নিবন্ধ

সত্যি বিদ্যাসাগর মিথ্যে বিদ্যাসাগর

সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় Sep 26, 2020 at 5:05 am নিবন্ধ

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামটা শুনলেই একসাথে অনেকগুলো ছবি হাজির হয়ে যায় আমাদের চোখের সামনে। বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে সমাজ-সংস্কারক, সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ রোধ - এসব ইতিহাসই আমাদের জানা। তবে আমাদের তাঁকে এই জানার শুরু বোধহয় বাবার হাত ধরে রাস্তার মাইলফলকে তাঁর সেই সংখ্যা শেখার গল্প দিয়ে। জনপ্রিয় লোককথার মতো বাঙালির সংস্কৃতিতে তাঁকে নিয়ে জমে উঠেছে একটার পর একটা গল্প। কিছু গল্প সত্যি। অনেক গল্পের মধ্যেই আবার প্রায় পুরোটাই জল। তবে সব মিলিয়ে ওই বেঁটে, খাটো ধুতি পরিহিত, গায়ে চাদর চাপানো মানুষটাকে নিয়ে যত কিংবদন্তি তৈরি হয়েছে, তেমন বোধহয় আর কাউকে নিয়েই হয়নি।

বিদ্যাসাগর একবার হাঁপানির ওষুধ প্রায় বের করে ফেলেছিলেন বলে শোনা যায়। তিনি নিজে ছিলেন হাঁপানির রোগী। ঠান্ডার সময় এ অসুখ বড়ই কষ্ট দিত তাঁকে। নির্দিষ্ট কোনো ওষুধও ছিল না। পথ্য হিসেবে খেতেন দুবেলা এক কাপ করে গরম চা। এইরকমই একদিন একবার চা খেয়ে হঠাৎই উপলব্ধি করলেন তাঁর হাঁপানির অসুখটা অনেকটা স্বস্তি দিচ্ছে। সদা-অনুসন্ধিৎসু মন স্বাভাবিক ভাবেই ভাবিয়ে তুলেছে তাঁকে, হঠাৎ এই সুস্থতার কারণ কী? সঙ্গে সঙ্গে তলব পড়ল তাঁর চা প্রস্তুতকারক চাকরের। কী দিয়ে সে বানিয়েছে আজকের চা! হতভম্ব চাকর যতই বলে রোজ যেভাবে চা করে, আজও তাই করেছে; কিন্তু তাঁকে সন্তুষ্ট করবে কে? অবশেষে তাঁর জেরার সামনে তাঁর ভৃত্য জানায়, আজ তাড়াহুড়োয় চায়ের কেটলিটা পরিষ্কার করে ধোয়া হয়নি। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে হুকুম পড়ে সেই কেটলি আনার। এবং দেখা যায় সেই কেটলির মধ্যে পড়ে রয়েছে দুটি মৃত আরশোলা। পাঠক হয়তো এই লাইনটি দুবার পড়বেন, চোখের ভুল কি না দেখার জন্যে, তারপর 'ছি!' জাতীয় কোনও ঘৃণার অভিব্যাক্তি প্রকাশ করেই খানিক ঢোঁক গিলে থেমে যাবেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মশাই সেইদিন সেইখানে মোটেও থেমে যাননি, সাময়িক বিস্ময় কাটিয়ে উঠেই  সেইসঙ্গে এই ওষুধ কতটা কার্যকরী তা পরীক্ষা করার জন্যে এইভাবে আরশোলা সিদ্ধ করে তার সাথে অ্যালকোহল মিশিয়ে তা অনেক হাঁপানি রোগীকে তাঁদের অজ্ঞাতসারেই খাইয়েছিলেন, এবং শোনা যায় তাঁরা অনেকেই রোগমুক্ত হয়েছিলেন।

