"আজিকে তো কুসুমের মাস" : স্মরণে কবি অজিত দত্ত
একটি ভুল শিরোনাম ললাটে নিয়ে এ লেখা শুরু হল। অজিত দত্তের কথা স্মরণে নেই আমাদের। নিষ্ঠুর বিস্মরণ উপহার পেয়েছেন তিনি।
জন্ম ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯০৭। সমসাময়িক অন্যান্য ‘বড়’ কবিদের তুলনায় পাঠকপ্রিয়তা বরাবর কমই পেয়েছেন অজিত দত্ত। ১৯৩০ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কুসুমের মাস’ প্রকাশিত হয়। বুদ্ধিজীবী মহলে সে বই বেশ মনোযোগ ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে অজিত দত্তের বিশেষ সখ্য ছিল। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকা ‘কবিতা’-র হয়ে ওঠার পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। বুদ্ধদেবের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে ‘প্রগতি’ পত্রিকা সম্পাদনাও করেন। পরে কল্লোল গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং কল্লোল পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অস্থায়ী পদে অজিতবাবু পেশাগত জীবন শুরু করেন। এরপর রিপন কলেজের অধ্যাপনা। মাঝখানে টি বোর্ড এবং ব্যাঙ্কে চাকরির পর আবার শিক্ষকতায় প্রত্যাবর্তন। ১৯৫৬ সালে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনায় যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে তাঁর আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পাতাল কন্যা (১৯৩৮), নষ্ট চাঁদ (১৯৪৫), পূর্ণনবা (১৯৪৬), ছায়ার আলপনা (১৮৫১), জানালা (১৯৫৯), সাদা মেঘ কালো পাহাড় (১৯৭১) ইত্যাদি। এছাড়া জনান্তিকে, মন পবনের নাও, সরস প্রবন্ধ ইত্যাদি বেশ কিছু প্রবন্ধ-সংকলনও রয়েছে তাঁর।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কুসুমের মাস’-এর কাব্যভাষার চলনকে বলেছিলেন ‘মদির মন্থরতা’। সাধুরীতিকে যে এত সুললিত করে তোলা যায়, দুরূহ শব্দনিক্ষেপও যে মায়াভারে এত নত হতে পারে, অজিত দত্ত না থাকলে আধুনিক বাংলা কবিতা কি তা জানতে পারত? অথচ ‘কুসুমের মাস’-এর পরের কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনি যে সেই সাধুরীতিকে বর্জন করতে থাকলেন, তার কারণ কি পাঠকের প্রত্যাখ্যান? তার কারণ কি এটা যে শেষপর্যন্ত বাংলা কবিতার দুনিয়া ‘ওয়ান বুক ওয়ান্ডার’ করেই রেখে দিল তাঁকে? তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাতালকন্যা’-তে চলিত ভাষায় বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া চলিতভাষাই তাঁর অবলম্বন হয়ে উঠল। অবশ্য বরাবর তিনি কমই লিখেছেন। এক-একটা কাব্যগ্রন্থের মধ্যে সময়ের ব্যবধান অনেকটাই। ভাষারীতির স্বাভাবিক বদল সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। কারণ পাঠক তাঁকে ‘পুরনোপন্থী’ ভাবেন এমন একটা বিশ্বাস, একটা অভিমানই হয়তো বা, তাঁর মনের মধ্যে ছিল। শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন - “…নতুন কোনো বই হাতে তুলে দেবার সময়ে বলতেনই একবার : ‘তোমাদের অবশ্য ভালো লাগবে না এসব। আমি তো আর আধুনিক নই।”
“ঠিকই, প্রাচীনতা মাখানো এর শব্দসাজ,” লেখেন শঙ্খবাবু। আর লেখেন এই ‘প্রাচীনতা’ বিষয়ে অজিত দত্তের অস্বস্তির কথা - “আমাদের ছাত্রজীবনে তাঁর ‘কুসুমের মাস’ যে অনেকেরই হাতে হাতে ঘুরত, পুরোনো ধাঁচের শব্দ আর সাধু ক্রিয়াপদ সত্ত্বেও যে সে-বই থেকে এ ওকে শুনিয়ে দিতাম কোনো কোনো লাইন, সেকথা জেনে খুব প্রবোধ পেতেন তা নয়, বলতেন, ‘সে তো কোন আদ্যিকালের কথা! এখন তো আর ওরকম লিখি না।”
নজরে থাকুক
“ভালোবাসা! তুমি এখন কেমন আছো!” : শতবর্ষে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
নিজের কবিতা সংগ্রহের ভূমিকায় কবি লিখেছিলেন, “অন্য যাঁদের আবাল্য বন্ধু ও সতীর্থ এবং সমধর্মা কবিরূপে জেনেছিলাম, তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বটুকু ছাড়া আর কোনো সমধর্মীতা আজ আর খুঁজে পাই না। সেজন্য নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ মনে হয়।” ‘পোয়েট অব থার্টিজ’-এর অনুসরণে ‘তিরিশের কবি’ বলতে বাংলা কাব্যসাহিত্যে যে প্রজন্মকে আমরা ধরি, প্রতিভার দিক থেকে অজিত দত্তের তাঁদের মধ্যে গণ্য না হবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। কিন্তু বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বিষ্ণু দে-অমিয় চক্রবর্তীর পর আর কোনও নাম আমরা উচ্চারণ করি না। এ কথা স্বীকার করতেই হয় যে, সময়ের সঙ্গে বন্ধুতা হয়নি অজিত দত্তের। কিন্তু তা কি শুধুই ভাষার কারণে? অন্তরে অন্তরেও একরকম নিঃসময়ের তপস্যা করতেন বোধহয় তিনি। তাই পরে ভাষাভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করেও একরকম ব্রাত্য থেকে গেছেন। সময়ের রুটম্যাপের সঙ্গে কিছুতেই পদক্ষেপ মেলেনি তাঁর। প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত তিনি আসলে অতি-নিভৃত অনুভবের কবি। ভিতরপানে তাঁর দৃষ্টিপাত এতই গভীর, ভেসে ওঠার চেষ্টা করেননি কখনও তিনি। বা পারেননি। সেই অতলকে চিনে নিতে চাইবার কথা ছিল না কি আমাদের কবিতা-প্রেমীদের? ক’টা পাঠক জুটেছে তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোর?
দিনকয়েক আগেই রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে তাঁর মেয়ে শর্বরী দত্তের। তাতে দেখছি অজিত দত্তের নামটা মিডিয়ায় ভেসে উঠেছে। শর্বরী দত্তকে বলা হচ্ছে ‘বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক অজিত দত্তের মেয়ে’। ‘বিখ্যাত’ শব্দটা বেশ মুখ ভ্যাংচাল। যে কবি আমাদের কিছু না দেওয়া ললাটে নিয়ে চলে গেছেন, দরকার কী তাঁকে এসব অন্তঃসারশূন্য শব্দে ভূষিত করার, যা আসলে গভীরতম অপমানের জায়গাতেই আচ্ছা করে নুন ঘষে দেয়?
ঋণ : ১) নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী/ অজিত দত্তের কবিতা ও ‘কুসুমের মাস’।
২) শঙ্খ ঘোষ/ বটপাকুড়ের ফেনা।
#অজিত দত্ত #কবি #সাহিত্যিক #Ajit Dutta #Bengali Poet #কুসুমের মাস #স্মরণ #Bengali Literature #Shankha Ghosh #Nirendranath Chakraborty #Sharbari Dutta #Birthday #জন্মদিন #ফিচার #Feature #আহ্নিক বসু