গোয়েন্দা যখন বাঙালি মেয়েরা
কাঁথা সেলাই করে আর রাজ্যের খবর শুনে জীবন কাটিয়ে ফেলা এক মহিলা। গ্রাম্য। অবিবাহিতা। সকলে ডাকে বিন্দিপিসি বলে। তিনিই কিনা ঘরে বসে অতীতের এক হত্যারহস্যের গল্প শুনতে শুনতে জট ছাড়িয়ে ফেললেন তার!
‘বিন্দিপিসির গোয়েন্দাগিরি’-র এহেন কাহিনি আমাদের জানাই হত না, যদি না ১৯৬০ সালে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত বার্ষিকী ‘অপরূপা’-তে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় সে গল্প লিখতেন। ঘরে বসে মেয়েদের গোয়েন্দাগিরির আরেকখানা উদাহরণ পাওয়া গেছিল প্রায় এর সমকালেই। প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত হাজির করেছিলেন সদুঠাকুমা ওরফে সৌদামিনী দেবীকে। ‘ঠাকুমার গোয়েন্দাগিরি’ গল্পে সদ্যবিধবা ঠাকুমা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে ধরে ফেলেছিলেন ঠাকুরদার খুনিকে। অবশ্য বলে রাখা ভালো, ‘বিন্দিপিসির গোয়েন্দাগিরি’ ছিল ত্রিশ বছর আগে ‘দ্য স্টোরিটেলার’ পত্রিকায় বেরোনো আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য রেজারেকশন অফ এমি ডুরান্ট’ গল্পের অনুকৃতি। সদুঠাকুমার মধ্যেও মিস মার্পলের ছায়া পড়েছিল ভালোরকম। কিন্তু পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণা খুঁজতে খুঁজতে যে কথাটা আমাদের মনে থাকে না, তা হল, বাংলায় মেয়েদের এমন ঘরোয়া গোয়েন্দাগিরির কৃতিত্ব মোটেও বেনজির নয়। প্রাচীন পুরাণ, লোককথা, এমনকি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পাতা ওলটালেও দেখা যাবে এ বিষয়ে মেয়েদের একটা সহজাত পটুত্ব আছে। যেমন ধরা যাক মনসামঙ্গলের কথা। শিব নিত্য অভ্যাসমতো ফুলের সাজি চণ্ডীর হাতে না দিয়ে রেখে দিয়েছেন। অমনি সন্দেহের পোকাটি কামড় দিল শিবানীর মাথায়। সোজা ফুলের সাজি সার্চ করে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন মনসাকে। তারপরের দাম্পত্য কলহের প্রসঙ্গ এখানে নাহয় উহ্যই থাক। বরং চলে আসি দময়ন্তীর কথায়। বিবাহসভায় তিনি প্রেমিককে চিনে নিয়েছিলেন চার দেবতার মধ্যে থেকে, আর বাহুকবেশী নলের স্বরূপ উন্মোচনে তিনি প্রায় গোয়েন্দাগিরিই করেছেন বলা যায়। কিংবা আরব্য রজনীর মর্জিনা। দস্যুসর্দারের কোনও কৌশলই গোপন থাকে না তার ক্ষুরধার বুদ্ধির কাছে। গোয়েন্দা গল্পের ক্লাইম্যাক্সের মতোই গল্পের শেষে ভিলেনের স্বরূপ প্রকাশ করে দেয় সে। উনিশ শতকের শেষেই এই গল্প অবলম্বনে হিট নাটক ‘আলিবাবা’ লিখবেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। গল্প লিখবেন যোগীন্দ্রনাথ সরকারও।
কিন্তু মজার কথা হল, বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের পাতায় প্রথম দিকে দূরবিন দিয়ে দেখলেও চোখে পড়বে না একটিও মেয়ের গোয়েন্দাগিরি। অথচ গোয়েন্দা গল্প তখন ‘সেলিং লাইক হট কচুরিজ’! পুলিশি কেস ফাইল দিয়ে যার গোড়াপত্তন, উনিশ শতকের স্বল্প বিনোদনের যুগে সেসব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গরম খবর কেমন হুলুস্থুল ফেলেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে, তার প্রমাণ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’-এর মোট কিস্তির সংখ্যা। একুশ বছরে ২১৭টি! মেয়েরা গোয়েন্দা হতে না পারলেও, টিআরপি বাড়াতে কাজে লেগেছিল বইকি!
