অপরাজিত ক্যারোলি
সব্যসাচী কথাটা বহুল ব্যবহৃত। তবু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে সব্যসাচী ছাড়া অন্য কোনও বিশেষণ সেভাবে ব্যবহারও করা যায় না। যার দু-হাতে সমান দক্ষতা সে-ই কি শুধু সব্যসাচী? নাকি যার মনের জোর আর নিটোল অধ্যবসায় এসে জমা হয় দুই বাহুতে তাঁকেই দেওয়া যায় এই তকমা? এমনই দোলাচলের ভেতর ট্রিগারে চাপ দেন ক্যারোলি ত্যাকাচ। কেঁপে ওঠে প্রতিবন্ধকতার পাহাড়…
ইউরোপ মহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত শহর বুদাপেস্ট। দানিয়ুব নদীর কিনার ঘেঁষে-থাকা শহরটিকে কুইন অফ দানিয়ুব বা দানিয়ুবের রানি বলেও চেনেন অনেকে। হাঙ্গেরির এই শহরেই ১৯৩৬ সাল নাগাদ এক যুবক যোগদান করলেন জাতীয় সেনাবাহিনীতে। কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইল অন্যত্র। পিস্তল হাতে পেলে সে যেন সবার অচিরেই হয়ে উঠত অর্জুন, লক্ষ্যভেদে যার জুড়ি মেলা ভার! তিনি ক্যারোলি ত্যাকাচ। কেবল বিশ্ব শ্যুটিংয়ের ইতিহাসে নয়, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে যিনি হয়ে উঠেছেন অফুরান প্রাণশক্তির অন্য নাম। তাঁর হার না মানা লড়াই হাজার হাজার মানুষের কাছে বয়ে এনেছে অনুপ্রেরণা।
ছেলেবেলা থেকেই শহরের বিভিন্ন অলিতে গলিতে ঘুরে খেলনা বন্দুক নিয়ে লক্ষ্যভেদের মুনশিয়ানায় শান দেওয়া ছিল ক্যারোলির নেশা। বুদাপেস্টের রাস্তায় ক্যারোলির প্র্যাকটিস চলত ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো জলের দিকে চেয়ে লক্ষ্য ঠিক করা, কখনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসে দৃষ্টি অবিচল রাখার প্র্যাকটিস। ওইটুকু বয়স থেকেই ক্যারোলি যেন জানতেন তাঁর ভবিতব্য। শ্যুটিংয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকেই ১৯৩৪ সাল নাগাদ ক্যারোলি যোগদান করলেন হাঙ্গেরির জাতীয় সেনাবাহিনীতে। এরপরেই বদলাতে শুরু করে ক্যারোলির জীবন। ১৯৩৬-এর সামার অলিম্পিক গেমস যোগদানের জন্য নিজেকে তিল তিল করে গড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তক্রমে তাঁকে দেওয়া হল না অলিম্পিকের টিকিট। তাতে ক্যারোলির জেদ যেন বেড়ে গেল দ্বিগুণ। সবার অচিরে একলব্যের মতো তাঁর সাধনা চলতে লাগল। পাখির চোখ করে নিলেন ১৯৪০-এর টোকিও অলিম্পিককে। ডেস্টিনেশান জাপান!
