ট্যুইট
আমার মৃত্যুর কুড়ি ঘণ্টা আগে আমি একটি ট্যুইট করেছিলাম।
তারপর সেই ট্যুইটের প্রতিটি শব্দকে ছেড়ে দিয়েছিলাম স্বাধীনভাবে। আমার শেষ সম্বল বলতে ছিল এই শব্দ-দূতেরাই। আমি, চিরউদ্ধত, নিষ্ঠুর এক মানুষ, এই প্রথম কাতর হয়েছিলাম। শব্দদের কাছে। আমার প্রয়োজন ছিল এক গর্ভধারিণীর। যে গর্ভধারিণীর গর্ভে অম্লের জন্ম হয়। কিন্তু কুড়ি ঘণ্টা ধরে ডানা মেলা ক্লান্ত শব্দের দল যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিল, ততক্ষণ আর কয়েক মিনিট। অবশ্য সকলে ফিরে আসেনি। ওখান থেকে আর জীবনের দিকে পিছিয়ে আসার কোনও রাস্তা ছিল না। মৃত্যুর ঠিক আগে চলমান শব্দেরা যেভাবে জড় হয়ে যায়, আমিও ঠিক সেভাবেই স্থিরত্ব-প্রাপ্ত হলাম।
এই মুহূর্তে আমি শহরের একপ্রান্তে। এক দঙ্গল কাঠের ভার শরীরে নিয়ে আমি পুড়ছি। এমন আরও অনেকেই পুড়ছে এখানে। এ জায়গাটা বোধহয় আগে ভাগাড় ছিল। আমার মতো একজন সম্মাননীয় নাগরিকের এমন পরিণতি হল! এসব কথা ভাবছি, এমন সময়ে আমার পাশের কাঠস্তূপ থেকে কেউ বলে উঠল – ‘কী ভাবছ বন্ধু?’
গলাটা হয়তো চেনা। এই মৃত্যু-পরবর্তীতে সকল অচেনাকেই চেনা বলে মনে হওয়া উচিত। সকল পরকেই আপন বলে মনে হওয়া উচিত। কিন্তু আমি চিনতে পারলাম না। যাইহোক, প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। ‘ভাবছি, এরকম পরিণতি হওয়া কি উচিত ছিল?’
সেই গলা আবার বলে উঠল – ‘ছিল না, না?’
বেঁচে থাকলে এই কথায় আমার রাগ হত, তুলোধনা করে ছাড়তাম বক্তাকে। এখন নির্লিপ্ত স্বরে বললাম – ‘না, অবশ্যই ছিল না। মরলাম সে ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে বেওয়ারিশের মতো পুড়তে থাকার লজ্জা মনে হয় কম নয়।’
সে এবার জিজ্ঞাসা করল – ‘তা বন্ধুর পরিচয়টা জানতে পারি।’
আমি পরিচয় দিলাম। সঙ্গে এও বললাম, আমি কত বড় গণ্যমান্য ব্যক্তি। শুনে আমার শববন্ধু হাসল (মানে তেমনই মনে হল)। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করলাম। সে আবার বলল – ‘তা তোমার এত খ্যাতি, এত বড়সড় কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় থাকা সত্ত্বেও তোমাকে ওরা এইখানে আনল! ছি ছি, কী অন্যায়!’
-‘তুমি ব্যঙ্গ করছ আমায়?’
-‘না, জানতে চাইছি শুধু। আরও একটা বিষয় জানার আছে। তুমি নিশ্চয় অন্তত বড় হাসপাতালে জায়গা পেয়েছিলে? নিজস্ব কেবিন নিশ্চয় বরাদ্দ ছিল তোমার জন্য?’
এইবার আমি চুপ করলাম। ওকে কীভাবে বলি, আমি আসলে যে গর্ভধারিণীর সহায়তা চেয়ে ট্যুইট করেছিলাম, সেটুকুও এসে পৌঁছয়নি। তবু কিছু একটা বলতেই হবে। বলা-কওয়ার উর্ধ্বে আজ চলে এসেছি বলেই আর চেপে রাখার কোনও পরিসর নেই। আমি আস্তে আস্তে বললাম – ‘না। বাড়িতেই। বায়ুশূন্যতা চেপে ধরল।’
সে চুপ করল। অস্ফুটে বলল – ‘আমারও তাই।’
অর্থাৎ, সে আমার মৃত্যু-সহযোগী। আমি খানিক হালকা বোধ করলাম। এবার ওর সঙ্গে আরেকটু ফ্রি হতে পারব। অতএব, আমি জিজ্ঞাসা করলাম – ‘তুমি হাসপাতাল পেয়েছিলে?’
