ডিএনএ যখন ডিটেকটিভ
১.লিন্ডা ম্যান। বয়স এই আজ পনের হল। লেইসেস্টারশায়ার-এর তীব্র ঠাণ্ডা ভেদ করে বাড়ি ফিরছিল সে। প্রথমবার বন্ধুদের সঙ্গে জন্মদিনের পার্টি, তাই সেই আসর ভেঙে বেরতেও ইচ্ছে করছিল না। কাজেই রাত বেড়েছে বেশ। নাইট-আউটে অবশ্য সায় ছিল না ওর মা-বাবার। তবু এটুকু স্বাধীনতার স্বাদই জন্মদিনের সেরা উপহার ওর কাছে। পরের বছর সে অপ্রাপ্তিও আর থাকবে না বোধ হয়। বাড়ির কাছাকাছি এসে কেমন একটা অস্বস্তি ছেঁকে ধরল ওকে। কেউ কি follow করছে? একবার পিছনে আড়চোখে তাকিয়ে একটা অন্ধকার ছায়া ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। দ্রুত পা চালাল ও। পিছনের ছায়াটারও গতিবেগ বেড়ে গেল যেন। এবার দৌড়... খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে... বাড়ি আর মাত্র চারশো গজ। ফুটপাথ ছেড়ে অন্ধকার মাঠের মধ্যে দৌড়তে গিয়ে আছড়ে পড়ল লিন্ডা।
দিনটা ছিল ২১ শে নভেম্বর, ১৯৮৩। লিন্ডা সেদিন রাতে বাড়ি ফেরেনি। হন্যে হয়ে খোঁজ শুরু করেন লিন্ডার বাবা। উদ্বিগ্ন বোন আর মা ঘরে অপেক্ষা করছেন। শেষমেশ খারাপ কিছু সন্দেহ করে খবর গেল পুলিশে। পরদিনই ব্ল্যাক প্যাড নামে, এক নির্জন ফুটপাথের পাশে ঝোপের আড়াল থেকে উদ্ধার হল লিন্ডার বিবস্ত্র দেহ, গলায় নিজেরই স্কার্ফ দিয়ে ফাঁস জড়ানো রয়েছে তখনও, জামায় লেগে রয়েছে বীর্যের দাগ।
ডেভিড বেকার। গোয়েন্দা বিভাগের তৎকালীন প্রধান। মাটি কামড়ে জোগাড় করলেন সমস্ত প্রমাণ, ইন্টারভিউ নিলেন স্থানীয়দের, খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হল, এমনকি লিন্ডার মা-বাবাও ক্যামেরার সামনে সকলের কাছে আবেদন জানালেন পুলিশকে যেকোন রকম তথ্য দিয়ে সহায়তা করার। কিন্তু সাড়া মিলল না। অন্তত যেমন সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগে অপরাধীকে অভিযুক্ত করা যায় তেমন কিছু তো নয়ই। যেটুকু circumstantial evidence পাওয়া গেল, তাতে অপরাধের ধরন সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেলেও, অপরাধীর খোঁজ দেবে কে? শুধু অভিজ্ঞ বেকার বুঝলেন, এ কাজ কেবল মাত্র স্থানীয় কারো পক্ষেই সম্ভব। এছাড়া পড়ে থাকা বীর্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেল, সেটি A ব্লাড গ্রুপের কোনও মানুষের এবং স্পার্ম কাউন্ট বেশি থাকায়, তিরিশ বছরের কম বয়সি কেউ এ কাজ করেছে বলেই স্থির বিশ্বাস হল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের। ব্যাস, এটুকুই। বাকিটা শুধু হতাশারই গল্প। ধরা পড়া তো দূর অস্ত, সন্দেহভাজনদের কোনও তালিকা পর্যন্ত তৈরি করতে পারেননি বেকার। অন্য সমস্ত মামলার চেয়ে এইটি যেন তাঁকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছিল। এটুকু জানতেন, হয় তিনি এই ধর্ষক তথা খুনিকে খুঁজে বার করবেন, অথবা আরেকটি এমনই নৃশংস অপরাধ ঘটে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকবেন।
