“I died for beauty” – সুন্দরের খোঁজে এক বিস্মৃত গণিতজ্ঞ
..................
“আই ডায়েড ফর বিউটি : ডরোথি রিঞ্চ অ্যান্ড দ্য কালচারস অফ সায়েন্স” – মার্জারি সেনেকল-এর লেখা এই বইটি মূলত সত্য ও সুন্দরের সাধিকা এক বিজ্ঞানীর আত্মজীবনী। স্বনামধন্য আমেরিকান কবি এমিলি ডিকিনসনের কবিতা থেকে নেওয়া এই পংক্তিটি এক বিতর্কিত গণিতজ্ঞের সম্পূর্ণ জীবনদর্শন। তিনি হলেন ডরোথি মাউড রিঞ্চ (১৮৯৪ – ১৯৭৬), কেমব্রিজে প্রশিক্ষিত একজন গণিতজ্ঞ ও বায়োকেমিক্যাল থিয়োরিস্ট। সুবিখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালের ডিসেম্বর ২০১২ সংখ্যায় ‘সিমেট্রি ওয়ার্স’ শিরোনামে এই বইটির উপর একটি প্রতিবেদন বেরোয়। বইটি পড়লে বারবার মনে হয় কোন তাড়নায় একজন সৃজনশীল আবিষ্কারক সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন তাঁর লক্ষ্যের অনুসন্ধানে? সাফল্য? অর্থ? নোবেল পুরস্কার পাওয়ার তাগিদ? না, বস্তুত একজন প্রকৃত আবিষ্কারক এসব কোনও কিছুর পেছনে ছুটবেন না। কেবল সত্য ও সৌন্দর্যের সেই অপ্রতিহত আহ্বান তাঁকে ছুটিয়ে বেড়াবে আজীবন অনুসন্ধানের পথে।
ডরোথির জন্ম আর্জেন্টিনায়। বাবা মা ইংরেজ। বাবা ছিলেন একটি ব্রিটিশ ফার্মে ইঞ্জিনিয়ার। ইংল্যান্ডের স্কুলে পড়াশুনা শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গারটন কলেজে গণিত বিভাগে ভর্তি হন। কেমব্রিজ থেকে বি.এ. এবং এম.এ. পাশ করে লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে পিওর ম্যাথামেটিক্সের লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর বন্ধু বৃত্তে ছিলেন স্বনামধন্য দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। ডরোথি সিমবোলিক লজিকের পাঠ নিয়েছিলেন রাসেলের কাছে। অ্যান্টিওয়ার কার্যকলাপের জন্যে রাসেল যখন কারাবন্দী ছিলেন সেসময় বিনা বেতনে রাসেলের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট এবং ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন ডরোথি। ১৯২৯ সালে প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অফ সায়েন্স (D.Sc.) উপাধি পেয়েছেন।
ডরোথির কেরিয়ার দুটি পর্বে বিভক্ত। ১৯১৮ থেকে ১৯৩২, যখন তিনি বিশুদ্ধ এবং ফলিত গণিতের কাজের উপর কুড়িটি গবেষণাপত্র বের করেছেন। সেই সঙ্গে সায়েন্টিফিক মেথডোলজি এবং ফিলোজফি অফ সায়েন্সের উপর ষোলোটি গবেষণাপত্র লেখেন। এছাড়া ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ স্যার হ্যারল্ড জেফরিজের সঙ্গে ‘সায়েন্টিফিক মেথডস’-এর উপর বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র লেখেন। ১৯৩২ সালে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে গড়ে তোলেন ‘থিয়োরিটিক্যাল ক্লাব’। যা ছিল বস্তুত একটি ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি গ্রুপ, যেখানে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলত মূলত বায়ো মলিক্যুলদের গঠন এবং ক্রিয়াকলাপ সংক্রান্ত বিষয়ে। জে ডি বার্নেল, ডরোথি হজকিন, জোসেফ নিডহ্যাম প্রমুখ স্বনামধন্য গবেষকরা ছিলেন। বলতে গেলে সে সময় থেকেই রিঞ্চ একজন ‘থিয়োরিটিক্যাল বায়োলজিস্ট’।
