ভয় (চতুর্থ কিস্তি)
ঝড়ের আগেও ঝড়ের একটা গন্ধ আসে বাতাসে, চিনে নিতে হয়। দিদি চিনতে পারতো আমার আগে, আমাকে এসে বলতো, ঝড় আসছে। আর আমার একদম ভোজবাজি লাগতো পুরো ব্যাপারটা, কারণ একটু পরেই সত্যিকারের ঝড় এসে পড়তো। ঝড়ের মধ্যে যে একটা হঠাৎ চমকে দেওয়ার প্রবণতা থাকে, দিদি কিভাবে যেন সে-সব ধরে ফেলতে পারতো। জিজ্ঞেস করলে বলতো, বড় হলে বুঝবি। যেন ও নিজে তখন কত বড়!
ঝড়ে বরাবরই কারো না কারোর বাড়ির চাল উড়েছে, অনেক ফল ঝরে গেছে, বাজ পড়ে গাছ মরে গেছে, রাস্তায় বহু লোক আটকে গেছে, আর তাদের জন্য বাড়িতে কত লোক শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু আমার, বোধ হয় দিদিরও, একবারও সে-সব মনে আসেনি। হয়তো পাকা বাড়ি ছিল বলে, বাবাকে চাষাবাদের ফসল বেচে উপার্জন করতে হতো না বলে, বা মানুষের কষ্ট বোঝার বয়স আমাদের তখনও হয়নি বলেই, এসব ভাবাতো না।
বড় হতে হতে ঝড়ের মানেও বদলে যেতে থাকলো। এখন সব ঝড় আর আকাশ কালো করে মেঘের জটায় প্রাচীন, রাগী যুবক ঋষিদের আরও জটা চাপিয়ে উত্তর-পশ্চিম থেকে ছুটে আসে না। এখন ঝড় অনেক বেশি হয় মনের ভিতরে, ঠিক-ভুলে, উচিত-অনুচিতে, সত্য-মিথ্যেয়। যে ঝড়ে আঘাত পেয়ে কাউকে দোষী প্রমাণ করি, ঘরে ফিরে এসে মনে পড়ে এই একই আঘাত আমিও কখনও করেছিলাম কাউকে। উতলা হয়ে কখনও কখনও দিদিকে বলি এসব। এই ঝড়ের কোনও গন্ধ নেই আগেভাগে। তার সামনে ভঙ্গুর হওয়া ছাড়া, বা তাকে ধারণ করে কাউকে ভাঙা ছাড়া আর কীই বা করি আমরা?
ছোটবেলার স্কেচবুকের সেই ঝড়, যে এলে বাড়ির পাশের সুপুরি গাছগুলো পড়িমরি দুলতো, পাশের বাড়ির গ্যারেজের চলে খট-খট আওয়াজ হতো, যে এলে মা খোলা গলায় "বাদল বাউল বাজায় রে একতারা" গাইতেন বারান্দায় মেলা কাপড় তুলতে তুলতে, তার এক আনন্দ। আর বড়বেলার ঝড়ে নিজের সম্বলটুকু বাঁচাতে গিয়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়া, বা নিজের কৃত দোষ বা ভুলের উপলব্ধিতে যে গ্লানি, তার শুধু ছিন্নভিন্ন করা, দুঃখ, কষ্ট।
আরও পড়ুন : ভয় (দ্বিতীয় কিস্তি) / শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী
কিন্তু এত বুঝেও অবুঝ রয়ে যাই। মনে হয়, এখনও বারো আনাই জানা বাকি। কারণ, একই ঝড় কি করে আমাদের সুখের দোলনা আর অন্য কারুর যুদ্ধ; একসময়ের এমন আনন্দের উৎস, আর অন্য সময়ে এমন হাড়হিম করা ভয়ের? ঝড়ের সঠিক পরিচয় তবে কী? তা নিশ্চয়ই তার এই উদ্দাম বৈপরীত্যের বিভেদে নয়। বরং, তাদের মিলনে। ঝড়ের ভেতরে আসলে নিশ্চয়ই আছে এক শান্ত স্থিরাবস্থা, যা ছোটবেলার আনন্দের শোরগোল আর বড়বেলার অসহ্য বেদনাকে স্বীকার করে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে, এবং জানিয়েছে, দুয়ের একটি ছাড়াও ঝড় অসম্পূর্ণ। না, তার কোনও গন্ধ নেই, পূর্বাভাস নেই। দুই ঝড়ের মধ্যে পড়ে অসহায় লাগলে তবে বোধ হয় তাকে কিঞ্চিৎ জানা সম্ভব; মাথার উপরে চাইলে দেখা যায়, অকিঞ্চিৎকর সুপুরিফুলের মতো সে ঝরে পড়ে, হেসে, কেঁদে বলছে, সব সত্যি। সব পূর্ণ।
.........................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]