এই ঘটনা অনেকেই সত্যি বলেই মানেন। তবে গল্পে যাই থাক, চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি, বিশেষ করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রতি তাঁর যে বিশেষ আগ্রহ ছিল তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিষয়ে বহু বই তিনি নিজের জন্য কিনতেন এবং অন্যদের মধ্যে বিতরণও করতেন। প্রখ্যাত অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের হোমিওপ্যাথির ওপর কোনো ভরসাই ছিল না। এই নিয়ে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই তর্ক হত। পরবর্তীতে তাঁর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পথ অবলম্বন করার কারণ হিসেবে বিদ্যাসাগরের প্রভাবকে দায়ী করেন অনেকে। বিদ্যাসাগর মশাই ডাক্তারি শেখার জন্যে বাড়িতে নরকঙ্কালও কিনেছিলেন। ক্ষুদিরাম বসু লিখেছেন, তাঁর পেটের অসুখে বড় বড় ডাক্তারদের ওষুধ কাজে লাগেনি, কিন্তু বিদ্যাসাগরের দেওয়া দাওয়াই তাঁর অসুখ-মোচনে ম্যাজিকের মতো কাজ দেয়। 

বিদ্যাসাগর আস্তিক না নাস্তিক, এ বিষয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। তবে ধর্ম বলতে তাঁর মত ছিল, ধর্ম হবে এমন যা আমাদের চলনে কোনো বন্ধন সৃষ্টি করবে না। তিনি সব সময়েই বলতেন, "আমার মত কাউকে কখনো বলি না। তবে এই কথা বলি, গঙ্গাস্নানে যদি আপনার দেহ পবিত্র মনে করেন, শিবপূজায় যদি হৃদয়ের পবিত্রতা লাভ করেন, তাহলে তাই আপনার ধর্ম।" এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিকে বারবার প্রশ্ন করেছেন। তাঁর এই মতাদর্শকে নিয়ে গল্প থাকবে না, তাও কি হয় ? শোনা যায়, তাঁর দর্শনের শিক্ষক পড়ানোর পর তাঁকে যখনই জিজ্ঞাসা করতেন, "ঈশ্বর বোঝো তো?" তার উত্তরে বর্ণপরিচয়-এর লেখক নাকি বলতেন, "আপনি যেমন বোঝেন আমিও তেমন বুঝি- পড়িয়ে যাচ্ছেন পড়িয়ে যান।"

আর ঈশ্বরে বিশ্বাস? যে মানুষ সকলের চলার পথকে এমন সহজ করে দেন, তিনি কোনো নির্দিষ্ট মূর্তির পায়ের তলায় মাথা নত করবেন, এ একেবারেই মেলানো যায় না। নাস্তিক পণ্ডিতমশায়ের দিকে ভোট পড়লেও, তাঁর চিঠির ওপরে তিনি সর্বদা লিখতেন "শ্রী শ্রী হরিঃ শরণম"।  আমরা জানি না তিনি ঈশ্বর মানতেন কি না, তবে তিনি একবার নাকি নিজেই বলেছিলেন ঈশ্বর যদি থাকেনও, না মানার অপরাধে "তিনি তো আর কামড়াবেন না।"

ঈশ্বর, ঈশ্বরকে সত্যিই কামড়াননি। বরং এক ঈশ্বরের কাজ করে গেছেন আরেক ঈশ্বর। তাঁর পুজো ছিল অন্যরকম। অতিথিসেবা তাঁর পুজোর অন্যতম অর্ঘ্য। তাঁর অতিথি আপ্যায়ন নিয়েও আছে সরস গল্পের ঝুলি। একবার বাড়িতে আসা বেশ কয়েকজন অতিথিকে পঞ্চব্যঞ্জন সহযোগে খেতে দিয়েছেন। সামনে হুঁকো হাতে বসে স্বয়ং নিমন্ত্রণকর্তা বিদ্যাসাগর। স্বাভাবিকভাবে খেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে না নিমন্ত্রিতরা। তা বুঝতে পেরেই তৎক্ষণাৎ একটি সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে তা ব্যাখ্যা করতে থাকলেন বিদ্যাসাগর, যার অর্থ ছিল, "জন্ম বারবার হইতে পারে, কিন্তু নিমন্ত্রণ সকল সময় জুটিয়া ওঠে না; সেইজন্য নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের উচিত, ভোজনের সময় লজ্জা পরিত্যাগ করিয়া উচিতমতোই ভোজন করা।"

কেবল অতিথি-আপ্যায়নের গল্প নয়, তিনি সবসময়েই অন্নপূর্ণার রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে। দুর্ভিক্ষের সময় নিজের গ্রামে কীভাবে অজস্র মানুষের আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন, তার সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, তাঁর নিজের বাড়িতেও অন্নসত্রের ব্যবস্থা হয়েছিল। এ ছাড়াও অন্য সময়ে কার্মাটারে চূড়ান্ত গরিব মানুষদের মধ্যে ভুট্টা বিলিয়ে দেওয়ার কথাও আমরা জানি।