ডরোথি রিঞ্চের গবেষণার জটিল বিজ্ঞান আর গণিতের মধ্যে না গিয়েও এককথায় যদি তাঁর কাজ সম্পর্কে বলতে হয়, তা হল – মূলত গাণিতিক নিয়মনীতির সাহায্যে প্রোটিন অণুর গঠন নিরূপণ করা। যে সময়ের কথা, তখনও কম্পিউটারের যুগ আসেনি। ছিল না প্রাণ-রাসায়নিক অণুদের গঠন জানার জন্যে বর্তমান যুগের মতন প্রয়োজনীয় NMR Spectroscopy, Cryo Electron Microscopy ইত্যাদি আধুনিক সংবেদী যন্ত্রপাতী। শুধু ছিল শৈশব-অতিক্রান্ত এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি পদ্ধতি। বস্তুত তখন স্ট্রাকচারাল বায়োলজির জন্মই হয়নি।
অণুর গঠন জানার দরকার হয় কেন? আসলে অণুর গঠন কাঠামোর মাধ্যমেই আমরা অণুর ধর্ম, কাজকর্ম ও বিক্রিয়ার স্বরূপ বুঝতে পারি। তাছাড়া অণুর গঠন জানা থাকলে তবেই প্রচুর পরিমাণে তা তৈরি করা সম্ভব। প্রোটিন একটি জৈবযৌগ। বিশাল বড়ো অণু। তাই এদের গঠন কাঠামোও হয় অত্যন্ত জটিল। শুধুমাত্র এক্স-রে বিচ্ছুরণের তথ্যের উপর নির্ভর করে প্রোটিনের মতন বৃহৎ অণুদের ত্রিমাত্রিক গঠন জানা সম্ভব নয়। এর পাশাপাশি চাই অনুসন্ধানী বিজ্ঞানীর তীক্ষ্ণ মেধা, মনন ও কল্পনাশক্তি। আমরা কমবেশি জানি যে অ্যামাইনো-আসিডের এক একটি অণু পেপটাইড বন্ডের মাধ্যমে পর পর সংযুক্ত হয় এবং এইরকম বহু পেপটাইড মিলে পলিপেপটাইড-শৃঙ্খল তৈরি করে। তারপর সেই পলিপেপটাইড অতি দ্রুত যথাযথ ভাঁজে কুণ্ডলি পাকিয়ে ত্রিমাত্রিক প্রোটিনের অণু তৈরি করে। এই কুণ্ডলি পাকানো গঠনের মধ্যে থাকে বিভিন্ন ফাঁস, ভাঁজ এবং বক্রতা। একমাত্র পরিপূর্ণ ত্রিমাত্রিক গঠন তৈরি হওয়ার পরেই প্রোটিন অণুরা নিজের নিজের কাজ করতে পারে।
আরও পড়ুন : হিরের দুল ছেড়ে চেয়েছিলেন বই - শতবর্ষে বিস্মৃত বিজ্ঞানী আন্না মনি / সিদ্ধার্থ মজুমদার
প্রোটিন অণুর গঠন কাঠামোর প্রথম প্রস্তাবিত মডেলের নাম ‘CYCOL মডেল’, আবিষ্কর্তা ডরোথি রিঞ্চ। এই ‘CYCOL’ মডেলটি ছিল ম্যাথামেটিকেল সিমেট্রি কনসেপ্ট এবং দুটি অ্যামাইনো অ্যাসিডের সংযোগকারী কোভ্যালেন্ট বন্ডিং-এর ধারণার ওপর ভিত্তি করে পলিপেপটাইড শৃঙ্খলের মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলির ক্রম এবং সংযোগ জানা। ডরোথি যখন প্রথম প্রোটিন গঠনের গাণিতিক মডেল প্রস্তাবনা করেন তখন বিজ্ঞানী মহলে শোরগোল পড়ে যায়। কয়েকজন নামজাদা বিজ্ঞানী ডরোথির ‘CYCOL মডেলকে সুস্পষ্ট ভাবে সমর্থন জানান। পাশাপাশি এই মডেলের ভ্রান্তি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক তৈরি হয়। রিঞ্চের প্রোটিন মডেলের সমর্থন করলেন নোবেলজয়ী রসায়নবিদ এরভিং ল্যাংম্যুর। এই দলে যোগ দিলেন আরেক নোবেলজয়ী রসায়নবিদ নীলস বোর। একই সঙ্গে নামজাদা পদার্থবিদ জে ডি বার্নেল তীব্র আপত্তি জানালেন এই মডেলের। তবে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ লিনাস পাউলিং। আমরা জানি এই পাউলিং-ই পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পাবেন। “রিঞ্চের কেমিস্ট্রিতে জ্ঞান না থাকার জন্যেই এই মডেলের দুর্বলতা” – এমনই বক্রোক্তি এসেছিল পাউলিং এর থেকে। নিজের প্রস্তাবিত প্রোটিনের মডেলের বাস্তবতা যুক্তি দিয়ে বিজ্ঞান মহলে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন ডরোথি। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক ও বাকবিতণ্ডাও কম হয়নি। পরবর্তীকালে তাই ‘সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত গণিতজ্ঞ’ তকমা জুটে গেছিল সহজেই। ডরোথি এত প্রবল বাধা ও বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছিলেন যে তিনি একসময় রীতিমতন হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন।
