টাইকো, কেপলার আর হ্যামলেটের ‘অনুপ্রেরণা’
রাজার কাছে দরবার করে পেয়েছিলেন আস্ত একটা দ্বীপ আর অজস্র সুযোগ-সুবিধা। সেই দ্বীপেই মানমন্দির গড়ে জীবনের অনেকটা সময়, প্রায় কুড়ি বছর যন্ত্রপাতি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারাদের অবস্থান মাপজোক করেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১), ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ এক জ্যোতির্বিদ। টেলিস্কোপ আবিষ্কার না হওয়া সেই যুগে টাইকো ব্রাহের খালি চোখে ওইভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে সাতশোরও বেশি তারার বছরের বিভিন্ন সময়কালের অবস্থানজনিত তথ্য সংগ্রহ করা আর সেগুলোকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সঞ্চিত করা, এ বড় সহজ কাজ নয়। কিন্তু টাইকোর সুখের দিন রইল না আর, যখন সে দেশের রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের মৃত্যু হল একদিন, আর রাজপুত্র চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ান সিংহাসনে বসে টাইকোকে দিলেন ঘাড়ধাক্কা। না আক্ষরিক অর্থে না; তবে হাতে না মেরে ভাতে মারবার এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করার জন্য ভগ্নহৃদয় টাইকো ডেনমার্ক ছেড়ে চলে গেলেন প্রাগে, আশ্রয় নিলেন সে দেশের রোমান রাজার কাছে। কিন্তু সেখানেও তাঁর বেশিদিন নভোঃদর্শক হয়ে থাকা হল না, একদিন পানাহারের আসরে অত্যাধিক মদ্যপান করে অসুস্থ বোধ করলেন, আর এগারো দিন একটানা জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করে চোখ বুজলেন মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে।
টাইকোর মৃত্যুর পরেই তাঁর অতদিন ধরে সংগ্রহ করে জমিয়ে রাখা সমস্ত তথ্য গিয়ে পড়ল আর এক জ্যোতির্বিদ এবং তাঁর শেষ সময়ের সহকারী জোহানেস কেপলারের হাতে, যা কাজে লাগিয়ে কেপলার এরপর একদিন আবিষ্কার করে ফেললেন গ্রহদের গতি সংক্রান্ত তিনখানি বিখ্যাত সূত্র। এই সূত্রগুলোর ওপরেই ভিত্তি করে আইজ্যাক নিউটন পরে গড়ে তুলবেন তাঁর সর্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র। পাঠ্যবইয়ের পাতায় রয়ে গেল কেপলারের নাম, কিছুটা ব্রাত্য রয়ে গেলেন টাইকো।
কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে টাইকো চলে এলেন ইতিহাস আর সাহিত্যের পাতাতেও, সৌজন্যে তাঁর মৃত্যু রহস্য এবং রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক। অনেক কাল থেকেই টাইকোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিয়ে কিছু জল্পনা ছিলই, মৃত্যুর প্রায় চারশো বছর পরে, ১৯৯১ সাল থেকে এ নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু হয়। পালে বাতাস লাগল একুশ শতকে এসে; যখন তাঁর নশ্বর দেহের অবশিষ্ট অংশগুলো আরও একবার তুলে আনা হল সমাধির অন্দর থেকে, আর তা বিশ্লেষণ করার পর থেকেই চর্চা শুরু হল গবেষক-মহলে। খোঁজা শুরু হয় একাধিক প্রশ্নের উত্তর। তাঁর চুলে পাওয়া অত্যাধিক পরিমাণে পারদের অস্তিত্ব প্রশ্ন তোলে, টাইকো কি সত্যিই মূত্রথলির সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, নাকি তাঁকে শেষ সময়ে খাওয়ানো হয়েছিল বিষাক্ত তরল পারদ? কে-ই বা খাইয়েছিলেন?