‘দারোগার দপ্তর’-এর বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই বটতলা-জাতীয় ডিটেকটিভ কাহিনি লেখার হিড়িক পড়ে গেল। মহাজনের পন্থা মেনেই সেখানেও লাস্যময়ী খলনায়িকাদের ভিড়। অব্যবহিত পরে ‘মায়াবিনী’, ‘মনোরমা’, ‘নীলবসনা সুন্দরী’— পাঁচকড়ি দে-র একের পর এক বইয়ে সুপারহিট হল গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় আর খলনায়িকা জুমেলিয়ার জুটি। ‘বক্ষের বসন ও কাঞ্চলী খুলিয়া’ গোয়েন্দার মন ভোলানোর চেষ্টার পাশাপাশি খলনায়িকাকে দিয়ে গোয়েন্দার প্রতি প্রেমনিবেদন, এহেন মোক্ষম টুইস্টেই জুমেলিয়াকে মনে রাখল বাঙালি পাঠক। গোয়েন্দাকাহিনির জমজমাট বাজার ধরতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দীনেন্দ্রকুমার রায়ও ‘রঙ্গিনীর রণরঙ্গ’-এ সগৌরবে উপস্থিত করলেন নারীদস্যু মিস ওলগা নাসমিথকে। আরও পরে স্বপনকুমার তাঁর গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির বিপরীতে আমদানি করেন অপরূপ সুন্দরী দুর্দান্ত কালনাগিনী এবং ‘আগুনের নেশা মাখানো’ লাস্যময়ী ফ্লোরাকে।
কী মনে হচ্ছে? ধান ভানতে শিবের গীত? বাঙালি মেয়েদের গোয়েন্দা হয়ে ওঠার কথায় খলনায়িকাদের বৃত্তান্ত কেন? আসলে বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় কাটিয়ে ফেলার পরেও গোয়েন্দাকাহিনি মেয়েদের জন্য খলনায়িকার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভূমিকা বরাদ্দ করে উঠতে পারেনি। গোয়েন্দার ভূমিকা ছিল পুরুষের একচেটিয়া অধিকারে, এমনকি মেয়েদের কলমেও।
সময়ের চাকাটা ঘুরতে লাগল এবার। বৈশাখ, ১৩৫৯। মাসিক শুকতারার পাঠকদের নজর কেড়ে নিল একটি পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন। প্রকাশিত হতে চলেছে “এদেশে মেয়েদের ‘আডভেঞ্চার’-বইয়ের প্রথম পথপ্রদর্শিকা” প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কৃষ্ণা সিরিজ। ততদিনে প্রহেলিকা আর কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের চারটি কাহিনিতে কৃষ্ণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছে বাঙালি পাঠিকারা। তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এমন একটি মেয়ে, পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে যে ভয়ংকর দস্যু ইউ-উইনের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। কৃষ্ণাকে অবলম্বন করেই বাংলা সাহিত্য পেল প্রথম মেয়ে-গোয়েন্দা সিরিজ। ক্রমশই বাড়ছিল এর জনপ্রিয়তা। ফলে কৃষ্ণার পরে মেয়ে গোয়েন্দা অগ্নিশিখাকে কেন্দ্র করে আরও একটি পৃথক সিরিজ ‘কুমারিকা’-র প্রবর্তন করল দেব সাহিত্য কুটীর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যখন ভারতের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে চাইছে, সেই সময় বইয়ে পড়া যুদ্ধের স্বরূপ নিজের চোখে দেখতে চেয়ে শিখা পাড়ি দেয় চট্টগ্রামে। সুপারহিরোদের সঙ্গে নিজের যে প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়, কৃষ্ণা বা শিখার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হল নতুন প্রজন্মের বাঙালি মেয়েদের কাছে।