২.অ্যালেক জেফ্রি। লেইসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্সের প্রফেসর। তাঁর ক্লাস করার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে ছাত্ররা। প্রফেসর সারাদিন ওই ল্যাবে পড়ে থাকেন, আর একটি লাল আলো জ্বলা ঘরে কিছু একটা করতে থাকেন। গবেষণার নেশায় কখনও ভুলে যান মেয়ের স্কুল ড্রামায় উপস্থিত থাকার প্রতিজ্ঞার কথা, কিম্বা স্ত্রী-র সঙ্গে বেরনোর প্ল্যান। কিন্তু কী নিয়ে এই পাগলামি জেফ্রির? ডিএনএ বিষয়টা যতটা জটিল, জেফ্রি ততটা মনে করেন না। আসলে আমাদের মানুষ প্রজাতিটার ৯৯.৫% ডিএনএ একেবারে একরকম। বলা যেতে পারে ওইটেই আমাদের অমানুষ হওয়া থেকে রক্ষা করে আসছে। কিন্তু একই প্রজাতির দুজন পৃথক জীবকে কি ডিএনএ দিয়ে আলাদা করা যায়? সম্ভব? জেফ্রি তখন এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে ওই ০.৫% ডিএনএ-দের নিয়ে পড়েছিলেন। চেষ্টা করছিলেন কোনও প্যাটার্ন খোঁজার। তিনি দেখলেন ডিএনএ-র কিছু অংশে একই প্যাটার্ন বারবার ফিরে আসছে। এবং এই রিপিট কতবার হবে তাও ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়ে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে জেফ্রি বলছেন, ধরা যাক কারোর ডিএনএ-তে লেখা রয়েছে ‘Mary had A little lamb’ ( অবাক হবেন না। এমনভাবে না হলেও আমাদের ডিএনএ-তে সাংকেতিকভাবে প্রোটিন বা উৎসেচক তৈরি হওয়ার কিছু নির্দেশ আপাত-দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা থাকে, যাকে জেনেটিক কোড বলে। জেফ্রি সেটিই সহজ করে বলছিলেন)। হয়তো সেই একই কথা আরেকজনের ডিএনএ-তে লেখা আছে ‘Mary had AAA little lamb’, কিম্বা ‘Mary had AAAAAAA little lamb’। ফলে, এই যে রিপিট হওয়ার একটা প্যাটার্ন জেফ্রি খুঁজে পেলেন, সেটাই দেখা গেল ব্যক্তিবিশেষে অদ্বিতীয়। এর নাম হল ‘short tandem repeats’ বা সংক্ষেপে STR। কিন্তু যখনই জেফ্রি ডিএনএ ভেঙে এই প্যাটার্নগুলোকে নিয়ে গবেষণা করতে চান, কিছুতেই আর সুস্পষ্টভাবে ডিএনএ-কে ভাঙতে পারেন না। ওই লাল ঘরে x-ray crystallography করে এক-একটা প্লেট বের করেন, আর ‘কিছুই হচ্ছে না’ বলে ডাস্টবিনে চালান করেন। মাঝে মাঝে ছাত্রদের সামনে বলে ওঠেন ‘failure is the pillar of...’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষে সত্যিই যদিও সাফল্য এসেছিল, এবং জেফ্রি ইউরেকা বলে চারদিকে এক পাক ঘুরেও নিয়েছিলেন আনন্দে। তারপর বলেছিলেন ‘দশই সেপ্টেম্বর, তিনি শশো চুরাশি, সকাল নটা বেজে পাঁচ মিনিট...’ পরপর দুবার।
হদিশ মিলেছিল মানুষের এক অদ্বিতীয় চিহ্নের, অনেকটা fingerprint-এর মতো! অতএব, ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪, সকাল নটা বেজে পাঁচ মিনিটে আদতে আবিষ্কার হয়েছিল বিশ্বের প্রথম জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট! কার ছিল এই প্রিন্ট? জেফ্রির ল্যাবের সহকারী, তার মা-বাবা, একটি সিল, গরু আর তামাক গাছের ডিএনএ---বারকোডের মতো পাশাপাশি ফুটে উঠেছিল আমাদের অনন্য এই চিহ্নের ছবি, হাতের মুঠোয় ধরা এক ফালি পাতায়। জেফ্রি তখন এও দেখলেন, তাঁর ল্যাবের সহকারীর ডিএনএ-র কিছু অংশ মিলে যাচ্ছে তার বাবার ডিএনএ-র প্যাটার্নের সঙ্গে, আর কিছু অংশের সঙ্গে মিল রয়েছে তার মায়ের। অর্থাৎ আমাদের দেহে, বাবা-মা উভয়ের জিনের প্যাটার্নই সহাবস্থানে থাকে---এইটিই হল আজকের paternity টেস্টের একেবারে আদি থিওরি।
