জোঁক । ই.এফ.বেনসন
মূল কাহিনি: নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স লেখক: ই.এফ.বেনসন
একদিন সকালে আমি সমুদ্রের তীরে বালির ওপর শুয়েছিলাম। তখনই দেখলাম, একজন স্থূলদেহী মাঝবয়সী মানুষ— মদ আর অসংযত জীবনযাপন শরীরের মতো যার মুখটাকেও একেবারে থলথলে করে দিয়েছে— টলতে-টলতে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে চোখগুলো ছোটো করে আমাকে দেখল লোকটা। তারপর বলে উঠল, “আরে! তুমি তো ভিকারের সেই ভাইপো না বোনপো— কী যেন একটা, তাই না? বাগানের ঘরটায় থাকতে তুমি। আমাকে চিনতে পারছ না?”
গলা থেকে কিছুটা চিনলাম। তারচেয়েও বেশি চিনলাম, যেহেতু আগের সেই ছিপছিপে বলিষ্ঠ চেহারার একটা ফসিল ওই থলথলে আর বিকৃত চেহারার মধ্যে কিছুটা হলেও ছিল।
“চিনতে পেরেছি।” আমি বললাম, “আপনি আমার জন্য ভারি সুন্দর কয়েকটা ছবি এঁকে দিয়েছিলেন সেইসময়।”
“তা দিয়েছিলাম।” আমি চিনতে পারায় মানুষটি যে খুশি হয়েছেন সেটা বোঝা গেল, “আবার দেব। কিন্তু তুমি এখানে কী করছিলে? সমুদ্রে স্নান করতে গেছিলে নাকি? ঝুঁকির ব্যাপার। জলের নিচে ঠিক কী-কী আছে— কে জানে! ডাঙার ক্ষেত্রেও অবশ্য একই কথা প্রযোজ্য। তবে আমি ওসব কথায় বিশ্বাস করি না। কাজ আর হুইস্কি— এই নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। এই কটা বছরে আমি আঁকতে শিখেছি। মদটাও ইদানিং একটু বেশিই খাই। আসলে ওই বাড়িটায় থাকলেই কেন যেন সবসময় খুব তেষ্টা পায়!”
চুপ করে রইলাম। ইভান্স বলে চললেন, “তুমি মিসেস বোলিথোর সঙ্গেই থাকছ কি? ওঁর একটা পোর্ট্রেইট আঁকতে পারলে বেশ হত। সৌন্দর্য আর অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরও একটা জিনিস ধরা পড়ত ওঁর মধ্যে। উনি অনেক কিছু জানেন। পোলার্নের অনেকেই অনেক কিছু জানে। তবে আমার ওসব না জানলেও চলবে!”
ঠিক কেন আমি একইসঙ্গে ভদ্রলোকের প্রতি আকর্ষণ আর বিকর্ষণ অনুভব করছিলাম? বিকর্ষণের ব্যাপারটা বোঝা সহজ। কিন্তু আকর্ষণ?
আসলে ওঁর চেহারা, আর তার চেয়েও বেশি করে ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে আমার মনে হয়েছিল, জীবনের একটা অন্যরকম চেহারা দেখেছেন ইভান্স। সেটা ওঁর ছবির ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে— সেটাই দেখার জন্য একটা প্রবল কৌতূহল মাথাচাড়া দিচ্ছিল আমার ভেতরে। সেজন্যই বললাম, “আপনি কি বাড়ি ফিরছিলেন? আমিও তাহলে আপনার সঙ্গেই ফিরতাম।”
ইভান্সের সঙ্গেই বাড়িটায় গেলাম। বেড়ার ওপার থেকে দেখা অযত্নলালিত বাগানটা দেখলাম এত বছরে একেবারে জঙ্গলই হয়ে গেছে। একটা মোটাসোটা বেড়াল জানালায় বসে রোদ পোহাচ্ছিল। বাগান, শ্যাওলা-ধরা পাথরের বেঞ্চ, বাঁকানো পাঁচিল— সব পেরিয়ে আমরা বাড়িতে ঢুকলাম।
ভেতরের ঠান্ডা ঘরটার একপাশে এক বৃদ্ধা মহিলা খাবার-দাবার গুছিয়ে রাখছিলেন। পাথরের দেওয়ালের গায়ে আর নানা জায়গায়, এমনকি ছাদেও নানা ধরনের মুখ আর কিংবদন্তির জীবজন্তুর দেহাবশেষ দেখতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারলাম, পুরোনো চার্চের ধ্বংসস্তূপের অনেক কিছু দিয়েই এই বাড়িটা বানানো হয়েছে। একটা ডিম্বাকৃতি টেবিলের সামনের দিকে একটা পাথরের আংটায় চিত্রকরের ক্যানভাস আর তুলি রাখার ব্যবস্থা করা ছিল। সেটারও ওপরে একটি দেবদূতের মূর্তি বসানো ছিল।
