মুক্তগদ্য

বাইশে...

জয়িতা দত্ত Aug 7, 2020 at 11:39 am মুক্তগদ্য

কেতাদুরস্ত সভাঘর। ধুলোহীন কার্পেট। নীলাভ আলো। নরম কুর্সি। মার্জিত দর্শক। শ্রাবণের বাইশ। বাৎসরিক পরম্পরায় আনত কবি-স্মরণ।

সাজানো মঞ্চ। রেডি স্ক্রিপ্ট। সোনালি চশমা। গরদের পাঞ্জাবী। বাংলাদেশি ঢাকাই। জুঁই জড়ানো খোঁপা। অনুষ্ঠান শুরু হলো এখন।

এস্রাজের ছড়ে মল্লার-বেহাগ। মন্দিরা-তানপুরায় ঘন হয়ে আসা বিষাদ। গমগমে সাউন্ড সিস্টেমে নির্বাচিত রবীন্দ্রনাথ। গানে-কবিতায়-চিঠিতে-আলাপে কবির অন্তরঙ্গ বিলয়ের বোধ। দিনক্ষণ-মাথায় রেখে মৃত্যু-চেতনার আবহ- অনুষঙ্গ। অশ্রুনদীর কূলে কূলে হেঁটে অগম ঘাটে পৌঁছে যাবার গান। ‘যদি জল আসে আঁখিপাতে... তবু মনে রেখো’-র গহন আর্তি। ‘...শুকনো পাতা ঝরার বেলায় মনে রেখো’-র অনুরোধ। মেঘের পরে জমতে থাকা মেঘ। কবিতার চোখে জল। রোগশয্যায় পীড়িত কবির নিঃসঙ্গতা। সহায়হীন আক্ষেপ। অভিমান। আবার তারই সঙ্গে ‘চৈতন্যময় অন্তর্যামী’-র আলিঙ্গন। অতীন্দ্রিয় বোধের জগতে দুজনের একান্ত সম্মিলন।

‘মিলন হবে তোমার সাথে/ একটি শুভ দৃষ্টিপাতে/জীবনবঁধু হবে তোমার নিত্য অনুগতা’। পিনড্রপ সাইলেন্ট সভাকক্ষ। ভাষ্যপাঠের মন্দ্র আবেগে টিকিটের দাম উঠে আসার আন্তরিক স্বস্তি।

-আহা... কী চমৎকার স্ক্রিপ্ট। ... অপূর্ব গ্রন্থনা।
“দিগন্তরেখা জুড়ে মেঘ। বাতাসে কান্না। আড়ালে চলে গেলেন সূর্য। কিছু না বলেই। কোনো চলে যাওয়াই তো আসলে বলে যাওয়া নয়। তাই বৈশাখের তপ্ত দহন আশ্রয় খুঁজল অঝোর শ্রাবণে। বাইশে শ্রাবণ জুড়ে গেল পঁচিশে বৈশাখে। দেখতে না পাওয়া ছায়ার মত জন্ম-মৃত্যু বাঁধা পড়ে গেল আশ্চর্য সংকেতে।”
-আপনার লেখা না ?
.... অভিজাত ভাষ্যকারের সুস্মিত মস্তক হেলনে সম্মতি। পাশে দাঁড়ানো কন্ঠশিল্পী। চোরা চাউনিতে মেধা-স্বীকৃতির অপেক্ষা।
-আপনার গানও অসাধারণ।...আর আপনারও। প্র্যাক্‌টিক্যালি আপনাদের আজকের অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো কথা হবে না।

কথায় কথায় শ্রোতার সঙ্গে মিশে গেলেন শিল্পী। প্রশস্তি-ধন্যবাদের জমাটি আড্ডায় ওঁরা একই আলোকবৃত্তে ঘনিষ্ঠ। কোলাহলে উষ্ণ হয়ে উঠেছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত সভাঘর। অদূরের ফাঁকা মঞ্চে স্তব্ধ রবীন্দ্রনাথ। আভূমি প্রতিকৃতি-তে বাজারের সবচেয়ে দামি রজনীর মালা। মখমলি গোলাপে আরো জমকালো। কেবল ওই দুটি আয়ত নয়ন একটু ক্লান্ত। বেদনাহীন কিন্তু নিঃসঙ্গ। সমাহিত আর অন্তর্ভেদী।

আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে গেছে ভিড়। নিভে গেছে আলো। একলা ফিরতি পথে ছায়া দীর্ঘতর। ‘পাবলিক ভেঙে প্রাইভেট’ হবার নিবিড় মুহূর্তগুলো কানে কানে বলছে, ঐ সমবায় ছিল বলেই নিঃসঙ্গতা এমন মধুর। নির্জন সময় টেনে নিয়ে চলে জলের ধারে। মাথার ওপরে সাপের ফণায় দুলছে শ্রাবণ সন্ধ্যা। জলভারানত আকাশ মিশে যাচ্ছে অন্ধকার জাহ্নবীতে।

জলের ওপরে ওই দূরে দূরে টিপ্‌ টিপ্‌ আলো ঘোষণা করছে জলযানবাহী জীবনের। আর এধারে থেমে গেছে রাত। হেলে পড়া বটের ফাটল ধরা লাল চাতালে জমা হয়েছে জীবন-মৃত্যুর শেষ সাক্ষাৎ চিহ্ন। যেন ‘দুই আলো মিশিছে জীবনপ্রান্তে মম.../রজনীর চন্দ্র আর প্রত্যুষের শুকতারা সম’। ছেঁড়া কলাপাতায় সদ্য-মৃতের উদ্দেশে নিবেদিত ভক্ষ্যের অবশেষ। শাঁখার ভাঙা টুকরোয় লেপ্টে থাকা সোহাগ। ভেসে যাওয়া ভাণ্ডে পরম প্রিয় অস্থিচূর্ণের শেষ অঙ্গরাগ। অন্ধকার চরাচর জুড়ে সমাদৃত মর্তজীবনের রহস্যময় অবসান ধ্বনি।

এই সেই আশ্চর্য মুহূর্ত। যখন কবিতা ভেঙে দেবে ব্যক্তিমুখ। বাইশে শ্রাবণ তলিয়ে যাবে আরো কত ভাদ্র-আশ্বিন, পৌষ-মাঘ, চৈত্র-বৈশাখের ফালা ফালা মৃত্যু যামিনীতে। ক্রমে মিলিয়ে যাবে সীমা। ‘অনন্তে মুহূর্তে কিছু ভেদ নাহি আর/ ব্যক্তিহারা শূণ্য সিন্ধু শুধু যেন এক বিন্দু/ গাঢ়তর অনন্ত কালিমা।’ এখন শুধুই কালো। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’-র কালো। কাছের মানুষটির চিরঘুমে হারিয়ে যাবার কালো। চেতনার স্থায়ি অনুপস্থিতির গা ঘেঁষে ‘আর্টিফিসিয়াল লাইফ সাপোর্ট’-এর হঠাৎ ব্ল্যাক আউট হয়ে যাবার কালো। শিরদাঁড়া বেয়ে অতর্কিত বিচ্ছেদের হিমস্রোত। একটা অজানা শূন্যতার কুহক। সহসা পৃথিবী ছেড়ে হারিয়ে গেল একটা প্রিয় ডাকনাম। মূল্যহীন হয়ে গেল একখানা জীর্ণ ছাতা। চশমা। কিছু বই। ডায়েরি। ফাইল। বাজারের থলি। গ্রহ দৌরাত্ম্য ঠেকানোর আংটি-র মত কত অজস্র অসম্পূর্ণ পান্ডুলিপি। পায়ের নীচ থেকে সরে গেল ধরিত্রী। আকাশ থেকে উধাও হল আলো। বাতাসে হুতাশনের গর্জন। সাজানো আগুনের বিছানায় ছাই হয়ে গেল একটি শব শরীর।