সে উত্তর দিল না। তার মানে ও-ও পায়নি। যাক, এক্ষেত্রেও সে আমার পথসঙ্গী। আরও একটু ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে। সে এবার প্রশ্ন করল – ‘কোনও সাহায্যই তবে পেলে না?’
-‘না।’
-‘সাহায্য চেয়ে কাউকে ফোনও করোনি? এত তো জানাশোনা তোমার। স্বয়ং হুজুরের স্নেহধন্য তুমি।’
-‘ট্যুইট করেছিলাম।’
-‘তারপর?’
-‘বড় আশা ছিল, হুজুরের চোখে ঠিক পড়বে। হুজুর আমার জন্য উদ্বিগ্ন হবেন, সাহায্য পাঠাবেন। কিন্তু কিছুই হল না। ট্যুইটের শব্দরা ঘুরেফিরে এসে জানাল, আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমি মরে গেলাম।’
-‘ট্যুইটের শব্দদের সঙ্গে তোমার কথা হল?’
-‘হ্যাঁ। শুনবে?’
-‘বলো।’
***
-‘কে?’
-‘আমি তোমার শরীর।’
-‘বলো, কী সংবাদ?’
-‘ভালো নয়।’
-‘কোথাও কিছু পেলে না?’
-‘না। এখন পাওয়া যাবে না।’
-‘আমার জন্যেও নয়?’
-‘হাহা, হাসালে! তুমি কে?’
-‘কেন? আমি তো একজন সম্মাননীয় নাগরিক। একজন দায়িত্বশীল, সচেতন নাগরিক। হুজুরের অবমাননা যাতে না হয়, বরাবর সেই চেষ্টা করেছি। আমার মতো আনুগত্য এই দেশের আর কজনারই বা আছে! তারপরেও পাওয়া যাবে না?’
-‘না। এখন অনুগতের জন্যেও কিছু নেই।’
-‘আইন-শৃঙ্খলা এভাবে উঠে গেল?’
-‘ছিল নাকি কখনও?’
-‘ছিল তো। হুজুরের বিরুদ্ধে যারাই ষড়যন্ত্র করেছে, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙেছে, তাদের শাস্তি হয়েছে। সকলে এখন জেলে।’
-‘কেউ কেউ হাসপাতালেও।’
-‘হাসপাতালে কেন?’
-‘ওরাও অসুস্থ।’
-‘কী অসুখ?’
-‘তোমার যা হয়েছে।’
-‘তবু ওরা হাসপাতালে?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আর আমি পেলাম না?’
-‘…’
-‘চুপ করে গেলে কেন?’
-‘আর কিছু করার নেই তাই।’
-‘সত্যিই কি আর কিছুই করার নেই?’
-‘না। তোমাকেও চুপ করে যেতে হবে।’
-‘শব্দের তাহলে কোনও ক্ষমতা নেই?’
-‘সেটা কার শব্দ, তার উপর নির্ভর করে।’
***
আমার বন্ধু এতক্ষণ পুরোটা মন দিয়ে শুনল।
অদ্ভুত ব্যাপার, আমরা কেউই কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি, কিছু একটা ভাবছে সে। কিন্তু সেটা যে কী, আমি বুঝতে পারিনি। তবে দগ্ধ হতে হতে এটুকু বুঝছিলাম, তাকে আমার এখন যে ভীষণ কাছের মনে হচ্ছে, এই মনে হওয়াটা হয়তো মৃত্যুর উপহার। সে-ও যে আমার কথা মন দিয়ে শুনছে, সেটুকুও হয়তো মৃত্যুকালীন মিলন।
আমার বয়সটা উনসত্তরে এসে থেমে গেল। আমার স্ত্রী বিন্দুর কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। আমাদের বিয়ে হয়েছিল যখন, তখন আমি একুশ, আমার স্ত্রী কুড়ি। আমার মনে আছে, ফুলশয্যার রাতে আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, দেখো, আমাদের পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকীটা ঠিক আসবে। অন্তত সত্তর বছর কি বাঁচব না? আমার স্ত্রী ওই বয়সে অপরূপ সুন্দরী ছিল। সলজ্জ হাসি হেসে বলেছিল, নতুন জীবনের শুরুতে মৃত্যুর কথা কেন?