ডরোথির CYCOL থিয়োরি প্রোটিনের ক্ষেত্রে ভুল পরিগণিত হলেও পরবর্তী সময়ে জানা গেল যে এই জাতীয় রাসায়নিক বন্ধনী কয়েক ধরনের অ্যালক্যালয়েডের ক্ষেত্রে রয়েছে। হতাশ ও বিরক্ত ডরোথি একসময় বলেন - “প্রথমে তাঁরা বলেছিলেন প্রোটিনের যে CYCLOL গঠন যা আমি দেখিয়েছি ওর কোনো অস্তিত্বই থাকতে পারেনা। পরে যখন প্রকৃতিতে সেই অস্তিত্ব সন্ধান মিলল, তাঁরা বললেন ‘এটা ল্যাবরেটরিতে বানানো সম্ভব নয় কখনও’। তারপর যখন এটি ল্যাবরেটরিতে বানানো সম্ভব হল একসময়, তখন তাঁরা বললেন, ‘আসলে কোনোভাবেই ওর কোনও গুরুত্ব নেই’।”
আরও পড়ুন : গোটা একটা নক্ষত্র সম্প্রদায় আবিষ্কার করেও নোবেল-উপেক্ষিতা জোসেলিন বার্নেল / অর্পণ পাল
গণিত, দর্শন, সোশিয়োলজি, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, বায়োলজি প্রোবাবিলিটি, জেনিটিক্স ও প্রোটিন-কেমিস্ট্রি – এতগুলি বিভাগে ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ। জ্ঞান অর্জন এবং কাজের ক্ষেত্রে কোনো সীমারেখা ছিল না তাঁর। অনায়াস দক্ষতায় বিভিন্ন বিভাগে উচ্চমানের গবেষণা করে গেছেন। জীবনের অনেকখানি সময় তিনি প্রোটিন অণুর গঠন জানার খোঁজে অতিবাহিত করেছেন। বস্তুত ডরোথি ছিলেন একজন রেনেসাঁ স্কলার যার জ্ঞানের গভীরতা, দূরদৃষ্টি, নেতৃত্ব-দেওয়ার দক্ষতা এবং কর্মক্ষমতা ছিল ঈর্ষণীয়। লন্ডন রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপের জন্যে এবং নোবেল পুরস্কারের জন্যেও তাঁর নাম মনোনীত করে পাঠানো হয়। যদিও দুটি সম্মান তিনি পাননি। জীবন সম্মানজনক হওয়ার বদলে, বারবার অপমানে জর্জরিত হতে হয় তাঁকে। দুর্ভাগ্যের হলেও এটাই সত্যি যে তাঁকে মানুষ মূলত মনে রেখেছে বিশ্ববন্দিত রসায়নবিদ লিনাস পাউলিং এর সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব এবং তর্কযুদ্ধর জন্যে।
বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে একাধিক বিজ্ঞানীর নিরলস গবেষণার ফলশ্রুতিতে একটি আবিষ্কার হয়। এভাবেই বিজ্ঞান এগিয়েছে। এই অভিযাত্রায় কোনো বিজ্ঞানীর কোনো কাজ পরবর্তী সময়ে ভুল পরিগণিত হয়। আবিষ্কারক হিসেবে যিনি প্রথম সত্যের সন্ধান পেলেন তাঁকেই সবাই মনে রাখে। যে গবেষকদের নিবিড় গবেষণা যা সত্যের কাছে পৌঁছোতে সক্ষম হল না, তাঁদের পুরো প্রচেষ্টা মূল্যহীন হয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের ভাবনা, মেধা নিরলস প্রচেষ্টা, সৃজনশীলতা এসবের কী কোনও মূল্য নেই? আরেক ডরোথি, ডরোথি হজকিনের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। পেনিসিলিন, ভিটামিন বি-১২, ইনসুলিন ইত্যাদি জটিল অণুর কাঠামো-রহস্য ভেদ করে ১৯৬৪ সালে পেয়েছেন রসায়নে নোবেল পুরস্কার। হজকিন ছিলেন তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফার। রিঞ্চের মৃত্যুর পরে শোকবার্তায় হজকিন যা লিখেছিলেন সেখান থেকে একটি লাইন তুলে ধরে এই লেখাটি শেষ করতে চাই - “She was a brilliant and controversial figure who played a part in the beginnings of much of present research in molecular biology.”
...............................
[সিরিজ পোস্টার : অর্পণ দাস]
#সিলি পয়েন্ট #web portal #silly পয়েন্ট #বিজ্ঞান #প্রযুক্তি #Science #Dorothy Maud Wrinch # mathematician #biochemical theorist #'cyclol' hypothesis #সিদ্ধার্থ মজুমদার #বিজ্ঞান BY নারী #series