“বেশ ভক্তিমূলক পরিবেশ— কী বল!” সেদিকে বুড়ো আঙুল নাচিয়ে ইভান্স বললেন, “এদিকে আমি আঁকি একেবারেই সাদামাটা জিনিস বা মানুষের ছবি। তাই সেই ছবিতেই এমন একটা ভাব আনতে হয়, যাতে ওই ‘ভক্তিভাব’-টা ফুটে না ওঠে। যাইহোক, আমি একটু ঘরোয়া জামাকাপড় পরে আসি। তুমি ততক্ষণ ছবিগুলো দেখতে থাক।”
ছবিগুলো দেখতে-দেখতে দুটো জিনিস মেনে নিলাম।
প্রথমত, জন ইভান্স সত্যিই শিল্পী হিসেবে অনেক-অনেক উঁচুদরের একজন হয়ে গেছেন।
দ্বিতীয়ত, তাঁর ছবিতে বিষ ঢুকেছে। এটা ছাড়া আর কোনোভাবেই প্রত্যেকটা ছবির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা পাপ আর অশুভের অনুভূতিটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। জানালায় বসা বেড়ালের একটা ছবি ছিল, কিন্তু ওই বেড়াল সাক্ষাৎ নরকের বাসিন্দা। রোদে গরম বালিতে শুয়ে থাকা এক নগ্ন কিশোরের ছবি আঁকা হয়েছিল— কিন্তু ঐ কিশোরের জন্ম দিয়েছে সমুদ্রের নিচের অন্ধকার। সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ইভান্সের আঁকা বাগানের ছবিগুলো— যাদের দেখে মনে হচ্ছিল, প্রতিটি ঝোপ, প্রতিটি পাতার পেছনেই ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছে মূর্তিমান বিপদ!
“কেমন লাগছে?” ইভান্সের হাতের গ্লাসে পানীয়ের রঙ দেখে মনে হচ্ছিল, তাতে জল-টল মেশানো হয়নি। তাতে এক চুমুক দিয়ে ইভান্স বললেন, “আমি যা দেখি তার সারটুকু ধরতে চেষ্টা করি। শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা বেড়াল আর একটা ঝোপের মধ্যে খুব একটা তফাত থাকে না। বরং আকার-অবয়বহীন যে অন্ধকার আর আগুন থেকে আমাদের সবার জন্ম— আমি সেটাকেই ফুটিয়ে তুলি। সুযোগ পেলে তোমারও একটা ছবি আঁকব। দেখবে, আমার আয়নায় নিজেকে দেখতে কেমন লাগে!”
গ্রীষ্ম কেটে গেল। ইভান্সের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই দেখা হত। তবে এমনও হত যে গোটা সপ্তাহ ধরেই মানুষটি নিজের বাড়ি আর আঁকা ছেড়ে বেরোতেন না। কখনও-সখনও জেটির ধারে মানুষটিকে বসে থাকতে দেখতাম— একা। তখন ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেই যুগপৎ আকর্ষণ-বিকর্ষণ অনুভব করতাম। মনে হত, ইভান্স একটা অন্ধকার পথ ধরে হেঁটে চলছেন যার শেষে তিনি এমন কিছু জানতে পারবেন, যা কেউ জানে না।
বাস্তবে শেষটা অন্যরকম হল।
অক্টোবরের শেষ দিন ছিল ওটা। পাহাড়ের ওপর ইভান্সের পাশে বসে সামনে দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি। রোদের অন্তিম আলোয় ঝলমল করছিল সমুদ্র। কিন্তু পশ্চিম আকাশে একটা ঘন কালো মেঘ কোথা থেকে জানি উদয় হয়ে সেই আলোটুকু শুষে নিচ্ছিল হু-হু করে। তাতেই ইভান্সের চটকা ভাঙল।
“আমাকে এখনই ফিরতে হবে।” অস্থিরভাবে বললেন ইভান্স, “আজ আমার বাড়ির ওই কাজের মহিলা ছুটি নিয়েছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অন্ধকার হয়ে যাবে। তার মধ্যে আলো জ্বালানো না হলে…!”