দু’জনের নাম উঠে আসে সম্ভাব্য পরোক্ষ-খুনি হিসেবে। প্রথমেই আসে জার্মান ওই জ্যোতির্বিদ কেপলারের নাম। টাইকোর কাছ থেকে তাঁর সংগৃহীত তথ্যের কিছু অংশ নিজের কাজে লাগাবেন, এজন্য চেয়েও পাননি কেপলার, সেই রাগেই কি গুরুকে পারদ খাইয়ে হত্যা? তাও আবার একবার না, সেই আসরে এবং টাইকোর মৃত্যুর আগের দিনও— দু’- দু'বার!
দ্বিতীয় যাঁকে খুনি ভাবা হয়, তিনি টাইকোরই আত্মীয় এরিক ব্রাহে। ইনি সেদিনের সেই ব্যাঙ্কোয়েট পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন, এবং মনে করা হয় ডেনমার্কের ওই রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানই তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন টাইকো-কে হত্যার জন্য। তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, টাইকোর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক ছিল তাঁর মা, অর্থাৎ দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের স্ত্রী সোফিয়ার। এখানেও বলে রাখা ভালো, এই তত্ত্বের পক্ষে আর বিপক্ষে মতামত দিয়ে এসেছেন একাধিক গবেষকেরা। আর সদ্য, বছর কয়েক আগে আরও একবার তাঁর সমাধি খুলে নতুন করে পরীক্ষা করা হয় টাইকোর দেহাবশেষকে, জানা যায় যে পারদের জন্য না, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল মূত্রথলির সংক্রমণের কারণেই। কেপলার, সুতরাং আপাতত দোষী বলে সাব্যস্ত হননা আর।
এবার শেক্সপিয়ার। ‘হ্যামলেট’ লিখেছিলেন তিনি ১৫৯৯ থেকে ১৬০১ সালের মধ্যের সময়সীমায়। তাঁর এই নাটকের মুখ্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল টাইকো ব্রাহের জীবনের কিছু ঘটনা, আর তাঁর প্রচারিত তত্ত্বের মিশেল— মনে করেন অনেকে।
এই ধারণার একজন সমর্থক পদার্থবিদ ডোনাল্ড অলসন। আমেরিকান এই অধ্যাপক পদার্থবিদ্যার আলোকে দেখতে ভালোবাসেন ইতিহাস, শিল্পকলা, সাহিত্যের বিভিন্ন ধারাকে। তাঁর গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে শেক্সপিয়ারের দীর্ঘতম এই নাটকের মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় লুকিয়ে থাকা জ্যোতির্বিদ্যার নানা চিহ্ন। নাটকটির একেবারে শুরুর দৃশ্যে উল্লেখ থাকা এক বিশেষ তারার কথা তিনি জানান, যেটা দেখা যেত উত্তর আকাশে, আর অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি নির্ধারণ করেন যে এই তারাটিই ১৫৭২ সালে টাইকোর দেখা ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রপুঞ্জের সেই উজ্জ্বল তারা। অনেক পরে এটিকে ‘সুপারনোভা’ (কোনও তারার জীবনের অন্তিম দশায় ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শেক্সপিয়ার নিজেও এই মহাজাগতিক ঘটনাটি দেখেছিলেন বলে মনে করেন ডোনাল্ড সাহেব।