পরপারের বন্ধু বুঝি আমার সব ভাবনা ধরতে পারে। বলে উঠল – ‘স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতে, না?’
বেঁচে থাকলে এই কথায় নিশ্চিত চমকে উঠতাম, অপার বিস্ময় প্রকাশ করতাম। এখন উত্তর দিলাম – ‘হ্যাঁ। খুব। কথা দিয়েও কথা রাখতে পারলাম না।’
বন্ধুরও বুঝি কারও কথা মনে পড়ল। এবার আমি ওর ভাবনা ধরতে পেরে বললাম – ‘তুমিও কি তোমার স্ত্রীর কথা ভাবছ?’
-‘না। এখন ওর কথা ভাবছি না। ভাবছি মা’র কথা। আমারও মাকে কথা দেওয়া ছিল। সেকথা রাখা গেল না।’
-‘কী কথা দিয়েছিলে?’
-‘কথা দিয়েছিলাম, ফিরে আসব।’
-‘ও, তুমি বুঝি এমারজেন্সি সার্ভিসে ছিলে?’
বন্ধু এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেল। সে অন্য প্রসঙ্গে গেল। ‘আমার কথা থাক। তোমার ট্যুইটের কাহিনিটা শুনতে বড় ইচ্ছে করছে। সেটা বলো।’
***
-‘এবার কে এলে?’
-‘তুমি যে গর্ভধারিণীর অপেক্ষায়, আমিই সে।’
-‘ও তুমি? তোমার সারা গায়ে রক্ত কেন?’
-‘ওরা করেছে।’
-‘কারা?’
-‘তুমি যাদের কাছে যেতে বলেছিলে।’
-‘সেকি! কেন?’
-‘আমার পরিচয় জানতে চেয়েছিল।’
-‘তারপর?’
-‘আমি বললাম, আমি অক্সিজেন। শুনে বলল, ওই নামে কারও এখানে আসার কথা নয়।’
-‘তারপর?’
-‘আমি প্রশ্ন করলাম, কেন।’
-‘তখন কী বলল?’
-‘উত্তর দিল না।’
-‘তাহলে মারল কখন?’
-‘তার পরে। ওরা জানে, ওই নামে কেউ কখনও আসবে না।’
-‘এ হে। আমার জন্য ফালতু মার খেলে।’
-‘ওতে আমার আর কিছু যায় আসবে না।’
-‘কেন?’
-‘কারণ, আদৌ আর আমার প্রয়োজন হবে না তোমার।’
-‘না না। একি বলছ?’
-‘ঠিকই বলছি।’
-‘তুমিও ব্যর্থ হলে?’
-‘আমরা সফলতা-বিফলতার ব্যাপার নেই। আমরা তো কেবল ভাড়া খাটি। এই দেহের মৃত্যু হলে ওই দেহে।’
***
বন্ধু এবারও পুরোটা মন দিয়ে শুনেছে। শুনতে শুনতে ও কী ভাবছে, সেই তল আমি পাইনি। পুরোটা বলা শেষ হলে কিছুক্ষণ নীরবতার পর ও-ই কথা বলল আবার। ‘এত ঘণ্টা ধরে কেউ সত্যিই তোমার ট্যুইট দ্যাখেনি?’
বেঁচে থাকলে এই মুহূর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম, হা-হুতাশে ব্যতিব্যস্ত করতাম মানুষকে। এখন আমি বললাম – ‘আমার ছেলেও একটা ট্যুইট করেছিল। আমার চেয়েও ওর প্রচুর ইনফ্লুয়েন্স। ওর ট্যুইটটা হুজুরের একজন খাস লোক রি-ট্যুইট করল। পনেরো মিনিটের মধ্যে। আশা জাগল। হুজুরের চোখে পড়া আর শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমার নামটা দেখলেই হুজুর আর চুপ করে থাকবেন না। তারপরেই আমার ঘরে এসে বেল বাজাবে আচ্ছাদিত দেবদূতের দল।’
-‘কিন্তু কেউ এল না?’
-‘না কেউ আসেনি। মানে, যাদের কথা ছিল, তারা কেউ আসেনি।’
-‘মানে? অন্য কেউ এসেছিল?’
