ভালোপাহাড় : বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে একটুকরো রূপকথা
উজাড় রুক্ষ প্রান্তরের মাঝে একজন মানুষের নিজে হাতে তৈরী করা এক পৃথিবী। একফালি অরণ্য, একটি গ্রাম, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, এই সব মিলিয়ে অন্য এক দুনিয়া যেন৷ নাম 'ভালোপাহাড়'৷ অদ্ভূত শান্তিতে ভরা একটি জায়গা৷ এখানে দিগন্তবিস্তৃত বনে-প্রান্তরে হারিয়ে যেতে কারো অনুমতি লাগেনা৷ স্কুলফেরৎ কচিকাঁচাগুলোকে মাঝেমধ্যে পাখির ঝাঁক বলে ভুল হয়৷ রূপকথা ছাড়া আর কী?
ভালোপাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্থান বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত বান্দোয়ান ব্লকে৷ ভালোপাহাড় মূলত একটি সংস্থা বা সোস্যাইটি, যাদের স্বপ্ন হল সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি, বাস্তুতন্ত্র এবং শিক্ষার সামগ্রিক বিকাশসাধন৷ স্বপ্ন মানবজমিনের উর্বরতা বৃদ্ধি করে, রোজ পরিমাণ মত সার-জল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের অনুভূতি আর কর্মোদ্যমগুলোকে৷কিন্তু সেই জমি প্রাণের পরশ পায় একমাত্র হৃদয়, আত্মা, কঠোর শ্রম এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞার এক অবিশ্বাস্য মিশেলে৷ এর ফর্মুলা জানতে হলে পরিচয় করতেই হবে ভালোপাহাড় সোস্যাইটির সঙ্গে, যার পুরোধা হলেন 'অরণ্যদেব' কমল চক্রবর্তী৷
বাংলা কবিতার পাঠকদের কাছে কমল চক্রবর্তী এক অতি পরিচিত নাম। কিন্তু তাঁর কবি- পরিচয়ের চেয়েও মহৎ পরিচয় - তিনি ভালোপাহাড়ের রূপকার। বহুদিন ধরে হওয়া অসুখে ভুগতে থাকা প্রকৃতি এখানে যেন হাওয়াবদলে এসেছে ওনার হাত ধরে৷ তাঁর শুশ্রুষায়, তাঁর নিজের হাতে রাঁধা পথ্য পেয়ে আবার তার সজীবতা ফিরে পেয়েছে প্রকৃতি৷ একজন মানুষ তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে, নিজে হাতে প্রায় ১.২ লক্ষ বৃক্ষরোপণ করে রীতিমত বশে এনেছেন পুরুলিয়ার রুক্ষ-অনুর্বর এক প্রান্তরকে৷ ওনার “জয় বৃক্ষনাথ” বাণীতে যেন মুখরিত হয়ে উঠেছে সেই প্রান্তর৷ ঘূর্ণিঝড়, দাবানল, ভূমিক্ষয়, মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন বৃক্ষচ্ছেদন, এই সবকিছুর মিলিত প্রভাবে আমরা যখন আমাদের বনভূমির একটি বিশাল অংশ হারাতে বসেছি, প্রকৃতি যখন প্রতিশোধপরায়ণ, তখন তার চোখে চোখ রেখে, আক্ষরিক অর্থে মাটি কামড়ে, প্রকৃতিরই ক্ষতে প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই ভালোপাহাড় সোস্যাইটির মানুষজন৷ আসল কথা হল, ওনারা ভবিষ্যৎকে যতদূর দেখতে পাচ্ছেন, আমরা আমাদের ক্ষীণদৃষ্টি দিয়ে হয়তো ততদূর দেখতে পাচ্ছিনা৷
এ তো গেল প্রকৃতির কথা, এবার আসা যাক সংস্কৃতির কথায়৷ বাংলার আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা অন্য অনেক অঞ্চলের মত পুরুলিয়ারও লোকসংস্কৃতি বিপন্ন৷ খাদ্য এবং অর্থের যুগপৎ অভাবের দরুণ জনজীবনের ছবিও তথৈবচ৷ অনুর্বর, রুক্ষ, শুষ্ক জমিতে চাষেরও উপায় নেই৷ ভালোপাহাড় সোস্যাইটি তাই বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে গ্রাম-সংলগ্ন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিকে চাষযোগ্য করে তুলতে বদ্ধপরিকর৷ ঠিক যেন সেই বিখ্যাত হলিউড ছবি 'The boy who harnessed the wind' এর উইলিয়াম নামের বালকটির মত, যে দুর্ভিক্ষের সময় একটি হাওয়াকল তৈরী