প্রহারের অপেক্ষা : এক চিকিৎসকের রোজনামচা
................
ধরা যাক, এক প্রৌঢ় রোগীকে নিয়ে তাঁর চার-পাঁচজন আত্মীয় ঢুকলেন এক হাসপাতালের এমারজেন্সিতে, যেমনটা প্রতিনিয়তই হয়ে থাকে জরুরি বিভাগে। বুকের ব্যথায় ছটফট করছেন ওই প্রৌঢ়। সঙ্গে সঙ্গে কর্মরত ডাক্তারের মনে খেলে গেল এক অদ্ভুত শখ! এই লোকটিকে মেরে ফেললে কেমন হয়? যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এমন এক ওষুধ খেতে দিলেন কিংবা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেহে পুরে দিলেন, যাতে ওই রোগী তৎক্ষণাৎ অক্কা পায়।
যথারীতি, রোগীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই রোগীর বাড়ির লোক ডাক্তারি শাস্ত্রের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারে, ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। এই রোগীকে ওই ওষুধ দেওয়া, তাকে মেরে ফেলারই সামিল। অতএব, ডাক্তারকে সবক শেখানো উচিত। আর সেই ডাক্তার কোনও এক অজ্ঞাত বাসনার দ্বারা চালিত হয়ে, রোগীকে মেরে ফেলে, তাঁর বিদ্বান আত্মীয়দের হাতে নিপীড়িত হবেন বলেই এক অদ্ভুত মর্ষকামী ব্যঙ্গে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, এবং অবশেষে বেধড়ক মার খেলেন।
কেমন লাগল গল্প, থুড়ি বাস্তবটা?
চিনতে অসুবিধে হচ্ছে?
তাহলে এই শিরোনামগুলো দেখুন তো চেনা ঠেকে কি না!
“ভুল ইঞ্জেকশনে রোগীর মৃত্যু, বেধড়ক মার ডাক্তারকে”
“ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু রোগীর, রণক্ষেত্র হাসপাতাল”
খবরের কাগজ খুললে আপনি কিন্তু রোজই এমন খবর পড়েন, শুধু ভাবেন না। যে-কোনো এমন অনভিপ্রেত ঘটনায়, দেখা যায়, ডাক্তারটিই সর্বদা কালপ্রিট। তাকে ধরে-বেঁধে হাতের সুখ করে নেওয়াই তখন জীবনের মূল মন্ত্র। বিগত এক সপ্তাহে সারা দেশ জুড়ে এমন একাধিক ঘটনা ঘটে চলেছে, (যা ভোটরঙ্গের আগেও ঘটত) যেখানে রোগীর পরিবার হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ডাক্তারের ঘাড়ে। সকলেরই দাবি, তাদের প্রিয়জনকে মেরে ফেলা হয়েছে ভুল চিকিৎসায়। যার অর্থ, হয় কর্তব্যরত ডাক্তার ডাক্তারিটুকু বিন্দুমাত্র জানেন না, কিংবা আগের ছবিটি অনুযায়ী আপন মনের অতৃপ্ত শখ পূরণ করার খাতিরে তিনি ইচ্ছে করে মেরে ফেলছেন রোগীকে।
যেহেতু যে-কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের দ্বিতীয় ধরনটিকে অবাস্তব মনে হতে বাধ্য, আমি তর্কের খাতিরে প্রথম সম্ভাবনাটিকে নিয়ে দু-চার কথা বলি।
আমি পেশায় ডাক্তার। চুল না পাকলেও, বিগত দশ বছর ধরে এই বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করার ফলে এটুকু বুঝেছি, এ যতখানি বিজ্ঞান, ততখানিই শিল্প! বিজ্ঞানটুকু শেখা যায়, কিন্তু শিল্প কে শেখাবে? এ তো তাবৎ সিলেবাস ঘেঁটে পাওয়ার নয়, জীবন (অথবা মৃত্যুর) থেকে ছেঁকে তোলার বিষয়।
আমাদের মানবশরীর ঠিক যন্ত্রের মতো নয়। তারও কলকব্জা রয়েছে, তাতে সময়ে সময়ে মরচেও ধরে। কিন্তু, তাকে সারিয়ে তোলার নির্যাস কেবল বিজ্ঞান নয়, তা শিল্পও বটে, যেমনটা বলেছি আগেই। এই শিল্পের খুঁটিনাটি সম্বন্ধে যে পাঠ, তা সম্পন্ন করা হয় সাড়ে চার বছরের এক দীর্ঘ যাত্রায়। অন্যান্য অধিকাংশ বিষয়ে স্নাতক হতে তিন বা চার বছর সময় লাগে। কিন্তু ডাক্তারির স্নাতক-যাত্রা শেষ হতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ বছর। সাড়ে চার বছরের অধীত বিদ্যা, আর শেষ এক বছরে রোগীর সঙ্গে কাটিয়ে যাওয়া অনন্ত সময়। কারণ, ডাক্তার তো শুধু রোগ সারান না, তাঁকে সারিয়ে তুলতে হয়, রোগীকে। যেহেতু রোগকে রোগীর থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব, কাজেই বিগত বছরগুলির রোগ সম্বন্ধীয় জ্ঞান, এবং তার সঙ্গে শেষ বছরে রোগীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গোয়েন্দা হিসেবে চোরাগোপ্তা হামলায় রোগকে পেড়ে ফেলা কিংবা মৃত্যুকে ফাঁকি দেওয়ার শিল্পের নামই ডাক্তারি।
