নিউটনের তত্ত্বকে যিনি নিয়ে এসেছিলেন ইতালিতে
ফ্রান্সে যখন এমিলি দু শেটেলে নিয়ে আসছেন সতেরো শতকের ব্রিটেনে পদার্থবিদ্যার শ্রেষ্ঠ কাজ নিউটনের প্রিন্সিপিয়ার অনুবাদ, প্রায় ওই সময়ে ইতালিতে এক অসাধারণ প্রতিভাবান মহিলা সুযোগ পাচ্ছেন সে দেশের বিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করবার। যা সে আমলের পক্ষে যথেষ্ট যুগান্তকারী। পরে ইনিই ইতালির বুকে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে নিউটনের তত্ত্ব প্রচারে নামবেন।
এই ইতালীয় অধ্যাপকের নাম লরা বাসি। আঠেরো শতকের ইউরোপে হাতে গোনা যে কয়েকজন মহিলা প্রখর মেধা আর মনের জোরে শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, তাঁদের একজন লরা। তাঁর জন্ম ১৭১১ সালে, ইতালির বোলোনা শহরে। দু শেটেলের মতোই তাঁর নামও শুধু ইউরোপ না, ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকা অবধিও। এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম অধ্যাপনা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
সে আমলে কেমন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল লরার, একটা নমুনা দিই। ১৮০৩ সালে ফরাসি জ্যোতির্বিদ জেরোম ল্যালাঁদে (Jérôme Lalande, ১৭৩২-১৮০৭) এক স্মৃতিচারণ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর আগে কীভাবে শুধু লরার সঙ্গে দেখা করবার জন্য ইতালি ছুটে গিয়েছিলেন, সে ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করেন। তাঁর নিজের দেশ ফ্রান্সে মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহ থাকলেও পরিস্থিতি তাদের সেই সুযোগ দেয়না বলে তিনি যথেষ্ট দুঃখপ্রকাশ করেন, আর লরাকে দেখে তাঁদের দেশে সকলের উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত এ কথাও বলেন। অবশ্য তাঁদের দেশেও এমিলি দু শেটেলের উদাহরণ তাঁর সামনে ছিল। তবু লরার অসাধারণ সাফল্য আর স্বীকৃতি তাঁকে মুগ্ধ না করে পারেনি।
লরার জন্ম ১৭১১ সালের নভেম্বরের ২৯ তারিখে। বাবা ছিলেন উকিল, যদিও পসার ছিল না বিশেষ। খুব অল্প বয়স থেকে লরা পড়াশুনো শুরু করেন। তাঁর এক তুতো দাদা লোরেঞ্জো স্টেগানি ছিলেন চার্চের ফাদার, তিনিই লরাকে পাঁচ বছর বয়স থেকে ল্যাটিন আর ফরাসি ভাষা এবং গণিত শেখাতে শুরু করেন।
একটু বড় হওয়ার পর লরাকে পড়াতে আসতেন স্থানীয় এক শিক্ষিত যুবক এবং এক ডাক্তার। ততদিনে লরা দুটো ভাষা আর গণিত শিখে ফেলেছেন অনেকটাই। এবার শিখতে লাগলেন দর্শন, তর্কবিদ্যা আর প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। ততদিনে বিদ্বান হিসেবে তাঁর অল্পবিস্তর নামডাক হতে শুরু করেছে। স্থানীয় লোকেরা দেখতে আসতেন এই অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মেয়েটিকে। আসতেন দেশের অন্যান্য প্রান্তের শিক্ষানুরাগীরাও।
এসে গেল ১৭৩২ সাল। লরা তখন বিংশতি বর্ষের তরুণী। সে বছর মার্চ মাসে বোলোনা অ্যাকাদেমি অব সায়েন্স-এর সদস্য নির্বাচিত হলেন লরা। আর তাঁর গবেষণাপত্র জমা দিলেন বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটাই পরে তাঁকে ডক্টরেট এনে দেবে।