৩.৩১শে জুলাই, ১৯৮৬। ডেভিড বেকার তখনও গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। লিন্ডার কেসটা তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে এক দগদগে ঘায়ের মতো লেগে আছে আজও। নারবরো (Narborough) বলে লেইসেস্টার-এরই এক ছোট জনপদ। সেখান থেকে খবর এল এক নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির। সেও কাকতালীয়ভাবে পনের বছরের এক কিশোরী। ডন অ্যাশওয়ার্থ। দিনের আলোতেই বেরিয়েছিল সে। কিন্তু রাত গড়িয়ে গেলেও ফেরেনি। প্রমাদ গুনলেন বেকার। ঠিক যে ভয়টা পেয়েছিলেন, তাহলে কি... বেশি দূর না ভেবে, সার্চ পার্টি তৈরি করলেন। আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। টানা দুদিন ধরে ক্লান্ত হয়ে খোঁজ চালানোর পর, বেকারের আশঙ্কা সত্যি হল। টেন পাউন্ড লেনের পাশে নির্জন ঝোপের আড়ালে পাওয়া গেল, অ্যাশওয়ার্থের ধর্ষিত, অর্ধনগ্ন মৃতদেহ। বারবার হেরে যেতে যেতেও হাল ছেড়ে দিতে জীবনে শেখেননি বেকার। সেজন্যেই বোধহয় এবারে ভাগ্য কিঞ্চিৎ সহায় হল তাঁর। এক অফিসার এসে খবর দিলেন সম্ভাব্য এক সন্দেহভাজনের। সতের বছর বয়সি রিচার্ড বার্কল্যান্ড। তাকে ওই অঞ্চলে খুনের সময়ে বাইক নিয়ে যেতে দেখেছেন বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শী। শুধু তাই নয়, এই খোঁজ চলাকালীন রিচার্ড এসে একবার এও বলেছিল, ‘আপনারা ভুল জায়গায় খুঁজছেন’। এমনকি, যেদিন দেহ উদ্ধার হয়, সেদিনও ওই স্থানে এসে রিচার্ড বলে যায়, ‘আগেই বলেছিলাম, ভুল জায়গায় খুঁজছেন’। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহের কূলকিনারা না পাওয়া বুভুক্ষু পুলিশ আধিকারিকদের আর কীই বা করার থাকতে পারে। রিচার্ডকে সোজা বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে এনে ঢোকান হল ইন্টারোগেশন রুমে। কখনও সে মেনে নেয় ডনের মৃত্যুর দায়, আবার পরমুহূর্তেই সব বেবাক ভুলে অস্বীকার করে অপরাধের কথা। দুঁদে গোয়েন্দাদের প্রশ্নবাণে বিরক্ত, ক্লান্ত হয়ে শেষে স্থাণুর মতো বসে রইল রিচার্ড। সে সময় ঘরে ঢুকলেন বেকার, যিনি এতক্ষণ ধরে কাচের আড়াল থেকে সমস্ত দেখছিলেন। শান্ত হয়ে বললেন, - রিচার্ড, তুমি কি দেখেছিলে ডনকে সেদিন?-হ্যাঁচেয়ারটা সরিয়ে পাশে বসলেন রিচার্ডের। বললেন, - আমি জানি তুমি একজন ভালো মানুষ রিচার্ড... আর তুমি এটা করতেও চাওনি। -ডনকে আমি পেতে চেয়েছিলাম। শরীর দিয়ে। ডন চায়নি। -তারপর?-আমি ওকে টেনে নিয়ে যাই। ট্রাউজারটা নামিয়ে দিই। ও চিৎকার করে। -হুম?-তারপর... I gave her what she deserved.বেকার আর কোন কথা বলেননি। ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিলেন। বাকি আধিকারিকরা রিচার্ডকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে যখন ওঁর ঘরে গেলেন, দেখলেন বেকার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন দেওয়ালে নারবরো-র ম্যাপটার দিকে। -স্প্লেনডিড স্যার।বেকার শুধু গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ঘটনার দিন ডন কোনও ট্রাউজার পরে বেরোয়নি...’