এই শিল্পকলার মূল ভিত্তি বিজ্ঞান। কিন্তু ভুললে চলবে না, পৃথিবীর জন্মলগ্নের তুলনায় আধুনিক মানুষ এই সেদিনের জীব, আর তার বিজ্ঞানও এই সেদিনেরই। এখনও নিউরোসায়েন্সের অধিকাংশ রসায়ন আমাদের অধরা, মানবদেহের জটিলতার ভগ্নাংশ মাত্র করায়ত্ত হয়েছে আমাদের, আর সেইটুকু নিয়েই আমরা মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচিয়ে তুলছি দুরন্ত সব ওষুধের প্রয়োগে, কখনও বা জটিল হার্টের অপারেশন করে, কখনও মস্তিষ্কের ভিতরের বদরাগি টিউমারকে কেটে বাদ দিয়ে। মানুষের গড় আয়ুও বেড়ে গেছে অনেকখানি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা ডাক্তার। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। হয়তো এই জ্ঞান আমাদের সাহায্য করে কোনও একটি রোগের আগামী পরিণতি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আন্দাজ দিতে, কিন্তু রোগীর মৃত্যুকে আমরা নিখুঁতভাবে আগাম অনুমান করতে পারি না। কাজেই, যে তরুণ ডাক্তারটি সাড়ে পাঁচ বছরের জ্ঞান নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের পরিষেবা দিতে যাচ্ছে, তার প্রয়াস সত্ত্বেও মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যেতেই পারে কোনও এক রোগীকে।
এই মুহূর্তে সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে আছে এক হাজার সাতাশটির কাছাকাছি প্রাথমিক এবং ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, দুশো নব্বইটির কাছাকাছি গ্রামীণ হাসপাতাল। প্রতি বছর শুধু সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে বেরিয়ে আসছেন দুহাজারের বেশি ডাক্তার। কিন্তু, আজও একাধিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং গ্রামীণ হাসপাতালে ডাক্তারদের আকাল। যে-কোনো কোর্সের মতো ডাক্তারিতেও উচ্চশিক্ষা রয়েছে। স্নাতক পেরিয়ে, স্নাতকোত্তর বা স্পেশালিস্ট ডাক্তার, এমনকি তারও পরে সুপার-স্পেশালিস্ট ডাক্তাররাও তৈরি হচ্ছেন নিজ নিজ ক্ষেত্রের ট্রেনিং শেষ করে। কিন্তু, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বড়ো হাসপাতালে পোস্টিং হওয়াও অনিবার্য এবং স্বাভাবিক। তাই আরও অভিজ্ঞ, স্পেশালিস্ট ডাক্তারদের আকাল শহরের বাইরে স্বভাবতই বেশি। কাজেই, সমস্ত গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধরে রেখেছেন এই স্নাতক ডাক্তাররাই। আর এই সমস্ত ঘটনা তাঁদের আরও বেশি করে ভীত এবং জনবিমুখ করে তুলছে। আগে তো নিজের প্রাণরক্ষা, তারপরে তো অন্যের প্রাণ বাঁচানো! ফলাফল? অবধারিত... আরও বেশি শূন্যস্থান তৈরি, আরও বেশি ভীতি, এবং শেষমেশ দুরন্ত ডাক্তারি ছাত্রটির বিদেশ কিংবা দেশেরই কোনও বড় শহরের আপাত নিরাপদ ঘেরাটোপে, কনজিউমারিজম-এর বাহক হয়ে ওঠা। একে এক অর্থে ‘brain drain’ বললে খুব ভুল হবে কি?
এর ফলে ক্ষতি কার হচ্ছে বলতে পারেন? এত বিপুলসংখ্যক গ্রাম্য পপুলেশনকে পরিষেবা দেওয়ার ন্যূনতম কাঠামো যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে আদতে চাপ বাড়বে শহর এবং শহরতলির স্বাস্থ্যপরিষেবায়। হুড়মুড় করে এত রোগী সামলাতে নাভিশ্বাস উঠবে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের, অপ্রতুল হয়ে পড়বে ওষুধ এবং যাবতীয় সহযোগী পরিকাঠামো, ভোগান্তি বাড়বে বহু অর্থ ব্যয় করে কোনোরকমে শহরের হাসপাতালে ঠাঁই নেওয়া রোগী ও তার পরিজনের। যে অসন্তোষের শিখা আজ বিবিধ ঘটনায় দেদীপ্যমান, তাই-ই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে রোগী এবং ডাক্তার উভয়ের পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা, ভীতি, প্রতিহিংসা এবং অসম্মানের এক মিশ্র ঘূর্ণিতে... আমরা কি তাই-ই চাই?
