কাকে বলব 'সফলতা', কাকে বলব 'সফল' : সঞ্জয় মিশ্রের 'কামইয়াব'
ফিল্ম - কামইয়াবমুক্তি - ২০১৮ (বুসান ফিল ফেস্টিভ্যাল), ভারতে মুক্তি ৬ মার্চ, ২০২০ (নেটফ্লিক্স) অভিনয় - সঞ্জয় মিশ্র, দীপক দোবরিয়াল, ইশা তলওয়ার, সারিকা সিং, অবতার গিল প্রমুখ পরিচালনা - হার্দিক মেহতা চিত্রনাট্য, সংলাপ - রাধিকা আনন্দ, হার্দিক মেহতা সিনেমাটোগ্রাফি - পীযূষ পুটি আবহ - রচিতা অরোরাপরিবেশনা - রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট
গণশক্তির মতোই এ ছবিও নিরপেক্ষ নয় - চিরকালীন হেরে যাওয়াদের পক্ষে। কিন্তু একটি পক্ষ নেওয়া ছবির সর্বাঙ্গে এত পরিমিতিবোধ সচরাচর দেখা যায় না। পক্ষ নেওয়া ছবি সাধারণত অসংযমী হয় অথবা বিষণ্ণতাবিলাসী। এ ছবির মূল সুর প্রসন্নতা। যে প্রসন্নতা টিপিকাল বিভূতিভূষণ ঘরানার। যাঁরা আগ্রাসী পাঠক তাঁদের মনে পড়বে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কিশোর সাহিত্য বা মনোজ মিত্রের কমেডিও।
‘কামইয়াব’ এক ‘আলু’র গল্প। ইন্ডাস্ট্রিতে পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতাদের ডাকনাম এটাই। ‘আলু’। মানে মাল্টিপারপাস, এবং টেকন ফর গ্রান্টেড। যাদের ছাড়া চলে না, অথচ আলাদা করে স্বীকৃতি দেবার কথা ভাবা হয়ে ওঠে না কারো। এহেন এক ‘আলু’ই এখানে মূল চরিত্র। নাম সুধীর। কখনও চাকর, কখনও নায়কের বন্ধু কখনও ভিলেনের সহচর কখনও ছিঁচকে গুন্ডা কখনও শেষ দৃশ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে আসা পুলিশ অফিসারের চরিত্র করতে করতে আসতে আসতে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছেন সুধীর। সেটাই তো নিয়তি। চুপচাপ বিস্মৃতির খাতায় চলে যাওয়া। কিংবা থেকেও না থাকা। সুধীরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সঞ্জয় মিশ্র। চামড়ায়- রক্তে- মাংসে তিনি এমনভাবে সুধীর হয়ে উঠেছেন যে ‘আঁখো দেখি’-র ওই অবিশ্বাস্য অভিনয় দেখা থাকলেও আপনি ভাবতে বাধ্য হবেন, এটাই সঞ্জয়ের শ্রেষ্ঠতম অভিনয় কিনা।
এই সেদিনই কোনও একটা গবেষণাপত্রে দেখছিলাম, আধুনিক মানুষের মনোযোগের পরিমাণ একটা গোল্ডফিশের থেকেও কমে গেছে। স্টারডমের চেয়ে ছলনাময় আর কী আছে? যে যত বড় তারকা, তাঁর নিরাপত্তাহীনতা তত বেশি। সমাজ-স্মৃতি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা উদ্বেগপ্রদ। মাথায় তুলতেও সময় নেয় না, ছুঁড়ে ফেলতে তো আরোই কম সময় নেয়। ব্যক্তি-মন বাজার অর্থনীতির মতো দ্রুততায় ওঠানামা করতে পারবে না কোনওদিন। আর নিজের পতন মেনে নেওয়া পৃথিবীর কঠিনতম কাজ। মধুর ভাণ্ডারকরের ‘হিরোইন’-এর মতো হিংস্র দেখায়না কামইয়াবের সুধীরের নিরাপত্তাহীনতার মুখটিকে। স্টারদের আলোয় চাপা পড়ে থাকা কমবেশি অভ্যেসই থাকে আলুদের। নিজেদের নিয়তি জানা থাকে বলেই সুধীরদের যন্ত্রণার উৎসমুখটা দৃশ্যত হয়তো কিছুটা মসৃণ। হঠাৎ কালব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মরে যাবার সঙ্গে ক্রনিক মারণরোগ নিয়ে দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে একটু একটু করে মরার যে তফাত, স্টারদের সঙ্গে ‘আলু’দের তফাত ঠিক সেখানে। স্টারদের পতন দেখতে বেশি ভয়ঙ্কর লাগে ঠিকই, কিন্তু ‘আলু’দের ফুটিফাটার জ্যামিতি অনেক বেশি সেরেব্রাল - অনেক বেশি অতল। গভীর সহ-অনুভূতির জায়গায় না পৌঁছতে পারলে যা ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। হার্দিক তা পেরেছেন। অপরিসীম দরদ দিয়ে একটার পর একটা ডিটেল বুনেছেন তিনি। অথচ, আগেই যেটা বলছিলাম, আশ্চর্য সুন্দর এক পরিমিতিবোধ বেঁধে রেখেছে গোটা ছবিটাকে। গ্লাস থেকে একফোঁটাও ছলকে যায়নি অপূর্ব প্রিমিয়াম পানীয়।