হ্যামলেটের ঘটনাক্রমের মধ্যে আরও একটি বিশেষ ব্যাপারের ছায়া আছে বলে মনে করার পক্ষেও যুক্তি আছে। হাজার বছরেরও বেশি ধরে চলে আসা টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা আর চতুর্দশ শতকে কোপারনিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্ব, এই দুইয়ের মাঝামাঝি একটা তত্ত্ব হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল টাইকো ব্রাহের মডেলটি। যেখানে বলা হয়েছিল যে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে পৃথিবী ছাড়া অন্য গ্রহেরা, আর সূর্য (এবং চাঁদও) সেগুলো সমেত ঘুরে চলেছে পৃথিবীর চারদিকে। ইংল্যান্ডের থমাস ডিগস (Thomas Digges, ১৫৪৬-১৫৯৫) দিয়েছিলেন আবার অন্য এক মত। তাঁর কাছে সূর্য ছিল আরও অগণিত তারাদের মতো একটি তারা। আর যেহেতু সূর্য বিশেষ কোনও তারা নয়, সুতরাং অন্য তারাদের চারপাশেও থাকতে পারে পৃথিবীর মতো এক বা একাধিক গ্রহ। সুতরাং মানুষ যে এই মহাবিশ্বে শুধু পৃথিবীতেই নেই, থাকার সম্ভাবনা আছে অন্য গ্রহেও; ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপ্রতীপে এই ধারণা সে আমলের পক্ষে যথেষ্ট বৈপ্লবিক ছিলই। আমাদের মনে পড়বে নিশ্চয়ই, অনেকটা এই ধরনের কথা বলার জন্যেই রোমে ঠিক ১৬০০ সালে চার্চের নির্দেশে পুড়ে মরতে হয়েছিল আর এক জ্যোতির্বিদ জিওর্দানো ব্রুনো-কে। ডিগস রোমান সাম্রাজ্যের বাসিন্দা হলে তাঁরও কপালে নির্ঘাত ফাঁসি বা ওই ধরনের কিছুই লেখাই ছিল।
এই দুই বিপরীত মতবাদ, একদিকে টাইকোর, অন্যদিকে ডিগসের— আকৃষ্ট করেছিল শেক্সপিয়ারকেও। এমনিতে তিনি টাইকো ব্রাহে সম্বন্ধে জানতেন আগে থেকেই; টাইকোর অনেক আগেকার পূর্বপুরুষ সোফি গ্লাইডেন্সটায়ার্ন আর এরিক রোসেনক্রানৎজ— এই দু’জনের নাম ব্যবহার করেছিলেন তাঁর হ্যামলেট নাটকে; আর তাঁর নাটকে এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থিত করেছিলেন টাইকোর মতবাদকে। একইভাবে নকল রাজা ক্লডিয়াসের মধ্যে ছায়া আছে ক্লডিয়াস টলেমির, ডিগসের অসীম মহাবিশ্বের ধারণাকেই প্রকাশ করছে হ্যামলেট চরিত্রটি, আর নাটকের রঙ্গমঞ্চ এলসিনোর প্রাসাদ আসলে টাইকোর ওই দ্বীপে অবস্থিত অবজারভেটরিটাই। নাটকে থাকা ডুয়েল লড়ার ঘটনাও টাইকোর যৌবনে ঘটে যাওয়া এক বন্ধুর সঙ্গে ডুয়েলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই যায়, যে লড়াইয়ে তিনি খুইয়েছিলেন তাঁর নাকের বেশিরভাগটাই। বাকি জীবন কেটেছিল ব্রোঞ্জের তৈরি নকল নাক পরে।
এরকম আরও অনেক জ্যোতির্বিদ্যাজনিত রেফারেন্স হ্যামলেটের টেক্সটে কুচিকুচি হয়ে অবস্থান করছে, জানা যাচ্ছে গবেষকদের লেখাপত্র ঘাঁটলেই। আর মাত্র ছাব্বিশ বছর পর যিনি পাঁচশো বছর অতিক্রম করবেন, সেই টাইকো ব্রাহে আজও প্রবাহিত হয়ে চলেছেন ইতিহাসের ধূসর পাতা থেকে সাহিত্য-বিজ্ঞানের মেলবন্ধনকারী নতুনতর তত্ত্বের উজ্জ্বল স্রোতে।
[এই লেখাটি মূলত Peter Usher-এর ১৯৯৭ সালে লেখা একটি নিবন্ধ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হল। লিঙ্ক— https://news.psu.edu/story/140839/1997/09/01/research/hamlet-and-infinite-universe]
#