৪.জেফ্রি ততদিনে বেশ পরিচিত নাম। তাঁর গবেষণা ছাপা হয়ে গেছে সুবিখ্যাত জার্নালে। ‘দি গার্ডিয়ান’ ফলাও করে ছেপেছে তাঁর কাহিনি। এর মধ্যে এক যুবকের মায়ের পরিচয় নিয়ে কোর্টে একটি কেস ওঠে। এক ভদ্রমহিলা এক যুবকের মা বলে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু কোর্টের কাছে সেই মাতৃত্ব প্রমাণ করা যে বেশ কঠিন হয়ে উঠছে। এদিকে, প্রমাণ না পেলে সেই বিদেশি কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে শুধু মা নয়, এই দেশ ছেড়েই চলে যেতে হবে হয়তো। উকিলেরা পরামর্শ করে হাজির হলেন অ্যালেক জেফ্রির কাছে। মা এবং সেই যুবকের রক্তের নমুনা থেকে ডিএনএ বের করে একই পদ্ধতি প্রয়োগ করলেন জেফ্রি। ফুটে উঠল, মা-ছেলের দ্ব্যর্থহীন পরিচয়। আশ্চর্যজনকভাবে, অপেক্ষাকৃত নতুন, অচেনা পদ্ধতি হলেও আদালত কিন্তু জেফ্রির এই পরীক্ষাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছিল। সে কথাও খবর হয়ে বেরিয়েছিল তৎকালীন পত্রিকায়। সৌভাগ্যক্রমে তা নজরে পড়ে যায় বেকারের। স্থানীয় এক বিজ্ঞানীর এহেন সাফল্যের পাশাপাশি এই নতুন পদ্ধতির ক্ষমতা সম্বন্ধেও দূরদর্শী বেকারের আঁচ পেতে দেরি হল না। অপরাধবিজ্ঞানে এ জিনিস যে প্রায় বিপ্লব এনে দিতে পারে, তার খানিক আভাস হয়তো তিনি পেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন লেইসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাদা ল্যাব কোটে ইতিনি ভার্সিটির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আপন মনে সিগারেট খাচ্ছিলেন জেফ্রি। গোয়েন্দা-প্রধানের পরিচয় পেয়ে হকচকিয়ে গেলেন খানিক। অবশেষে আলাপ গড়াল কাজের কথায়। জেফ্রি আত্মমগ্ন গবেষক হলেও নিজের চেনা শহরে ঘটে যাওয়া এই অপরাধগুলো সম্বন্ধে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন। বেকার তাই সময় নষ্ট না করে শুধু বললেন, এই ছেলেটির সঙ্গে লিন্ডার খুনের কোন সম্পর্ক আছে কি না, তা তিনি নিশ্চিতভাবে জানতে চান। জেরায় রিচার্ড, অ্যাশওয়ার্থের খুনের দায় নিলেও লিন্ডার খুনের বিষয় সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। আর সত্যি বলতে বছর তিনেক আগে রিচার্ডের বয়সও তো মাত্র চোদ্দ। সেই বয়সে এমন নৃশংস হত্যা? বেকারও মানতে পারছিলেন না। কিন্তু ধর্ষণ করে খুনের এই প্যাটার্ন যে দুই ক্ষেত্রেই একরকম। অগত্যা জেফ্রির দ্বারস্থ হওয়া। কিন্তু, নমুনা? বেকার বললেন, আছে। লিন্ডার জামা কাপড়ে লেগে থাকা বীর্য। -কিন্তু সে তো তিন বছর আগের!-তাতে কি এই পরীক্ষা করা যাবে না?এ প্রশ্নের উত্তর তর্কাতীতভাবে জেফ্রির জানা ছিল না। কিন্তু কথা দিলেন, ওই নমুনা থেকেই ডিএনএ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন তিনি।