সুধীরের সরে যাবার প্রত্যক্ষ কারণ বিশেষ একটি ঘটনা। এক পরিচালক তাঁকে ঠকিয়ে তাঁর সিট আপের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে সেটিকে একজন রতিকর্মরত নারীর দৃশ্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে যৌনদৃশ্য তৈরি করেছিলেন। তাতে সুধীর বেশ বদনাম কুড়িয়েছিলেন। তারপর স্ত্রীর চাপে সরে আসা। স্টার নন বলে এই সরে আসায় কোনও স্টোরি হয়নি, হইচই হয়নি। কিন্তু ফিল্মলাইন থেকে বহু দূরে সরে এসেও সুধীর বেরোতে পারেননা সেই নেশা থেকে। চাপা জামা, চোঙা প্যান্ট, বুট আর বাহারি পরচুলা পরে বাবুলাল (সুধীরের পেশাদার নাম) হয়ে তাঁর ঘুরে বেড়ানো বড় করুণ লাগে। ছবি যেখান থেকে শুরু হচ্ছে, ততদিনে তাঁর স্ত্রী বেঁচে নেই। জীবনে তাঁর তিনটে সম্বল - একজন মাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সপ্তাহান্তে একবার বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে দেখা করা, আর বোতল। এহেন সুধীর প্রেস ইন্টার্ভিউ সূত্রে জানতে পারেন তিনি একটা রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। অভিনেতা হিসেবে তাঁর ফিল্মের সংখ্যা ৪৯৯। আর একটা ছবি হলেই ৫০০। ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে সুধীর ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। পুরনো জায়গা ফিরে পাবার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন। সুযোগ আসে। কিন্তু অভ্যেস চলে গেছে। দর্শক হিসেবে কষ্ট হতে থাকে, যখন সুধীর একের পর টেক দিয়েও ‘ওকে’ করতে পারেন না। পুরো সেটের সামনে দাঁড়িয়ে সুধীরের সঙ্কোচে অপমানে কালো হয়ে আসা মুখখানা যখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে তাঁর এক্সপায়ারি ডেট চলে গেছে, সেই বেদনাকে ব্যাখ্যা করার মতো শব্দ কোনও ভাষার শব্দভাণ্ডারেই নেই। সঞ্জয় মিশ্রর মতো অভিনেতাদের কথা ভেবে আফশোস হয়। অকিঞ্চিৎকর স্ল্যাপস্টিকের আবর্তে আমরা দিনের পর দিন অপচয় করেছি এইসব বিরল প্রতিভাকে।
মনোবিকলনের সূত্রে সুধীরের সামনে ভূতের মতো সমস্ত নির্ণায়ক চরিত্র এসে দাঁড়ায়, একমাত্র সেই দৃশ্যটি সুনির্মিত লাগেনা। তাছাড়া চিত্রনাট্য বা দৃশ্যায়নের খুঁত পাওয়া কঠিন, খুঁজতে ইচ্ছেও করে না। সুধীরকে কেন্দ্র করে যে যে চরিত্রগুলো এসেছে প্রত্যেকটাই নিপুণ যত্নে তৈরি। কাস্টিং ডিরেক্টরের চরিত্রে দীপক দোবরিয়াল অসামান্য। এছাড়া বিশেষ করে মনে থেকে যাবে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছেলেটির চরিত্রটিকে, যে পুরনো অভিনেতাদের ছবি কেটে কেটে খাতায় জমাত (আকাশদীপ অরোরা)। মনে থেকে যাবে অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই আসা ওপরের ফ্ল্যাটের মেয়েটিকেও (ইশা তলওয়ার)। পরিচালককে ধন্যবাদ, তিনি জিতিয়ে দেননি সুধীরকে। নাতনির স্কুলের অনুষ্ঠানে সুপারস্টার অতিথি রাহুল চোপড়ার দেরিবশত আকস্মিকভাবে পড়ে পাওয়া ওই সামান্য কয়েক মিনিট। ওই ক্ষণটুকুই তো সেই চিরকাল। যা ছুঁতে চেয়েছিল সুধীর। সব সত্যই তো চলমান। ক্ষয়িষ্ণু। সুধীরের সেই ছোট্ট অথচ মহান জিতে যাওয়াকে কী মহাকাব্যিক উচ্চতায় পৌঁছে দেন সঞ্জয়, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। রাহুল চোপড়া এসে যাওয়ামাত্র ক্যামেরা ঘুরে যায় তার দিকে। পর্দা পড়ে যেতে শুরু করে সুধীরের মুখের ওপর। শুধু নাতনি ছুটে যায় সুধীরের কাছে। আর একেবারে শেষ মুহূর্তে ফিরে তাকায় মেয়ে। বাবুলালের দিকে। সুধীরের দিকেও। এটাই তো পাওয়া। আর কী পাওয়ার থাকে মানুষের, এই নশ্বর জীবন থেকে? কেন ছবির নাম সফলতা, বড় ভালো লাগে এই দৃশ্যে দাঁড়িয়ে সেটা টের পেতে।
পাওলো কোয়েলহো শাহরুখ খানকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এই ছবিটি প্রযোজনার জন্য। ভারতীয় দর্শক কি সেভাবে গ্রহণ করলেন? মনোযোগ দিলেন? স্মৃতির চলে যাবার গতি এখন আলোর চেয়ে সামান্যই কম। মানুষ আজকাল গোল্ডফিশের চেয়েও দ্রুতগতিতে ভুলে যায়। তবে হার্দিক মেহতার এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিশ্চিতভাবেই কাল্ট হয়ে থাকবে। অন্তত খাতায় কলমে।
#kaamyaab #Sanjay Mishra #Red Chillies Entertainment #Netflix #Hardik Mehta #কামইয়াব #নেটফ্লিক্স #ফিল্ম রিভিউ #Film Riview #মৃণালিনী ঘোষাল