গোয়েন্দাসাহিত্যে বারবারই ফিরে ফিরে এসেছে পতিতাপল্লি, শুঁড়িখানা, মাদক, চোরাচালান, আর সর্বোপরি, নরনারীর অবৈধ সম্পর্ক ও নিষিদ্ধ যৌনতা। এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ মানুষের মনের অন্ধকার দিকগুলোই তো অপরাধ-মনস্তত্ত্বের আঁতুড়ঘর। কিন্তু বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের প্রাথমিক যুগে নারী, ক্রাইম এবং নিষিদ্ধ যৌনতাকে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছিল একই সমীকরণে। আটের দশকে এই ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ জানাল অদ্রীশ বর্ধনের গোয়েন্দানী নারায়ণী। নারীর সঙ্গে উদগ্র যৌনতার পূর্ব সমীকরণ এখানেও বজায় রইল, তবে এইবার তাকে দেখা গেল অপরাধের অন্য প্রান্তে। দ্রুত বদলাতে লাগল এতদিনের ট্র্যাডিশন।
দারোগা প্রিয়নাথ থেকে ব্যোমকেশ পর্যন্ত পৌঁছোতে পৌঁছোতে পুরুষ গোয়েন্দারা অ্যাকশন-নির্ভরতা থেকে ঢুকে পড়ছিলেন বৌদ্ধিক চর্চার দুনিয়ায়। একই পথ ধরে এগিয়ে গেলেন মেয়ে গোয়েন্দারাও। অজিতকৃষ্ণ বসু হাজির করেছিলেন সায়েন্স কলেজ থেকে এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম নন্দিনী সোমকে। আশাপূর্ণা দেবী ‘মেয়ে গোয়েন্দার বাহাদুরি’ গল্পে দিব্যি একহাত নিয়েছেন পুরুষ গোয়েন্দার একাধিপত্যের অভ্যাসকে। এ গল্পে সাধারণ গৃহপরিচারিকা কাজল বাড়িতে বসেই সমাধান করে ফেলেছে পাশের বাড়িতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের। সাতের দশকে মাসিক রোমাঞ্চ পত্রিকার পাতায় দেখা দিল মনোজ সেনের সৃষ্ট আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ দময়ন্তী। সে ইতিহাসের অধ্যাপিকা, উপরন্তু বিবাহিতা। বছর তিরিশ আগেও গোয়েন্দাগিরিকে বেছে নিয়ে ‘নারীধর্ম গৃহধর্ম’ পালন না করার দরুন কৃষ্ণা বা শিখাকে কম নিন্দা শুনতে হয়নি। দময়ন্তী সেই প্রেক্ষিতে চমকে দেওয়ার মতো ব্যতিক্রম। তার উত্তরসূরি রূপে নয়ের দশকের মাঝামাঝি উপস্থিত হল তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গার্গী। অঙ্কের মেধাবী ছাত্রী গার্গী প্রথমে থাকত দাদা-বউদির পরিবারে, পরে ‘ঈর্ষার সবুজ চোখ’ উপন্যাসে ভগ্নীপতি সায়ন চৌধুরীকে বধূহত্যার অভিযোগ থেকে মুক্ত করে সে এবং ঘটনাচক্রে বিবাহ করে তাকে। শিল্পপতি সায়নের কোম্পানির ডিরেক্টর গার্গীর রহস্য উন্মোচনের কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে লেখক বুনে দেন ননদ ও সহকারী সোনালিচাঁপা এবং ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে গার্গীর সংসারের ছবিও। সংসার আর পেশাকে চমৎকার সামলাতে