ঠিক এসময়েই পথ দেখালেন জেফ্রির সহকর্মী পিটার গিল, যিনি এখন নরওয়েতে ফরেন্সিক জেনেটিক্সের একজন প্রফেসর। দুটো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন গিল সেই সময়ে---১) পুরনো দাগ (stain) থেকে ডিএনএ বের করার (extraction) পদ্ধতি এবং ২) বীর্য মিশ্রিত যোনিরস (vaginal swab) থেকে স্পার্মের নিউক্লিয়াস তথা ডিএনএ নিষ্কাশনের পদ্ধতি। এই দুই আবিষ্কারই কিন্তু ফরেন্সিক বিজ্ঞানকে এক লহমায় সাবালক করে তুলেছিল। সেই রাস্তা ধরে অবশেষে রিচার্ডের রক্তের সঙ্গে পুরনো ওই নমুনা মিলিয়ে দেখলেন জেফ্রি। বেকারের সন্দেহ এক্ষেত্রেও একেবারে নির্ভুল। এই দুজন, এক মানুষ নন। বেকার আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডনের দেহ থেকে পাওয়া বীর্যের নমুনার সঙ্গে রিচার্ডের ডিএনএ মিলিয়ে দেখতে চাইলেন। আর তখনই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। জেফ্রি নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে দিলেন দুই ক্ষেত্রেই যে বীর্য ভিক্টিমের দেহ থেকে পাওয়া গেছে, তা একই মানুষের এবং সে মানুষ কিছুতেই রিচার্ড হতে পারে না।
এই ছিল জেনেটিক্সের হাত ধরে প্রথম কোন নিরপরাধ-কে উদ্ধারের কাহিনি। আসলে ছোট থেকেই কিছু লার্নিং ডিজেবিলিটি থাকা রিচার্ডের অস্থির মনকে চারপাশে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডগুলো বড্ড বেশি প্রভাবিত করেছিল। বাস্তবের ভয়াবহতা থেকে নিজেকে আড়াল করতে গিয়ে, কল্পনায় আরও বেশি করে অন্ধকারকে জড়িয়ে ফেলেছিল রিচার্ড। এদিকে নিরপরাধকে মুক্তি দেওয়া তো হল, কিন্তু তাতে সঙ্কট বাড়ল বই তো কমল না! আসল অপরাধীকে ধরা দূরে থাক, তার পরিচয় যে তখনও অন্ধকারেই। ফলে সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কা অস্বীকার করার উপায় নেই।
৫.এরপরে লেইসেস্টার কাউন্টিতে যা হয়েছিল, তা এক অর্থে ঐতিহাসিক। যে বিজ্ঞান রিচার্ড বার্কল্যান্ড-কে মুক্তি দিয়েছে, সেই প্রযুক্তিই ধরিয়ে দেবে আসল লোকটাকে---এই ছিল লেইসেস্টার পুলিশ বিভাগের প্রতিজ্ঞা। ফরেন্সিক সায়েন্স সার্ভিসের (FSS) সহযোগিতায় লেইসেস্টার পুলিশ বিভাগ শুরু করল বিশ্বের প্রথম এবং তখনকার দিনের বৃহত্তম ডিএনএ লাইব্রেরি তৈরির কাজ। নিকটবর্তী অঞ্চলে যতগুলো পরিবার ছিল, সবার কাছে চিঠি চলে গেল এই মর্মে যে, ১৯৫৩ থেকে ১৯৭০ সালের ভিতর যেসব পুরুষের জন্ম এবং যারা কখনও না কখনও নারবরোতে থেকেছেন বা কাজের সূত্রে এসেছেন তারা যদি স্বেচ্ছায় কয়েক ফোঁটা রক্ত দিয়ে যান তাহলে এই মারাত্মক খুনিকে শনাক্ত করা একেবারে নিশ্চিত হবে। দুটো রক্তের কালেকশন সেন্টার খোলা হল, সপ্তাহের তিনটে দিন সকাল এবং সন্ধে---দুবেলা রক্ত নেওয়া হবে। প্রত্যেকের আইডি কার্ড যাচাই করে রক্তের স্যামপ্লিং শুরু হল। সাড়া মিলল ব্যাপক। যে দু-একজন ছুঁচে কিংবা পুলিশে ভয় বলে এড়িয়ে যেতে চাইছিল, তারাও শেষমেশ তীব্র সামাজিক চাপে নমুনা দিতে বাধ্য হল। দেশ-বিদেশের খবরের কাগজেও ছেপে বেরিয়েছিল এই রাজসূয় যজ্ঞের বিবরণ। বিপুল খরচ যেমন হয়েছিল, তেমনই নাওয়া-খাওয়ার পাট চুকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল জেফ্রির টিমের। আট মাসের মধ্যে নমুনা জমা পড়েছিল ৫,৫১১ টি।