ঠিক এমন সময়ে বেঁচে থাকা একলা ব্যক্তিটির নিঃসীম পরাজয়ের এই যে মুহূর্ত-সব দিক থেকে হেরে-মরে যাওয়া-মৃত মানুষের চেয়েও শতগুণ দহনে পুড়ে যাওয়া দেহমন, পবিত্র-গঙ্গার অথৈ আলিঙ্গনেও যে জ্বালা মেটবার নয়-তেমনই গভীর আত্মিক যন্ত্রণার মুহূর্তে সঙ্গে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। বলেন, “মৃত্যু তোমার যা হরণ করেচে তার চেয়ে বড় করে পূরণ করুক। নিজেকে তুমি দীন বলে অপমানিত কোরো না। বেদনার মধ্যে তোমার জীবন সার্থক হোক।” (চিঠিপত্র ১১)

বলেন, “ঈশ্বর যখন রুদ্রবেশে দয়া করেন তখন তিনি অসহ্য বেদনা দেন কিন্তু সেই বেদনাকে সার্থক করেন।” (চিঠিপত্র ৭)

শিখিয়ে দেন নিবিড় বেদনাকে সহন আর বহনের ক্লান্তিহীন প্রস্তুতির পাঠ। ‘আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে/ তখন আপনি এসে দ্বার খুলে দাও ডাকো তারে।’

তাই এখন ‘ ন হন্যতে হন্যমান শরীরে’-র আপ্ত নির্দেশে জোর করে ভাসতে হবে না। ‘Eternity is the true home of the soul’ বলে অবুঝ মনকে ‘death ends nothing’- এর অভিমুখে ঘুচিয়ে দিতেও হবে না। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে সে অমনিই বুক বাঁধবে। অর্জিত ব্যথা আর অনুপুঙ্খ স্মৃতিরা তার নিয়ত সহচর হয়ে মৃত্যুর শূন্যতায় মগ্নজীবনের সাঁঝবাতি জ্বেলে দেবে।

আর সেই দীপ জ্বলা সন্ধ্যায় বহমান জীবনের কাছে তিনি পৌঁছে দেবেন তাঁর ‘আমি’-র শেষমূল্য –

“পৃথিবীতে দিনের পর দিন সূর্য উঠবে সূর্য অস্ত যাবে, অসংখ্য যারা জাগবে আর যারা সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালাবে তাদের মধ্যে এই একটিমাত্র আমি কোথাও থাকবো না। সেই অন্তহীন জীবনপ্রবাহের মধ্যে আমার দিনের কয়েকটা কথা হয়তো কিছুকালের জন্য ফেনার মতো ভেসে চলবে।” ( চিঠিপত্র ১১)

#জয়িতা দত্ত

  • সুকন্যা রায়
    Aug 10, 2020 at 4:50 pm

    চোখে জল... ম্যাম, প্রণাম নেবেন।

  • Soumitra choudhurir
    Aug 8, 2020 at 9:58 am

    Mesmerizing. One will stop and go inside deep.

  • Isita Goswami
    Aug 8, 2020 at 9:17 am

    Ei lekha comment karar lekha nay, choop chup bose anubhab karar lekha.

  • IsIta Goswami
    Aug 8, 2020 at 9:03 am

    E lekha thik comment karar lekha nay. Anubhab karar lekha.

  • Dilip Ranjan Bhaumik
    Aug 8, 2020 at 4:47 am

    খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটা। ভাষার বিন্যাস খুব ভালো সবচেয়ে ভালো লাগলো কোন রিপিটেশন নেই খুব ভাল লিখেছ জয়িতা ধন্যবাদ

  • Durga Ghoshal
    Aug 8, 2020 at 1:05 am

    The charm of the writing is in the language that successfully carries emotion.Specially the beginning is excellent.The pithy sentences consisiting only of two words beautifully exress mounting emtion. God bless the writer.Hope the best is yet to come.

  • Suvasis Guha
    Aug 7, 2020 at 2:59 pm

    Splendid!

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

12

Unique Visitors

225508