যত আমরা একবিংশ শতকের আরও গভীরে ঢুকছি, ততই দ্রুত পালটে যাচ্ছে সমস্ত। হাতে গ্যাজেট আর পাতে ইন্টারনেটের দৌলতে, কখনও ফেক নিউজ, কখনও সাইবার বুলিয়িং-এ হাত পাকাচ্ছি আমরা। পাশাপাশি, পারিপার্শ্বিকের এই দ্রুত বদলে যাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নিতে গড়ে তুলছি নিশ্ছিদ্রভাবে আত্মসর্বস্ব এক-একটি ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ইউনিট। নিজস্ব বৃত্তের আত্মকেন্দ্রিকতা আর বহির্বিশ্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার দাম চুকিয়ে দিতে হচ্ছে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতার যাবতীয় মূল্যবোধ দিয়ে। এবং, এসবের ফলে, প্রতিকূলতাকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতাও হারাচ্ছে ক্রমশ। বিরোধিতা যে আদতে কালাপাহাড়ি ভাঙচুর নয়, বরং একটি গঠনমূলক প্রক্রিয়া, এই বোধ গড়ে না ওঠার দরুন অধৈর্যের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠছে “হাত থাকতে মুখে কেন?”-র শিল্প।
আরও পড়ুন : পেন, স্ক্যালপেল, LIFE (প্রথম কিস্তি) / ডাঃ ঋতঙ্কর পাত্র
পাড়ার যে সদ্য-পাশ-করা ডাক্তার ছেলেটির কাছে করোনাকালে উপদেশ চাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ হয় না, তারই সহকর্মী নিগৃহীত হলে, পাশে দাঁড়ানো তো দূর অস্ত, ডাক্তারের খামতি কিংবা অর্থলিপ্সার দোহাই দিতে আমরা সামান্যতম বিচলিত হই না। অথচ, প্রতি পেশাতেই অসৎ, দুর্বিনীত মানুষের পাশাপাশি ভদ্র, সমব্যথী মানুষেরাও তো থাকেন। হতেই পারে, আমার সঙ্গে ব্যাঙ্ককর্মীটি দুর্ব্যবহার করলেন, মুদির দোকানি আমাকেই বেছে বেছে ঠকিয়ে দিলেন, কিংবা পাসপোর্ট বের করতে গিয়ে আমাকেই ঘুষ দিতে হল পুলিশকে; কিন্তু এই সমস্ত ব্যক্তিভিত্তিক ঘটনাকে সমষ্টিগত করে তোলা কি অপরিণতমনস্কতা নয়? কবে আমরা খানিক সচেতন হয়ে, সমষ্টি থেকে ব্যক্তিকে আলাদা করে চিনে উঠব? একাধিক মানুষ আমাকে মাঝে মাঝে কোনও প্রেসক্রিপশন পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এই ডাক্তারবাবু যে ওষুধগুলো দিয়েছেন, একটু দেখে বলে দেবে, সব ঠিক আছে কি না! এককালের চূড়ান্ত সম্মাননীয় স্থান থেকে কবে ডাক্তাররা এমন এক অসম্মান, অবিশ্বাসের বাতাবরণে পৌঁছে গেলেন, বলুন তো? আর শুধু ডাক্তারই বা কেন! কয়েক বছর আগে পর্যন্তও যে শিক্ষকদের শাসন আমাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আমাদের অভিভাবকেরা তাকে শুভাকাঙ্ক্ষা বলে চিনতে ভুল করতেন না, সে সম্পর্কও কবে যেন অলীক হয়ে গেছে। দেনা-পাওনার দাঁড়িপাল্লায় মেপে যে-কোনো পেশাগত সম্পর্ককে যদি আমরা নিছক ব্যবসায়িক স্তরে নামিয়ে ফেলি, তবে সত্যিই আমাদের পাশ করার কোনও আশা থাকবে না। এভাবেই একের পর এক স্থগিত হয়ে যাওয়া পরীক্ষা অবয়বের দিকে দ্বন্দ্বমাখা প্রত্যয়ে তাকিয়ে আমরা বড়াই করব জ্ঞানের। সকলেই সমস্ত জানি, এবং এই অপরীক্ষিত, অর্ধসত্যই আমাদের সকল ক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার অধিকারী করে তুলবে, এমন ঢক্কানিনাদ ছুড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেব জীবনটুকু। আর তারপরে মরণ এলে তো পরবর্তী প্রজন্ম প্রস্তুত রইলই… সেই মুহূর্তেই স্বজনশোক ভুলে ডাক্তারের মতো অসুরকে সমূলে বিনাশ করার জন্য ওরা দ্বিধা করবে না বোধহয়...
কোনও এক ডাক্তারের ছোঁয়ায় ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকের কাছে নাহয়, এই প্রত্যাশাই থেকে যাক আমার...
.........................................