অবশেষে কী হল? এই কি কাহিনির সমাপ্তি? ফিকশন হলে বোধ হয় তাই হত, কিন্তু ট্রুথ আবার ফিকশনের থেকেও বিপজ্জনক কিনা...। অতএব, বুঝতেই পারছেন, এত কিছুর পরেও একটি স্যাম্পেলও ম্যাচ করল না অপরাধীর জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে। ভস্মে ঘি? তা বলা যায় এক প্রকার...।
৬.কলিন পিচফর্ক। লেইসেস্টারের হ্যাম্পসায়ার বেকারির একজন কর্মচারী। অসাধারণ তার কেক তৈরির হাত। এই বেকারিতে কাজ করছে সে প্রায় দশ বছর হল। দোষের মধ্যে পিচফর্ক ছিল ভীষণ মুডি আর মহিলা সহকর্মী পেলে তার রসালাপ কিছুতেই শেষ হত না। এহেন পিচফর্কের যৌবনের শুরুতে কিছু বদভ্যাসও ছিল। যাকে বলে exhibitionism….। অর্থাৎ মহিলাদের সামনে নিজের গোপনাঙ্গ দেখানোর এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সে জন্য পুলিশের খাতায় তার নাম উঠে গেছিল সে বয়সেই। এক সময় মনোরোগের চিকিৎসাও চলে কার্লটন হাসপাতালে। সেসব অতীত পেরিয়ে পিচফর্ক এখন ঘোরতর সংসারী। বিয়ে করেছে একাশিতে। দুই সন্তানের পিতা সে এখন।
এই পিচফর্কের সহকর্মী আয়ান কেলি সেদিন লেইসেস্টারের এক পাবে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন জমিয়ে। দিনটা ছিল পয়লা আগস্ট, ১৯৮৭। ততদিনে সেই ডিএনএ যজ্ঞে ইতি পড়েছে। কেলি কথায় কথায় বলছিলেন কীভাবে কিছু এক্সট্রা টাকা উপার্জন করার জন্য পিচফর্কের হয়ে ব্লাড দিয়েছেন তিনি। পিচফর্ক যেহেতু পুলিশের কাছে অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত হয়ে আছে, তাই এইটুকু ফেভার সহকর্মী হিসেবে তার কাছে চেয়েছিল। কেলিও না করেননি। নিজের পাসপোর্টের ছবিতে কেলির ফটো সযত্নে লাগিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে, কেলিকে ব্লাড কালেকশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া কিংবা তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করা, সব দায়িত্বই পালন করেছিল পিচফর্ক। পেটের ভেতর মদ আর কেচ্ছার সহাবস্থান যেহেতু কোনোকালেই সম্ভব হয়নি, এক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত একজনকে বেরিয়ে আসতেই হল। মদের কথা জানি না, কিন্তু ছয় সপ্তাহের মধ্যে এই খবর পুলিশ বিভাগের কানে উঠল। ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭। প্রথমে কেলি আর তারপর পিচফর্ক-কে এনে তোলা হল থানায়। প্রথম খুনের তদন্তের সময় একবার পিচফর্ককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল বটে, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু মেলেনি। কিন্তু এবারে, বেকার আর দেরি করেননি। ডিএনএ-র নমুনা ল্যাবে পাঠিয়ে রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা না করেই সরাসরি জেরা শুরু করেছিলেন পিচফর্ককে।
অপরাধীর সাংবিধানিক অধিকার শুনিয়ে-টুনিয়ে দিয়ে বেকারের প্রথম প্রশ্ন ছিল, “কেন? ডন অ্যাশওয়ার্থ-ই কেন?”