ওই খাড়া পথ ধরে ইভান্স যেভাবে ছুটলেন সেটা তাঁর চেহারা আর চলনের সঙ্গে একেবারেই মেলানো যায় না। ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যেও মানুষটিকে প্রায় ছুটতে দেখে মনে হল, উনি সত্যিই চিন্তিত… বা ভীত! আমার দিকে ঘুরে উনি চিৎকার করলেন, “আমার সঙ্গে এসো। দুজনে হাত লাগালে তাড়াতাড়ি আলোগুলো জ্বালানো যাবে। আলো না থাকলে বড়ো বিপদ হবে!”
ইভান্সের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষম হলেও ওঁর সঙ্গে তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছিলাম সেই সন্ধ্যায়। বাগানের গেটের সামনে পৌঁছে দেখলাম, ইভান্স তার মধ্যেই বাড়ির কাছে চলে গেছেন। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই একটা লণ্ঠন তুলে নিয়েছিলেন ইভান্স। কিন্তু সেটা জ্বলছিল না। আসলে দেশলাই ধরে থাকা ওঁর হাতটা এত কাঁপছিল যে শিখাতে আগুন ধরছিল না।
আমি ঘরে ঢুকে ওঁকে সাহায্য করার জন্য এগোলাম। হঠাৎ, আমার পেছনে খোলা দরজার দিকে আঙুল তুলে ইভান্স আর্তনাদ করে উঠলেন, “না-না! ওটাকে আটকাও।”
পেছন ফিরে দেখলাম, খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইভান্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা প্রকাণ্ড জোঁক!
মলিন একটা আভা বেরিয়ে আসছিল সেটার শরীর থেকে। সেজন্যই ওই অন্ধকারের মধ্যেও প্রাণীটাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আর পেলাম একটা গন্ধ— কাদা আর নোংরার মধ্যে অনেকক্ষণ কিছু ডুবে থাকলে তাতে যেমন গন্ধ হয়! নির্লোম শরীরে কোনো মাথা দেখিনি, তবে সামনের দিকে কুঁচকে থাকা অংশটা যেভাবে খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল তাতে মুখটা চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি। ইভান্সের কাছে এসে ওটা অদ্ভুতভাবে পেছনে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। মনে হল, যেন একটা বিষধর সাপ ছোবল মারার জন্য তৈরি হচ্ছে!
ইভান্সের বুকফাটা আর্তনাদ আমার অচল হয়ে থাকা শরীরটাকে ছুটে যেতে বাধ্য করল। আমি দুহাত বাড়িয়ে জোঁকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম— ওটাকে সরিয়ে আনব ভেবে। কিন্তু পারলাম না! মনে হল, আমি যেন কাদার তালকে ধরার চেষ্টা করছি। জিনিসটা আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে, তেলোর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এভাবেই কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। ওটুকুই যথেষ্ট ছিল।
চিৎকার ক্রমেই অসহায় কান্না আর বিড়বিড় হয়ে নৈঃশব্দ্যে মিলিয়ে গেল। জীবটা ইভান্সের ওপর ঝুঁকে থাকতে-থাকতেই তাঁর হাত-পা ছোড়া স্তিমিত হয়ে এল। কিছু একটা শুষে নেওয়ার আর টেনে নেওয়ার মাঝামাঝি শব্দ পেলাম। তারপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল জোঁকটা।
টলতে-টলতে একটা লণ্ঠন জ্বালালাম। সেই আলোয় দেখলাম, মেঝেতে যা পড়ে আছে তাকে শরীর না বলে চামড়া দিয়ে মোড়া একবস্তা হাড় বলাই সঙ্গত।
পোলার্নের বুক থেকে আরও কিছুটা দূষিত রক্ত শুষে বিদায় নিয়েছে তার রক্ষক!
[মূল কাহিনি: নেগোশিয়াম পেরামবুলান্স, লেখক: ই.এফ.বেনসন, প্রথম প্রকাশ: হাচিনসনস্ ম্যাগাজিন, নভেম্বর ১৯২২]