যেমন সহজ ভাবে তিনি দাঁড়াতেন মানুষের পাশে তেমনই সহজ ছিল নিজের যাপন। তাঁর পোশাক নিয়ে তো মিথের শেষ নেই আমাদের ঝুলিতে। সাদামাটা ধুতি-চাদর পরা বেঁটে মানুষটাই যে আসলে একটা মস্ত বড় সাগর, তা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি তখন। একবার লখনৌয়ের রাজকুমার সর্বাধিকারীর বাড়িতে উঠেছিলেন বিদ্যাসাগর। তাঁকে দেখতে প্রায়ই লোকে আসত। তেমনই এসেছিল ফোর্থ ইয়ারের এক ছাত্র, পূর্ণচন্দ্র। এবং এই অত্যন্ত সাধারণ পোশাক পরিহিত বিদ্যাসাগরকে প্রথমে না চিনতে পেরে বলেছিল, এই ওড়িয়া পাল্কিবাহকের মতো মানুষকে দেখতে এত ভিড়? এ গল্প অবশ্য স্থানবিশেষে চরিত্র বদলেছে অনেকবার। 

তবে বিদ্যাসাগরেরও নাকি এক সময় দ্বিধা ছিল যে, ইংরেজরা যে সভায় উপস্থিত থাকে, সেখানে তিনি কী পরবেন? স্বদেশি না বিদেশি পোশাক? একদিন দেখেন এক মুসলমান ব্যক্তি নিজ খেয়ালে হাঁটছেন। তাঁর চাকর ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল যে বাড়িতে আগুন লেগেছে । এই খবর শুনেও বাড়ির মালিক তাঁর চলার বেগ বাড়ালেন না দেখে চাকর তাকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন, "বেকুব, দুটো দরজা-জানলা পুড়ছে বলে আমি আমার বাপ দাদার চালচলন ভুলে ছুটব মনে করেছিস?" সেদিন থেকেই বিদ্যাসাগরের মনে আর কোনো দ্বিধা ছিল না। আপন সংস্কৃতিরই বাহক হয়ে থেকেছেন আজীবন। পরে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন, "সেই যে চটি- দেশী চটি- বুটের বাড়া ধন,/ খুঁজব তারে, আনবো তারে,এই আমাদের পণ; / সোনার পিঁড়ে রাখবো তারে, থাকবো প্রতীক্ষায় / আনন্দহীন বঙ্গভূমির বিপুল নন্দিগাঁয়।"

আসলে বিদ্যাসাগরের গল্প বলতে শুরু করলে শেষ হয় না। যে মানুষ শিক্ষার আলো জ্বালায়, পাথর সরিয়ে পথ করে দেয় সমাজের জন্য, তাকে নিয়ে তো মিথ গড়ে উঠবেই। মার্কিন পুরাণবেত্তা ও লেখক জোসেফ জন ক্যাম্বেল বলেছিলেন, " Myths are public dreams, dreams are privet myths." অর্থাৎ মিথ একটা জনগোষ্ঠীর সমষ্টির কল্পনা, আর কল্পনাই হল ব্যক্তিগত মিথ। কোনো পৌরাণিক চরিত্র না হয়েও মানুষের কাছে মিথ হয়ে উঠতে সত্যিই কেবল ঈশ্বরই পারেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।



তথ্যঋণ :

১। করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্র মিত্র, আনন্দ 

২। রসসাগর বিদ্যাসাগর, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নাভানা প্রকাশন

৩। বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ, শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ   বন্দোপাধ্যায়, প্রবাসী প্রেস 

৪। দেমু'র নানা রকম, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, সৃষ্টিসুখ


[কভার ছবিতে ১৯৭০ সালে ভারতীয় ডাকবিভাগের প্রকাশ করা স্ট্যাম্পের ছবি। ঈশ্বরচন্দ্রের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এই বিশেষ স্ট্যাম্পটি প্রকাশ করা হয়েছিল।] 

#ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর #Vidyasagar #Ishwar Chandra Vidyasagar #Birthday #দ্বিশতবার্ষিকী #মিথ #Birth-Anniversary #Celebration #কাহিনি

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

8

Unique Visitors

219112