“Opportunity” এক শব্দে উত্তর দিয়েছিল পিচফর্ক। “সেই সময়ে ও ওখানে ছিল, আমিও ওখানে ছিলাম...ব্যাস।”
এমনকি লিন্ডা ম্যান-কে খুন করার সময় কাছেই পার্ক করে রেখেছিল তার গাড়ি...ভেতরে শুয়েছিল তার চারমাসের শিশুপুত্র...ধর্ষণ এবং খুনের পর সন্তানের সঙ্গে একেবারে স্বাভাবিক ছন্দে বাড়ি ফিরে গেছিল সে। এই সাংঘাতিক লোকটি এরপর খুন এবং যৌন হেনস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছিল পুলিশকে।
ইতিমধ্যে জিনও তার খোলস থেকে বেরিয়ে এসে মেলে ধরেছিল সেই অদ্বিতীয় প্যাটার্ন। নিশ্চিত করেছিল পিচফর্ক-ই আসলে লিন্ডা এবং ডনের খুনি। কোর্টে পিচফর্ক-কে একজন ‘extremely dangerous person’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বলা হয় পিচফর্ক আসলে psychopathic personality disorder (with serious psychosexual pathology)-এর শিকার। যাবজ্জীবন কারাবাস হয় তার। তখনকার নিয়মে তিরিশ বছরের।
এখানে এসেই একাকার হয়ে যান অ্যালেক জেফ্রি, পিটার গিল, ডেভিড বেকার। অপরাধের গল্প মিশে যায় আবিষ্কারের গল্পে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিটেই গড়ে ওঠে জেনেটিক্সের শৈশব। পরবর্তী তিরিশ বছরে অপরাধী সন্দেহে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়ে গেছে। দেশে দেশে তৈরি হয়ে গেছে ডিএনএ-র ডেটাবেস। ডিএনএ মিলিয়ে খুঁজে পাওয়া গেছে, ১৯১৮ সালে খুন হয়ে যাওয়া রাশিয়ার শেষ জাঁরের দেহাবশেষ, অন্তত সতের জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি মুক্ত হয়েছে কেবল ডিএনএ-র জোরে, ব্রাজিলের এক কবরখানা থেকে উদ্ধার হওয়া ফিমার অস্থি যে আসলে নাৎসি জার্মানির কুখ্যাত অফিসার জোসেফ মেঙ্গেলের সেও জানা গেছে এই ফিঙ্গারপ্রিন্টের দৌলতে...। আর এই সমস্ত কিছুর শুরুয়াত হয়েছিল পিচফর্কের কনভিকশনের মাধ্যমেই।
তারপর? সেই পিচফর্ক কি এখনও বেঁচে?
আজ্ঞে হ্যাঁ...বন্দি এবং জীবিত। শুধু তাই নয়, পিচফর্ক নাকি জেলে ভীষণ সভ্য একটা জীবন কাটিয়েছে। শিক্ষিত হয়ে জেলে বসেই ডিগ্রি অর্জন করেছে। ছাপানো গানের স্বরলিপিকে ব্রেইলে রূপান্তরিত করে ফেলার বিষয়ে সে এখন একজন স্পেশালিষ্ট। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর শেষে লিন্ডার মায়ের একটি উক্তি উল্লেখ না করলেই নয়। নিজের মেয়ের খুনি সম্পর্কে তিনি বলেন, ... “He may have a degree, but he is also a double child murderer and rapist. You can say he is a well-behaved prisoner, but don’t ever forget that he is a well-behaved double child killer.”
ওপরের কাহিনি তো ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের কিনারায় ডিএনএ-র নমুনা ব্যবহারের সাফল্যের গল্প। কিন্তু এ জাতীয় নমুনা থেকে অপরাধীকে ধরার চেষ্টা কি সবসময় নির্ভুল হয়? সিনেমা, টিভি-ওয়েবসিরিজে আমরা যে আকছার দেখি, অপরাধের সংঘটনস্থল থেকে ডিএনএ স্যাম্পেল পাওয়া গেল মানেই গোয়েন্দাদের অর্ধেক কাজ হাসিল, তার কতখানি সত্যি আর কতখানি শৈল্পিক অতিরঞ্জন? উত্তর পেতে গেলে চোখ রাখতে হবে প্রায় সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া আরও কিছু ঘটনায়। সে সব গল্পের ঝুলি না হয় খোলা যাবে অন্য কোনও দিন, অন্য কোনও সময়ে…।
.....................
#DNA #Detection #Genetic Fingerprint #silly পয়েন্ট