-‘হ্যাঁ। হুজুরের চোখে পড়ার আগে চোখে পড়ল একদল ঝামেলাবাজের। তারা এসে আমাকে কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ করল। হুজুরের নামে যথেচ্ছ গালমন্দ করে বেড়ায় তারা। এতদিন আমার ভয়ে মাথা তুলতে পারত না। আজ আমাকে বাগে পেয়েছে। অসহ্য আক্রমণ শুরু হল। ভাবো বন্ধু, মনুষ্যত্ব এতটাই দুর্লভ হয়ে পড়ল? আমার এই অবস্থাতেও ওরা সহানুভূতি দেখাবে না?’
-‘তারপর?’
-‘আমার ছেলে ওদের চুপ করতে বলল। প্রার্থনা করল সংযত হওয়ার। একজন উত্তর দিল, ‘দু’পক্ষেরই দোষ আছে।’’
-‘একথা কেন বলল?’
-‘গতবছর পাশের শহরে দাঙ্গা হয়েছিল, মনে আছে তো? একটা পাড়ায় পরপর কয়েক ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই ঘটনাটার পুরো দোষটা হুজুরের উপর চাপিয়েছিল ওই ঝামেলাবাজগুলো। হুজুরের নাকি প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। আমি বিশ্বাস করিনি, কিন্তু হুজুরের গোটা রাজ্য তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল। আমি হুজুরের খাস লোক। এইসময়ে আমি যদি তাঁর পাশে না দাঁড়াই, কে দাঁড়াবে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আমি কিন্তু কোনও বাজে যুক্তি দিইনি, বিশ্বাস করো। দ্যাখো, আমার মনে হয়েছিল, কোনও ঘটনারই একদিকটা দেখা উচিত নয়। গণতন্ত্রের নীতি সেটাই। সেকথা ভেবেই আমি সেদিনও একটা ট্যুইট করি। লিখেছিলাম, দু’পক্ষেরই দোষ আছে।’
বন্ধু আবার চুপ করে গেল। আবার কিছু একটা ভাবছে। পাল্লা দিয়ে পুড়ছে দু’জনের শরীর। হাড়-মজ্জার দহনজাত কর্কশ শব্দে মুখর হচ্ছে চারিদিক। আমরা অবশ্য সেদিকে দৃকপাত করতে পারব না। আমাদের অনুমতি নেই। বন্ধুই নীরবতা ভেঙে বলল – ‘তোমার ট্যুইটের কাহিনিটার আর কতটা বাকি?’
আমি বললাম – ‘আর অল্পই।’
-‘বলো তাহলে।’
***
-‘এসো, তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম এতক্ষণ।’
-‘বৃথা অপেক্ষা।’
-‘একথা বলছ কেন?’
-‘কারণ, কিছুই লাভ হল না।’
-‘একি, তোমার গায়ে এত দুর্গন্ধ কেন?’
-‘ময়লার স্তর থেকে সংগ্রাম করে উঠে আসছি, তাই।’
-‘ময়লার স্তর? মানে?’
-‘ওরা আমাকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলেছিল।’
-‘কারা?’
-‘চিনি না। তোমার হুজুরেরই লোক হবে।’
-‘ছুঁড়ে ফেলল। কেন?’
-‘এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন নেই ওদের, তাই।’
-‘তোমাদের মানে, কাদের?’
-‘ওই যাদের সঙ্গে সংগ্রাম করে উঠে আসার কথা বললাম। আমার মতো আরও সংখ্যারা।’
-‘তোমার কথা আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যি করে বলো তো, তুমি কি সত্যিই গিয়েছিলে হুজুরের দপ্তরে?’
-‘না। যাওয়ার দরকারই পড়েনি।’
-‘কেন?’
-‘ওই যে বললাম ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলেছিল। সে তো যাওয়ারই আগে।’
-‘তারপরে আর চেষ্টাও করলে না ঢুকতে?’
-‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়। ঢোকা যাবে না।’
-‘হুম। তোমাকেও তাহলে কেউ আমল দিল না?’
-‘কেন দেবে? আমি তো কেবল সংখ্যা মাত্র।’
-‘কিন্তু আমার হুজুর তো সংখ্যা পছন্দ করেন।’
-‘এখন পছন্দ করছেন না।’
-‘কেন?’
-‘এখন এই সংখ্যা ওঁর কাছে খুব অস্বস্তির।’
***
মৃত্যুর কুড়ি ঘণ্টা আগে আমি একটা ট্যুইট করেছিলাম – ‘শরীরে অক্সিজেন ৫৬। সাহায্য চাই, প্লিজ।’
বন্ধু এবার প্রশ্ন করল – ‘এখানেই কি কাহিনির শেষ?’
