বিশ্বের বৃহত্তম ‘ম্যানগ্রোভ-সংরক্ষণ’ প্রকল্প : নেতৃত্বে সেনেগালের মৎস্যদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী
এরকম দেখতে আমরা একেবারেই অভ্যস্থ নই।
বরাবরই আমাদের দেশে কোনও দপ্তরের মন্ত্রী হতে গেলে (অর্থ বা স্বরাষ্ট্রের মতো দপ্তরগুলো বাদে) সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ব্যুৎপত্তি না থাকলেও চলে। তাই সেনেগাল সরকার যখন ২০১২ সালে পরিবেশমন্ত্রকের দায়িত্ব তুলে দেন খোদ একজন পরিবেশকর্মীর হাতে, সে খবর আমাদের ভারতীয়দের কাছে বেশ অন্যরকম লাগে। তাও আবার নিছক তাত্ত্বিক নন, হায়দার এল আলি রীতিমতো হাতেকলমে কাজ করা একজন পরিবেশকর্মী। পাশাপাশি তিনি ‘সেনেগালিজ গ্রিন পার্টি’ নামে এক পরিবেশ সংগঠনের প্রেসিডেন্টও। ২০১৩ সালে আলিকে মৎস্যদপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার অনেক আগে থেকেই অবশ্য জল-বাস্তুতন্ত্র ও ম্যানগ্রোভ অরণ্য নিয়ে কার্যত অসম্ভব এক লড়াইয়ে নেমে পড়েছেন তিনি।
ছোট থেকেই প্রকৃতির অপার রহস্য আলিকে ভাবাত। এই বিপুল বিশ্বের প্রতিটি উপাদানের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার বিষয়টা নিতান্ত কমবয়েসেই অস্ফুটভাবে টের পেতেন তিনি। চারপাশের বাস্তুতন্ত্রকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। আসবাবপত্রের ব্যবসার উত্তরাধিকার থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত কাজকর্মের দিকে সরে আসতে বেশি ভাবতে হয়নি তাই। ‘ওশেনিয়াম’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে বছরের পর বছর অক্লান্তভাবে তিনি কাজ করেছেন। তবে গত এক দশকে তাঁর ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ প্রকল্প গোটা বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছে।
ইউনাইটেড নেশনসের খাদ্য ও কৃষি দপ্তরের একটি হিসেব বলছে, ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে গোটা সেনেগালে প্রায় ১.৩৩ লক্ষ একর ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গুরুত্বের তালিকা বেশ লম্বা। ম্যানগ্রোভ উপকূল অঞ্চলের ভূমিক্ষয় রোধ করতে বিরাট ভূমিকা নেয়, বাতাস থেকে বেশ ভালো পরিমাণ কার্বন শোষণ করে। তাছাড়াও বহু জলজ প্রাণের মাথা গোঁজার ঠাঁই। এই বিপুল ক্ষতি পূরণের জন্য আলি দুঃসাহসিক এক পরিকল্পনা নেন। কাসামেন্স প্রদেশটি সেনেগালের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত। দেশের সমস্ত সবুজের সিংহভাগ রয়েছে এই কাসামেন্স অঞ্চলেই। কাসামেন্স নদীর ব- দ্বীপ অঞ্চল আফ্রিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ অরণ্যগুলির মধ্যে একটি। আলির নেতৃত্বে ‘ওশেনিয়াম’ প্রথমে বিপুল পরিমাণে বীজ সংগ্রহ করে। তারপর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় কাসামেন্স অঞ্চলের শতাধিক গ্রামের অসংখ্য মানুষকে এই কাজে অংশীদার করে নেয়। ২০০৬ থেকে ২০১২ - এই ছ’ বছরে কাসামেন্স অববাহিকার অন্তত ৩৫ হাজার একর জায়গা জুড়ে ম্যানগ্রোভ চারা বসানো হয়। এটিই সম্ভবত পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ প্রকল্প। এই অতিমানবিক কর্মকাণ্ড নজরে আসতেই সরকার তাঁকে পরিবেশমন্ত্রক দেয়। পরের বছর তিনি পান মৎস্যমন্ত্রক। পদমর্যাদাকে কাজে লাগিয়ে তিনি আরও মসৃণভাবে এই কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছেন।
ম্যানগ্রোভ ছাড়াও সেনেগালের অরণ্যসম্পদের আরেকটি বড় দিক হল রোজউড গাছ। প্রতিবেশি দেশ জাম্বিয়া থেকে কাঠের চোরাকারবারিরা দীর্ঘকাল সেনেগালের রোজউড গাছ কেটে পাচার করত। সরকার সব জেনেও ব্যবস্থা নেবার ব্যাপারে গড়িমসি দেখিয়েছে। ক্যাবিনেট হাতে পেয়ে আলি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন এবং বনদপ্তরের সক্রিয়তায় গত কয়েক বছরে এই চোরাপাচার অনেকটা কমিয়ে ফেলা গেছে।
আলি নিজে মনে করেন, প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক উপাদান সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বের রোলমডেল হতে পারে সেনেগাল। তবে আত্মতুষ্ট নন তিনি। কারণ তিনি জানেন, সভ্যতার অগ্রগতি আর মানুষের লোভ পৃথিবীর যতটা ক্ষতি করে ফেলেছে তার পূরণ কার্যত অসম্ভব। তাই এই ৬৭ বছর বয়েসেও, তিনি ক্লান্তিহীনভাবে লড়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর জন্য। আজও নিজে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষজনের মধ্যে বীজ বিতরণ করেন এবং বৃক্ষরোপণে উৎসাহ যোগান। সেনেগালের ‘ম্যানগ্রোভ ম্যান’ হিসেবে আলিকে তো মনে রাখতে হবেই, পাশাপাশি এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে তিনি সেই বিরল রাজনীতিকদের একজন, যিনি তাঁর মন্ত্রকের কাজটাকে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন।
ঋণ : www.bbc.com
#ম্যানগ্রোভ #পরিবেশ #প্রাণচক্র #হায়দার আলি #সেনেগাল