পথে কালিকমলি ধাবায় সে দিব্যি স্বচ্ছন্দ। ২০১৭ সালের ফেলুদা অবশ্য নব্যভদ্রলোক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, তিনি দামি হোটেলে বিরাট ঘ্যাম নিয়ে ঘোরাফেরা করেন এবং ‘আগে চান্স পেয়ে দেখা’ সুলভ ঔদ্ধত্যে পুলিশ অফিসারকে ডায়লগ দেন। নিশিকান্ত সরকার চরিত্রটি জটায়ুর প্রাথমিক রূপ অবশ্যই, কিন্তু জোর করে হাসাতে গিয়ে রুদ্রনীলের চড়া দাগের অভিনয়ের চোটে তাঁকে স্নায়বিক বিকারগ্রস্ত মনে হতে থাকে। গল্পকে প্রগতিশীল করে তোলবার জন্য তোপসের বান্ধবী এসেছে, সিকিমের মহিলা পুলিশ অফিসার এসেছে, কিন্তু খানিক ঘাড় নাড়া আর কাঠ কাঠ মুখ করে হাতে বন্দুক নিয়ে দৌড়ে বেড়ানো ছাড়া তাদের বিশেষ কিছু করার নেই। হেলমুটের ভূমিকায় টোফার কলিন্সের অভিনয় অত্যন্ত দুর্বল, ঋত্বিক চক্রবর্তী শক্তিশালী অভিনেতা হলেও চিত্রনাট্যে সেভাবে সুযোগ পেলেন কই? উল্টে বৈদ্যর ছদ্মবেশে অতি খারাপ মানের একখানা সান্তাক্লজ মার্কা মেকআপ পরিয়ে ঘোরানো হল তাঁকে। আশি পাতার গল্পকে দশ এপিসোড ধরে টানতে গিয়ে মুম্বাই পুলিশ, মগনলাল মেঘরাজ, ‘সেক্রেড গেমস’ বইয়ের চরিত্রের নামে পুলিশ অফিসার প্রভৃতি একের পর এক অপ্রয়োজনীয় পরত যোগ করে কাহিনির গতি কাটোয়া লোকালের মতো ঝুলে গেছে, দেখতে গিয়ে হাই উঠতে থাকে। ডোকলামে ভারত-চীন মিলিটারি সমস্যার কথা উল্লেখ করা হলেও তা চিত্রনাট্যকে সমৃদ্ধ করল কোথায়? সত্যজিতের ফেলুদা সারা ভারত চষে বেড়ালেও তার ভাষায় হাবেভাবে ছিল স্বচ্ছন্দ এক বাঙালিয়ানা, এই ফেলুদা বাংলা থেকে হিন্দি বা ইংরেজিতে বেশি সাবলীল। অত্যাধুনিক হবার চক্করে স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলাটা খুব একটা কাজের কথা নয় বোধহয়।
অভিনয় সম্বন্ধে বেশি কিছু বলা বাহুল্য, সকলেই মোটামুটি খারাপ। সারা সিরিজ ধরে অদ্ভুতভাবে এক ধরনের বলিউডি হিন্দি ব্যবহার করা হল, অথচ খোদ মহারাষ্ট্রের লোক শেলভাঙ্কারের হিন্দিতে স্পষ্ট বাংলা টান। ২০১৭ সালের গল্পের দৃশ্যে আজাদি কা অমৃত মহোৎসবের বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। আবহ সঙ্গীতে কোন নতুনত্ব নেই, পোশাক পরিকল্পনা দায়সারা। বেশিরভাগ চরিত্রকেই তেমনভাবে পোশাক বদলাতে দেখা যায় না, অথচ এরা নাকি বেড়াতে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ফেলুদার গল্পে রহস্যের পাশাপাশি দুটো প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকে- ভ্রমণ এবং ভোজন। এই ফেলুদাকে বেড়ানোর জায়গা সম্বন্ধে সেভাবে মুখই খুলতে দেখা যায় না, এবং দক্ষিণ কলকাতার মল কালচারে অভ্যস্ত টিনএজারদের মতো সে খালি স্যান্ডউইচ গেলে। গোয়েন্দাকাহিনি নিয়ে পর্দায় সত্যি ভালো কিছু করতে চাইলে বাঙালি পরিচালকদের অবিলম্বে ‘শিকারপুর’ সিরিজের রাস্তায় হাঁটা উচিত, সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে মৌলিক গল্প না বুনে খালি ব্যোমকেশ আর ফেলুদার নাম সম্বল করে অন্ধগলিতে ঘুরপাক খেতে থাকলে কেউ জীবনেও বাংলা ছবির পাশে দাঁড়াবে না।
...............
#ফেলুদা #সত্যজিৎ রায় #feluda #Satyajit Ray #parmabrata chattopadhyay #silly পয়েন্ট