নকশাল আন্দোলনের জন্য অস্ত্র যোগানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন উৎপল দত্ত
উৎপল দত্ত। মানুষটি বরাবরই খাপখোলা তলোয়ার। টিনের তলোয়ার নয়, সত্যিকারের ইস্পাতের ফলার মতো তাঁর ধার। নিজের থিয়েটার হোক বা রাজনৈতিক জীবন—সবখানেই তিনি স্পষ্টবক্তা। তাঁর থিয়েটার নিয়ে যেমন চর্চার শেষ নেই, তেমনই তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কও অন্তহীন। নিজেকে ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ বলতে তিনি দ্বিধা করেন না। থিয়েটার তাঁর কাছে দিন বদলের হাতিয়ার। সেই বিশ্বাস থেকেই একটা সময়ে প্রত্যক্ষভাবে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। শুধুমাত্র নৈতিক সমর্থন বা নাটক লিখে নয়, ছদ্মনামে অস্ত্রশস্ত্রের কনসাইনমেন্ট ডেলিভারির দায়িত্ব পর্যন্ত নিয়েছিলেন তিনি। যার পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর ‘Towards a Revolutionary Theatre’ গ্রন্থে।
সময়টা ১৯৬৭। নকশালবাড়ি অঞ্চলের প্রসাদুজোতে কৃষক রমণীদের উপর পুলিশের গুলিচালনার প্রতিবাদে উৎপল দত্ত লিখলেন ‘তীর’ নাটকটি। নকশাল নেতাদের সঙ্গে তাঁর তখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নামে জারি হল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। দু’মাস ধরে তিনি পুলিশের থেকে পালিয়ে বেড়ালেন। অবশ্য তার মাঝেই ছদ্মবেশে এসে তিনি ‘তীর’ নাটক প্রযোজনার ব্যবস্থাপনা করে দিয়ে গেছেন।
তারপরের ঘটনা সিনেমাকে হার মানায়। এই সময়েই তিনি আমেরিকান পরিচালক জেমস আইভরির ‘দ্য গুরু’ সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। কট্টর বামপন্থী, নকশাল আন্দোলনের সহযোদ্ধা উৎপল দত্ত কিনা ভিয়েতনাম আক্রমণকারী আমেরিকার বুর্জোয়া সিনেমায় কাজ করবেন! শুরু হল আরেকপ্রস্থ বিতর্ক। কিন্তু উৎপল দত্ত অনড়—তাঁর পরিস্কার যুক্তি তিনি একজন পেশাদার অভিনেতা এবং তাঁর সংসারে তখন হরিমটর অবস্থা। তাছাড়া আরেকটা বিপজ্জনক পরিকল্পনার সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন। বলা ভালো জড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল সিনেমার সূত্রে মুম্বই গিয়ে জনৈক ডিসিলভার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার থেকে অস্ত্রশস্ত্রের কনসাইনমেন্টগুলো ডেলিভারি নেবেন। ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ যখন দেশে আছড়েই পড়েছে তখন একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এটুকু কাজ করা তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে!
সেই অনুযায়ী এস. চৌধুরী ছদ্মনামে তিনি মুম্বই পৌঁছলেন। ডিসিলভার সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। প্রথম আলাপেই তিনি বুঝলেন ডিসিলভা কোনো বিপ্লবের পূজারী নয়, সে নেহাতই মুম্বই ডকের অস্ত্রের একজন স্মাগলার। যেটা তিনি বোঝেননি সেটা হল ডিসিলভাকে পুলিশই টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
পরপর দুবার পুলিশের হাত থেকে তিনি পালিয়ে বাঁচলেন। হোটেল বদলাতেও বাধ্য হলেন। আরেকবার তিনি মিটিংয়ে বসলেন ডিসিলভার সঙ্গে। মিটিং শেষ হতেই ডিসিলভা কোথায় লুকিয়ে পড়লেন তিনি টেরই পেলেন না। রুমে ফেরার জন্য হোটেলের লিফটে উঠতেই দুজন তাঁকে ঘিরে ফেলল। মুম্বই সিআইডি-র হাতে তিনি গ্রেপ্তার হলেন।
নাটক তখনও অনেকটাই বাকি। মুম্বই পুলিশের অধীনে জিজ্ঞাসাবাদ ও মারধোরের পর কড়া পাহারায় তাঁকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু মাঝরাস্তায় পুলিশকর্মীরা পান খাওয়ার জন্য দাঁড়ানোয় খানিকটা সময় নষ্ট হল। তারপর হঠাৎ করেই ‘গুরু’ সিনেমার লোকজন পুলিশের গাড়ি ঘিরে ধরল। দীর্ঘ বাকবিতন্ডার পর গাড়ি ছাড়া গেলেও ওইদিন আর প্লেন ধরা হল না।
পরদিন ভোরেই এয়ারপোর্ট। আর প্লেন কলকাতায় নামার সঙ্গে সঙ্গেই দমদম জেল। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। সিনেমার প্রযোজকরা এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। এখানেও আরেকপ্রস্থ বিতর্ক। শোনা যায় তিনি নাকি আর রাজনীতি করবেন না বলে মুচলেকা দেওয়ায় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। উৎপল দত্ত অবশ্য দাপটের সঙ্গে এসব ‘গুজব’কে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই তিনি নকশালদের সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর মনে হয়েছিল ‘পাতি-বুর্জোয়া’ উন্মাদনা থেকেই তিনি নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি ‘তীর’ নাটকটাকে তিনি ‘রাজনৈতিকভাবে ভুল’ বলেও দাবি করেছিলেন। নিজের অবস্থানের সমর্থনে মাও-জে-দং বা লেনিনের উদ্ধৃতি দিয়ে অসংখ্য যুক্তিও তুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু বিতর্ক থেকেই যায়। থেকে যায় অসংখ্য পরস্পর বিরোধিতা। মার্ক্সের ভাষার মতো সবকিছুকে ‘জীবনের দ্বান্দ্বিকতা’ বলে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। নকশাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পরপরই তাঁর দল ভেঙে যায়। মিনার্ভা মঞ্চও হাতছাড়া হয়। অবশ্য তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব এবং থিয়েটারি প্রতিভা দিয়ে সমস্ত অভিযোগকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। কিন্তু একদিকে নকশালপন্থা থেকে দূরত্ব, অন্যদিকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে ‘রটিয়ে দেওয়া’ মুচলেকা দেওয়ার গুজব। সব মিলিয়ে কিছুটা একাও হয়ে পড়েছিলেন কি? তারই প্রতিধ্বনি হয়তো শোনা যায় ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকের বেণীমাধবের সংলাপে- "আমি আসলে বড় একা। কেউই কখনো পাশে নেই। দেবতার মতন একা। অভিশাপের মতন, অবজ্ঞার মতন একা।"
..................
তথ্যসূত্র : Towards a Revolutionary Theatre- Utpal Dutta.