তবে ওই বছর এপ্রিল মাসে এমন এক ঘটনা ঘটল, যা বদলে দিল তাঁর জীবনের গতিপথকে।
বোলোনা শহরের পাঁচজন উঁচু স্তরের শিক্ষিত ব্যক্তির বিপক্ষে এক প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে নামতে এগিয়ে এলেন কুড়ি বছরের মেয়ে লরা। তাঁর বন্ধু আর আত্মীয়রাই তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এই অসম লড়াইয়ে নামিয়ে দেন তাঁকে। আসলে সকলেরই মনে বিশ্বাস ছিল যে লরাই জিতবেন।
তর্কযুদ্ধ হবে প্রকাশ্যে, তার জন্য নির্বাচন করা হল বোলোনার এক মস্ত প্রাসাদের সামনের চত্বরটিকে। প্রচুর লোক এলেন, সকলেই এই অসম-লড়াই প্রত্যক্ষদর্শী হতে চান।
দর্শকদের মধ্যে এসেছেন পোপ প্রেরিত প্রতিনিধি কার্ডিনাল গ্রিমাল্ডি এবং কার্ডিনাল প্রস্পেরো ল্যাম্বারতিনি। এই ল্যাম্বারতিনি পরে পোপের পদে উন্নীত হয়েছিলেন, তখন তিনি পোপ চতুর্দশ বেনেডিক্ট নামে পরিচিত হন।
বলার বোধ হয় দরকার নেই, সেদিন লরাই জয়লাভ করেন, যা উপস্থিত দর্শকদের মোহিত করে দেয়। আর ওই ঘটনার পর লরা নজরে আসেন কার্ডিনাল ল্যাম্বারতিনির। তিনি লরাকে উৎসাহ দেন যাতে তিনি পড়াশুনো চালিয়ে যান। বেশ কয়েক বছর পর ১৭৪৫ সালে এই ল্যাম্বারতিনি, তখন তিনি পোপ হয়ে গিয়েছেন, ইতালির পঁচিশজন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে 'বেনেদিত্তিনি' নামে একটি এলিট গ্রুপ তৈরি করেন, যে দলে অনেকের আপত্তি স্বত্ত্বেও তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন লরাকে।
ওই দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাসখানেক বাদে লরার জীবনে আরও এক বিশেষ ঘটনা ঘটল, বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট পেলেন তিনি। আর এর কিছুদিন বাদে লরা পেলেন নতুন এক সম্মান; ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে অধ্যাপক পদ দেওয়া হল। তিনিই হলেন ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার প্রথম মহিলা অধ্যাপক। নির্দিষ্ট মাইনে বরাদ্দ হয় তাঁর জন্য, এবং তিনি নিয়মিত ক্লাস নিতে থাকেন ছাত্রদের। তবে সহ-অধ্যাপকদের মধ্যে অনেকে আপত্তি বা ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারেননি, একজন মহিলা তাঁদের মধ্যে স্থান করে নিচ্ছেন, এটা সে আমলে খুব কম পুরুষ অধ্যাপক মেনে নিতে পারতেন।
স্বাভাবিকভাবেই এইসময় তাঁর নামডাক আরও ছড়াতে থাকে। আর এটাও এখানে বলে নেওয়া দরকার, লরা অধ্যাপনার পাশাপাশি নিজের পড়াশুনোও চালিয়ে যেতেন, নতুন নতুন বিষয় শেখবার জন্য আগ্রহ তাঁর মধ্যে রয়েই গিয়েছিল জীবনভর।
এই আগ্রহই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় আইজ্যাক নিউটনের কাজের দিকে। নিউটনের মৃত্যু হয়েছে লরার অধ্যাপক হওয়ার বছর পাঁচেক আগে, আর ইউরোপে তখন তাঁর কাজ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক চালু রয়েছে। এরই মধ্যে লরা পড়াশুনো শুরু করেন নিউটনের কাজ নিয়ে, আর সুযোগ আসে ভ্যাটিকানের এক বিশাল পুস্তকভাণ্ডার ব্যবহারের। সব মিলিয়ে লরা নিউটনের তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ হিসেবে আস্তে আস্তে খ্যাতি পেতে শুরু করেন। ইতালির নানা প্রান্ত থেকে তাঁর কাছে নিউটনের তত্ত্ব বুঝতে ছাত্র থেকে সাধারণ উৎসাহী মানুষ আসতেন।