তবে এর মধ্যেই ঘটে গেল সেই ভয়ংকর ঘটনা। ক্যারোলির জীবনে দুর্যোগের ঘনঘটার এই শুরু। ১৯৩৮ সালে হাঙ্গেরির যুদ্ধের গ্রেনেড যেন মুহূর্তে চুরমার করে দিল ক্যারোলির সমস্ত স্বপ্ন। মহাকাব্যের একলব্যের মতোই তাঁর অব্যর্থ ডানহাতটি কেড়ে নিল সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। মেরুদণ্ড ভেঙে-দেওয়া শোক ঘিরে ধরতে চাইল ক্যারোলিকে।
নজরে থাকুকঃ
দ্রোগবা, ফুটবল ও একটি গৃহযুদ্ধের গল্প
কিন্তু তিনি ক্যারোলি ত্যাকাচ। ভেঙে পড়া নয়, বরং প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে জানেন ক্যারোলি। আর ঠিক সে জন্যেই হয়তো অলিম্পিকের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি ফের শুরু করলেন প্র্যাকটিস। এবার ডানহাতের বদলে নিজের দুর্বল অনভ্যস্ত বাঁ হাত। নিরলস সাধনায় আবার নিজেকে প্রস্তুত করলেন অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের জন্য।
কিন্তু ফের বিনা মেঘে বজ্রপাত। ১৯৪০-এ ক্যারোলির জীবনে নেমে এল আরও এক ভয়ংকর হতাশা। ১৯৪০ এবং ১৯৪৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের অস্থির পরিস্থিতিতে বাতিল হয়ে গেল অলিম্পিক গেমস। ক্যারোলির বয়স তখন তিরিশ। আসন্ন দুটি অলিম্পিক বাতিল হওয়ায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল হাঙ্গেরিবাসীর উদ্দীপনা। আর ক্যারোলি স্বয়ং ভেঙে পড়লেন নিজের ভেতর। নিজেকে বন্দি করে রাখলেন ঘরে।
বাইরের দুনিয়া যখন একটু একটু করে ম্লান করে ফেলেছে ক্যারোলির নাম, ঠিক সেই সময়ই এল মাহেন্দ্রক্ষণ। সবাইকে চমকে দিয়ে আটত্রিশ বছর বয়সে ১৯৪৮-এর লণ্ডন অলিম্পিক গেমসে যোগদান করলেন শ্যুটিং-এর জাদুকর। এবং আবির্ভাবেই আর্জেন্টিনার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্যুটার কার্লোস ডিয়াজ-কে পরাস্ত করে জিতে নিলেন সোনার পদক। ইভেন্টের আগে ডিয়াজের এক প্রশ্নে মশকরা করে ক্যারোলি বলেছিলেন – ‘এই বয়সে নতুন করে পাওয়ার কিছু নেই, আমি শিখতে এসেছিমাত্র।’ আসলে চ্যাম্পিয়ানরা এমনই হন। ক্যারোলির জেদ যেন ভেঙে দিচ্ছিল প্রতিকূলতার এক-একটা ব্যারিকেড। এখানেই শ্যুটার থেকে তিনি ক্রমে হয়ে উঠছিলেন এক কিংবদন্তি। এক অনুপ্রেরণা।
১৯৫২ সালের সামার অলিম্পিকে ফের দেখা গেল ক্যারোলির ঐশ্বরিক প্রতিভার বিচ্ছুরণ। তাঁর অদম্য লড়াই। পঁচিশ মিটার পিস্তল শ্যুটিং বিভাগে তাবড় তাবড় তরুণ তুর্কিদের পিছনে ফেলে ফের সোনা জিতলেন ক্যারোলি। সেদিন গোটা দুনিয়া যেন মাথা উঁচু করে দেখেছিল এক অকুতোভয় সৈনিককে, তাঁর অদম্য প্রাণশক্তিকে। ১৯৫৮-র আই.এস.এস.এফ বিশ্বচ্যাম্পিয়ানশিপে শেষবার ক্যারোলি ব্রোঞ্জ জিতলেন।
অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসের ঝুলি ভরে আছে অজস্র ঘটনায়, সময়ের পরতে পরতে বিশ্বক্রীড়ার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতায় তৈরি হয়েছে স্মরণীয় সব রেকর্ড। ক্যারোলি ত্যাকাচ তার ব্যতিক্রম নন, বরং ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়া সমস্ত মানুষকে নতুন করে বাঁচার পথ দেখিয়ে চলেছেন তিনি। তাই তো অলিম্পিক গেমসের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে তাকালে এখনও মনে পড়ে ক্যারোলির সেই উক্তি –‘আই হ্যাভ কাম হিয়ার জাস্ট টু লার্ণ...’
হেরে যাওয়া বলে আদতে কিছু হয় না। এক লড়াই থেকে জন্ম নেয় পরের লড়াই। আর প্রতিটি লড়াইয়ের দুটো ফলাফল। হয় জেতা, নয়তো শেখা। ক্যারোলি বারে বারে শিখেছেন এই উঠে দাঁড়ানোর মন্ত্র, বারে বারে ধাক্কা খেয়েও প্রতিকূলতাকে জয় করার আশ্চর্য ফর্মুলা…
#ক্যারোলি টাকাস #খেলা #ফিচার #অর্পণ গুপ্ত