আমি উত্তর দিলাম – ‘হ্যাঁ। ট্যুইটের কাহিনি এখানেই শেষ।’
বন্ধু বিশ্বাস করল না। কীভাবে যেন আমার সমস্ত ভাবনাই সে বুঝতে পারছে। বলল – ‘হতে পারে না। আরও কিছু থাকবে নিশ্চয়।’
আমি এবার বললাম – ‘তুমি ঠিকই ধরেছ। শেষটুকু তাহলে বলি। ট্যুইট করার উনিশ ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ড পরে ফিরে এসেছিল কেবল তিনজন – শরীরে, অক্সিজেন, ৫৬। তিনজনই ক্লান্ত, ব্যর্থ, অথচ কী নিশ্চিন্ত। বাকি তিনজন আসেনি। ‘সাহায্য’ আর ‘চাই’ শেষ শক্তি দিয়ে ঘুরেছিল এদিক-ওদিক, তারপর কখন ফিরেছে, তা জানার জন্য আমি আর তখন বেঁচে নেই। ‘প্লিজ’ নাকি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ও শব্দ আমি কীকরে লিখেছিলাম, জানি না। হয়তো সে কারণেই সে আমার কথা রাখেনি।’
বন্ধু আর আমার ভস্মাংশ ক্রমশ মৃত শহরের দূষিত বায়ুকে আলিঙ্গন করছে। যদিও আমাদের তাতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। আমরা অবশ্য কেউই এখন কথা বলছি না। আমি ভাবছি, বন্ধুও ভাবছে কিছু একটা।
আমার মৃত্যুর দু’মিনিট পরেই আমার ছেলে আরেকটি ট্যুইট করে। আমার মৃত্যুর খবর জানিয়ে। হুজুরের যে লোকটি রি-ট্যুইট করেছিল, সে সেই ট্যুইট দেখে আবার একটা রি-ট্যুইট করে। আমার ছেলে ওখানে ক্ষোভ উগরে দেয়। সেই লোকটি দুঃখপ্রকাশ করে আমার ছেলে আর বিন্দুকে শক্তি ভিক্ষা দিয়ে যায়। যদিও সেই ভিক্ষা কীভাবে পেয়েছিল ওরা, আমি সেকথা জানতে পারিনি।
আমার ট্যুইটে কমেন্ট বেড়েই চলে। আমার ছেলের ট্যুইটেও। বেশিরভাগই ব্যঙ্গোক্তি। আমি অবশ্য আর কষ্ট পাচ্ছি না। সেই অনুভূতি পাওয়ার জায়গায় আমি আর নেই। আমার শুধু খারাপ লাগছে এই ভেবে যে, ফুলশয্যার রাত বিন্দুকে দেওয়া কথা আমি রাখতে পারলাম না।
ওইটুকু অনুভূতিই কেবল টিকেছিল আমার। আমার চাদর-ঢাকা দেহটাকে বিছানায় রেখে বিছানা থেকে এক মানুষ দূরত্বে ওরা বসেছিল। বিন্দু আর আমাদের ছেলে। ঘরের এক সূক্ষ্ম কোণ থেকে আত্মা-পরিণত আমি সে দৃশ্য দেখছিলাম। বিন্দু যেন একটু একটু করে সরে আসতে চাইছিল আমার কাছে। এই মুহূর্তে ওকে নিরস্ত করা দরকার। পালকের মতো হালকা শরীর এখন। এক ঝটকায় ওখানে গিয়ে টেনে ধরতে পারি বিন্দুর ওড়নাটা।
এত অবধি ভেবেছি, হঠাৎ বন্ধু জিজ্ঞাসা করল – ‘টেনে ধরলে স্ত্রী’র ওড়নাটা?’
ভাবনা-অধ্যয়নের সীমাহীন দক্ষতা আছে বন্ধুর। অবশ্য হয়তো দেহ-মালিকের বশ্যতা থেকে মুক্ত আত্মার এ এক সহজাত শক্তি। কিন্তু মৃত তো আমিও, আমি তো পারছি না সেরকম। অতশত না ভেবে বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর দিই – ‘না। এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম। শুধু তো দেহ থেকে আত্মায় পরিণত হয়েছি। কিন্তু সংক্রমণ তো রয়ে গেছে তখনও।’
বন্ধু পাল্টা প্রশ্ন করে বসল, কিন্তু যেন ঠিক সরাসরি আমার উদ্দেশ্যে নয় – ‘সংক্রমণ এখনও কি কেটেছে বলে মনে হয়?’