করে বৃষ্টিকে বশে এনে গ্রামের জমিকে চাষযোগ্য করে তুলেছিল৷ এই কৃষি ও কৃষিনির্ভর বিকল্প জীবিকা এবং তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ এখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনের এবং এখানকার বিপন্ন লোকসংস্কৃতির কাছে মৃতসঞ্জীবনীর মতই প্রাণদায়ী৷ কারণ, জীবনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হলে তবেই বাঁচবে শিল্পকলা৷ বাঁচবে বাংলার প্রাচীন লোকশিল্প ছৌ-নৃত্য৷ এই লোকশিল্পগুলি যেন বাংলার এক-একটি স্নায়ুতন্তুর মত, এদের ছাড়া বাংলা যেন নিথর৷ তাই সেগুলির পুরুজ্জীবনের কাজে ভালোপাহাড় সোস্যাইটির এহেন উদ্যম প্রশংসার অবকাশ রাখে না৷
সঠিক শিক্ষার অভাব এবং নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা একটি জনজাতির সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায়৷ বলাই বাহুল্য, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে ভালোপাহাড় সোস্যাইটি নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে৷ ভালোপাহাড় সোস্যাইটির শিক্ষাপদ্ধতি অভিনব এবং ব্যতিক্রমীও বটে৷ ওঁরা মূলত “সামগ্রিক শিক্ষা” বা “Total education”-এ বিশ্বাসী৷ অর্থাৎ, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা-ই নয়, এই শিক্ষাপদ্ধতিতে পাশাপাশি চলে পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র, লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য ও সংরক্ষণ, গ্রামীণ উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর উন্নয়ন, এমনকি কৃষি ও কৃষিনির্ভর শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার পাঠ৷ এক কথায় এমন এক মুক্ত এবং সামগ্রিক শিক্ষাপদ্ধতি যা আমাদের কাছে স্বপ্নের মত৷ এখানকার ছোট ছোট আদিবাসী ছেলেমেয়েগুলি কমলবাবুর কাছে “ধরিত্রী-মায়ের বড় আদরের সন্তান”৷ তাই উনি তাদের সেই শিক্ষারই পাঠ দেন যেখানে তারা জননী বসুন্ধরার প্রতি চিরনত এবং চিরকৃতজ্ঞ থেকে তাঁকে সম্মান করতে এবং ভূষণভারে তাঁকে সাজিয়ে তুলতে শেখে৷
এখানে সোস্যাইটির তত্ত্বাবধানে চলে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও৷ গ্রামব্যপী স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রসার ঘটানো ছাড়াও যারা বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্যশিবিরের আয়োজন করে গ্রামবাসীদের সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করেন৷ শুধু তাই নয়, ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা প্রদানের যাবতীয় দায়িত্ব বহন করে থাকেন ভালোপাহাড় সোস্যাইটির মানুষজন৷ বর্তমানে এঁরা কিছু নতুন প্রকল্পেও কাজ করছেন, যেগুলোর মধ্যে সৌরশক্তির ব্যবহার, হর্টিকালচার বা উদ্যানপালন এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ এর ফলে কর্মসংস্থানের দিক থেকে এলাকার মানুষ নিঃসন্দেহে যথেষ্ট উপকৃত হবেন৷
এবছরের শুরুর দিকে কোনও এক রবিবারে ঝাড়খন্ড আর পুরুলিয়ার সীমানায় খুঁজে পেয়েছিলাম ভালোপাহাড়- কে৷ নামে “পাহাড়” থাকলেও, এখানে গিয়ে কিন্তু কোনো পাহাড় দেখতে পাবেন না৷ দরকারও নেই। পাহাড় মানেই যে সবসময় অল্টিচিউড বেশী হতে হবে এমন কোনও মানে নেই৷ এসব জায়গায় গেলে এমনিই বুঝবেন, আমরা যে পৃথিবীতে থাকি সেটি থেকে এগুলি অনেক অনেক উঁচুতে৷৷
[ ছবি : লেখক ]
#ভ্রমণ