ইতিমধ্যে ১৭৩৮ সালে লরা বিয়ে করেন বোলোনা বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাকৃতিক দর্শনের অধ্যাপক এবং ডাক্তার গিওভানি গুইসেপ্পি ভেরাত্তি-কে। তাঁদের বেশ কয়েকজন সন্তান হয়েছিল, তবে ঠিক কতজন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সন্তানদের মানুষ করবার পাশাপাশি এই দম্পতি বাড়িতে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া আর বাড়িতে অবসর সময়ে যন্ত্রপাতি নিয়ে পদার্থবিদ্যার নানা বিষয়ে গবেষণা চলত, আর এসবের পাশাপাশি লরা যোগাযোগ রাখতেন ইউরোপের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা দার্শনিকের সঙ্গেও। এঁদের একজন হলেন তড়িৎবিদ্যার মহাবিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা (যাঁর নামে বিভবপ্রভেদের একটি একক ভোল্ট), আর একজন ভলতেয়ার।
লরার প্রচেষ্টাতেই ভলতেয়ারকে বোলোনা আকাদেমি অব সায়েন্সের সদস্যপদ দেওয়া হয়েছিল। লরা নিজেও এখানে নিয়মিত নিজের লেখা বৈজ্ঞানিক পেপার পাঠ করতেন, একটা হিসেব থেকে দেখা যায় মৃত্যুর আগে অবধি এখানে লরা মোট একত্রিশটি পেপার পড়েছিলেন। এই লেখাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই কালের কবলে পড়ে হারিয়ে গিয়েছে, যে কটা টিকে গিয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাতাসের স্থিতিস্থাপকতা, তরলের মধ্যে থেকে নির্গত হওয়া বায়ু-বুদবুদ নিয়ে, উদস্থিতিবিদ্যা বিষয়ক একটি গদ্য এবং প্রাসের গতি সংক্রান্ত একটি পেপার।
ষাটের দশকের দিকে তিনি তড়িৎবিদ্যা নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। সে আমলের পক্ষে লরার এই বিবিধবিদ্যা চর্চা স্বাভাবিক, আবার অন্য দিক থেকে প্রশংসনীয়ও বটে। জ্ঞানের সীমানা তাঁর কাছে বাধা হয়নি কখনও। আবার তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে ওপরের দিকেই বিবেচিত হতেন তাঁর একটা বড় প্রমাণ, ষাটের দশকের দিকে, যখন তাঁর অধ্যাপনার বয়স তিরিশ পেরিয়েছে, তিনিই সবচেয়ে বেশি মাইনে পেতেন।
এছাড়া মৃত্যুর দু বছর আগে লরা আরও একটি বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠানে পড়াবার ডাক পান। তাঁর আগে ওই পদে ছিলেন পাওলা বাত্তিস্তা নামে এক অধ্যাপক আর লরার স্বামী ছিলেন তাঁর সহকারী। বাত্তিস্তার জায়গায় যখন লরা এলেন, মজার ব্যাপার তাঁর স্বামী সেই সহকারীই রয়ে গেলেন। স্ত্রীয়ের গবেষণা-সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্বামী, এ জিনিস আজকের দিনেই কি দেখা যায় বড় একটা?
আরও পড়ুন : যাঁকে বঞ্চিত করে নোবেল দেওয়া হয়েছিল কুরি-তনয়াকে / অর্পণ পাল
১৭৭৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লরার মৃত্যু হয়। রেখে যান স্বামী আর চার সন্তানকে। এই সালটি আমাদের কাছে স্মরণীয় কারণ ওই বছরেই প্রকাশিত হয় প্রথম বাংলা বই, নাথানিয়ান ব্রাসি হালেদ-এর লেখা এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজ।
..........