হাসলাম। ‘পুড়ে ছাই হয়ে গেলাম। আর সংক্রমণ কাটবে না?’
বন্ধুও হাসল এবার। ‘কিছু কিছু সংক্রমণ দহনের পরেও কাটে না।’
বন্ধুর কথা এবার দুর্বোধ্য লাগছে আমার। হঠাৎ কী একটা মনে পড়াতে বন্ধুকে প্রশ্ন করলাম – ‘বন্ধু, এতক্ষণ তো আমিই কথা বলে গেলাম। তোমার কথা তো জানা হল না।’
বন্ধু আবার আমার প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেল। উল্টে সে আবার প্রশ্ন করল – ‘আচ্ছা, এই যে তুমি হাসপাতাল পেলে না, অক্সিজেনও পেলে না হুজুরের খাস লোক হয়েও, অনেকেই এখন পাচ্ছে না, তোমার এ নিয়ে কিছু মনে হচ্ছে না?’
আমি ভেবে পেলাম না কী জবাব দেব। আমি সত্যিই এই নিয়ে কিছু ভাবিনি। হুজুরের কাছ থেকে আমার ট্যুইটের শব্দদল ফিরে এলেও আমার কিছু মনে হয়নি। জাস্ট মরে গেছি। আমিও এবার এড়িয়ে গেলাম বন্ধুর প্রশ্নটা। বরং আমার আগের প্রশ্নেই ফিরলাম – ‘আমার কথা তো হল এতক্ষণ। তুমি তোমার কথা বলো।’ বন্ধু বলল – ‘আমার তো সেরকম কথা নেই।’
আমি বললাম – ‘সে আবার কী কথা! সকলের কিছু না কিছু কথা থাকে। এখন আর কথা চাপারই বা কী আছে? আমরা তো সেসবের পরিণাম থেকে অনেক দূরে।’
বন্ধু বলল – ‘বেশ বলো, কী জানতে চাও।’
-‘এই যেমন তোমার কথা শুনে মনে হল, তুমিও আমারই মতোই হাসপাতাল পাওনি, অক্সিজেন পাওনি…’
বন্ধু আমাকে থামিয়ে দিল। বলে উঠল – ‘কে বলল তোমায় হাসপাতাল পাইনি আমি? হাসপাতাল পেয়েছিলাম। অক্সিজেন অবশ্য আমিও পাইনি।’
-‘হাসপাতাল পেয়েছিলে? তারপরেও বাঁচলে না?’
-‘না। অক্সিজেন না পেলে কেউ বাঁচে না।’
-‘কিন্তু হাসপাতাল তো অক্সিজেন দিতে বাধ্য।’
-‘ওসব নিয়ম অন্য সময়ে চলে।’
-‘তুমি অক্সিজেন চাওনি?’
-‘অক্সিজেন চাইলেই পাওয়া যায় না। আর, এখানে অক্সিজেন চাওয়াও যায় না।’
-‘কেন চাওয়া যাবে না?’
-‘অমনই নিয়ম।’
-‘কী আবোল-তাবোল বকছ। তুমি অক্সিজেন চেয়ে ট্যুইট করোনি?’
-‘না, আমার হাত-পা চেন দিয়ে বাঁধা ছিল।’
-‘সেকি! কেন?’
-‘বিপজ্জনক রুগী বলে।’
-‘বিপজ্জনক কেন?’
-‘জেলের কয়েদি বলে। অবশ্য জেলের কয়েদি বলেই হাসপাতাল পেয়েছি। আবার মজাটা এই, আমার স্ত্রী-ও এখন গ্রেপ্তার।’
-‘সেকি! কেন?’
-‘অক্সিজেন চেয়ে ট্যুইট করেছিল বলে।’
-‘এরকমও হচ্ছে?’
-‘হচ্ছে।’
-‘তুমি জেলের কয়েদি ছিলে কেন?’
-‘সেও ট্যুইট করার অপরাধেই।’
-‘কী ট্যুইট করেছিলে?’
-‘গতবছর দাঙ্গার সময়ে। নিজের দেখে আসা অভিজ্ঞতা। আসলে কী হয়েছিল।’
[অলংকরণ: অভীক]
#বাংলা #গল্প #সোহম দাস #Silly পয়েন্ট #লকডাউন #কোভিড #ট্যুইট