পেরেছে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের পেশাদার গোয়েন্দা, ‘থার্ড আই’-এর কর্ণধার প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি ওরফে মিতিনমাসিও। সাম্প্রতিক কালে দেবারতি মুখোপাধ্যায় লিখেছেন মেয়ে গোয়েন্দা রুদ্রাণীর রহস্য সমাধানের কাহিনি, তার সহকারী এবং জীবনসঙ্গী প্রিয়ম। পারমিতা ঘোষ মজুমদারের গোয়েন্দা চরিত্র ইকনমিক্সের ছাত্রী ও প্রাক্তন সাংবাদিক রঞ্জাবতী মজুমদার অবিবাহিত, কিন্তু বন্ধু ও সহকারী লাজবন্তীর পরিবারকেই সে আপন করে নিয়েছে। এমন বেঁধে বেঁধে থাকার ছবিই দেখা গিয়েছিল ছয়ের দশকে চার মেয়ে গোয়েন্দাকে নিয়ে নলিনী দাশ-এর কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা গণ্ডালু সিরিজে। এককভাবে গোয়েন্দাগিরি নয়, এই সিরিজের মূল ইউএসপি হয়ে উঠেছিল চারটি মেয়ের বন্ধুত্বের জোর। মেয়ে গোয়েন্দাদের এই পরম্পরায় বুদ্ধির পাশাপাশি উপস্থিত নারীসুলভ মানবিকতার স্পর্শ, বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি সহমর্মিতার বোধ। সে কারণেই কৃষ্ণা বলে— ‘মেয়েদের বিপদে মেয়েরা না দেখলে কে দেখবে বলো?’ তেমনই ‘প্রেম’ গল্পে যে পদ্মিনী খুন হয়ে যাওয়ার পর তকমা পেয়েছিল নিম্ফোম্যানিয়াক ব্যাভিচারিণীর, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার মনোবিশ্লেষণই হয়ে ওঠে দময়ন্তীর রহস্যভেদের চাবিকাঠি।
আর-এক পদ্মিনী। ভিক্টিম নয়, অপরাধী। প্রথম খুন, পুরোনো দিনের এক অভিনেত্রী। দ্বিতীয় খুন, এক হেয়ারড্রেসার। তৃতীয় খুন, থুড়ি, খুনের চেষ্টা এক সাংবাদিককে। এককালে রুপোলি পর্দা কাঁপানো মহানায়িকার এহেন মতিভ্রম কেন হঠাৎ? এখানেও আলোর দিশা দেখাল মনের অন্ধকারই। দময়ন্তীর মতো ঘরে বসেই রহস্যের জট ছাড়ালেন যিনি, তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন বহুদিন আগে। রেঁধে বেড়ে, পোষা বেড়াল আর টেলিভিশন নিয়েই দিন কাটত তাঁর। কিন্তু মাথা খাটিয়ে আস্ত একটা রহস্যের গোড়ার কথা যে তিনি বুঝে ফেলতে পারেন, পড়ে-পাওয়া-চোদ্দো-আনা সুযোগটা না এলে তিনি তা জানতেন কেমন করে! ‘শুভ মহরৎ’ সিনেমার রাঙাপিসিমার মতো অনেক মেয়েরই যে এমন ঘরোয়া গোয়েন্দাগিরির অভ্যাস, আগেই বলেছি, পুরোনো সাহিত্যে তার ইঙ্গিত ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। কিন্তু মেয়েরা বুদ্ধিহীন, এই প্রচলিত মিথের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের প্রাথমিক প্লটনির্মাণ। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে গোয়েন্দানীর আবির্ভাব একদিকে সেই পুরোনো অবজ্ঞার সপাট জবাব। আরেকদিকে সৃষ্টিশীল পুরুষের একলা থাকার উন্নাসিক মুদ্রাদোষ পুরুষ গোয়েন্দাদের যে নিঃসঙ্গ জগতে ঠাঁই দিয়েছিল, তার বিপরীতে পরিবার-পেশা-প্যাশনকে একসঙ্গে সামলে ভালোবাসা ঘেরা এক পৃথিবী গড়ে দিয়েছেন ‘মাল্টিটাস্কার’ মেয়ে গোয়েন্দারা। সেও বড়ো কম কথা নয়!