দেশদ্রোহী
“আপনি কি ভেবে দেখেছেন কথাটা?” গম্বুজাকৃতি ঘরটার মেঝে-দেওয়াল-দরজা, মায় মধ্যিখানের লম্বা টেবিলটা অবধি, ফ্যাকাশে সাদা রং করা। গোটা ঘরে একটাই ছোট এলইডি জ্বলছে, তাই চারপাশটা আরও খানিকটা ভূতুড়ে ঠেকছে। অথচ, লোকটার কোনও হেলদোল নেই, থেকে থেকেই কান খুঁচিয়ে যাচ্ছে। জেনারেল একটু বিরক্ত হয়ে আরেকবার প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা জ্বালা তো! শুনলেন?” “কী করি বলুন তো স্যার! আমি তো ওসব পারব না।” “তাহলে পরিণাম যে ভালো হবে না সে খেয়াল আছে তো?” “হেঃ! তা আর নেই? যেদিন বাড়ি থেকে তুলে এনে এইটুকুন ঘুপচিতে রাখলেন, সেদিন থেকেই জানি।” “ওভাবে নিয়ে আসতে আপনিই বাধ্য করেছেন। যা মন চায় লিখবেন, যা মন চায় করে বেড়াবেন, দেশের কথা ভাববেন না, এমনটা তো দিনের পর দিন হতে দেওয়া যায় না।” “বটেই তো। সে আমি বিলক্ষণ মানি।” “আর এখানে তো কোনও অযত্নে রাখা হয়নি আপনাকে?” “না না স্যার! অল টাইম যত্ন। বেল টিপলে খাবার আসছে, সুইচ টিপলে লিফট আসছে। লাউঞ্জে হাঁটতে গেলেও একটা লোক পাছায় সেঁটে থাকছে, বোধহয় আমি হোঁচট খেলে ক্যাচ ধরবে বলে। আমার মা মরে যাওয়ার আগেও এত যত্ন নেয়নি, জানেন?” “নাগরিকদের সুবিধা দেখা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তা ছাড়া আপনার কিছু হলেই তো আবার সবাই বলবে আমরা বিরোধীদের গলা টিপে দিচ্ছি!” “কথা বন্ধ করার জন্য কি আর গলা টেপার দরকার হয় স্যার!” “এখ্খুনি কিন্তু বললেন সুযোগ-সুবিধার কোনও অভাব নেই!” “তাও, কোনও বই নেই, একটা কাগজ-পেনও নেই…” “ওই! ওইটার জন্যই তো যত ঝামেলা। আপনি লেখার অভ্যেসটা ছাড়লেই সমস্যা ছিল না। দিব্যি তো ট্রেনে হকারি করতেন, হঠাৎ লেখার শখ হল কেন?” “সে তো ছোটবেলা থেকেই চলছে স্যার। মা চলে গেলে, বাবা খুব যত্নে মানুষ করেছিল... না, এই আপনাদের মতো এত যত্ন কি আর পারে? মাইনে কম, এক কামরার ঘর… তবে অনেক গল্প বলত, প্রচুর পড়েছিল তো। সেসব শুনতে শুনতে আমিও গল্প বানিয়ে বানিয়ে লিখতাম। তারপর বয়স বাড়ল; একটা মেয়েকে ভালো লাগত, কবিতা লেখা শুরু হল। এইসব অভ্যেস কি ছাড়া যায়?” “আহা, কম বয়সে এগুলো সবাই করে। আমার ভাইপোই তো কবিতা লেখে, এভরি ডে।” “আরিব্বাস!”
“তবে? ওর এক একটা কবিতা কতবার রিট্যুইট হয় জানেন? মিলিয়ন ফলোয়ার্স! আপনি সেসব ট্রাই করলে পারতেন, হঠাৎ নাটক লিখতে গেলেন কেন? আর লিখলেনই যদি, ওই বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে, উঠতি বয়সের ছোঁড়াছুঁড়িগুলোকে দিয়ে অভিনয় করানোর কী দরকার ছিল? ফেসবুকে দেওয়া যেত না?” “আমি সোসাইটিতেই ঠিক আছি স্যার, ওই সোশ্যাল মিডিয়ায় ... না, থাক। তবে, মানতে হবে! মিলিয়ন ফলোয়ার্স! আমার তো মোটে একজন ফলোয়ার।” “সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই, ফলোয়ার এল কোত্থেকে?” “কেন? রাষ্ট্র! দেশের মানুষ আমায় না-ই ফলো করুক, দেশের সরকার তো আমায় ফলো করে। সবসময়।” “ঠাট্টা করছেন? আসল কথাটা বলুন না, বাচ্চাগুলোকে কেন ইনভল্ভ করলেন?” “ওদের তো স্কুলের বালাই নেই, এই নাটক করতে এসে দেখি একটু-আধটু লেখাপড়া হয়। একটু জানতে চায়, একটু বিবেচনা করতে শেখে। অবিশ্যি, সেইখানেই তো সমস্যা, তাই না স্যার?” “চ্যাংড়ামো হচ্ছে? এই মার্শাল কমিটির সামনে বসে তাদেরকেই ব্যঙ্গ করছেন? আমি যদি বলি আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল একটা আনরেস্ট ক্রিয়েট করা? যদি বলি, আপনি ওই ছেলেমেয়েদের ঢাল করে বিদ্রোহ উসকে দিতে চেয়েছেন?” “আমি তো সামান্য হকার স্যার, টেনেটুনে স্কুল পাশ। আমার কি এত ক্ষমতা আছে? আমার গরিব বাবা, আমায় শুধু একটা জিনিস দিয়ে যেতে পেরেছিলেন- জানার ইচ্ছে, প্রশ্ন করার তাগিদ। আমি সেইটা ওদেরকেও দিতে চেয়েছি। কাউকে উসকাইনি স্যার। কোনও বিদ্রোহ করিনি।” “করেননি? স্বপ্ন দেখতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে, মানুষের ভালো করতে হবে- এসব কথা নাটকে বলেননি? নিজের পরিচয় গোপন করে সেই নাটকের বই ট্রেনে ট্রেনে সকলকে বিক্রি করেননি? কী যেন, ‘কলন্দর’... এমন ছদ্মনাম নেওয়ার আর কী কারণ থাকতে পারে?” “আজ্ঞে, বরুণ গুছাইত নামে বই লিখলে কেউ কিনতে চায় না যে! কলন্দর নামটায় একটা ইয়ে আছে, বলুন? যাযাবর কথকঠাকুর টাইপ! আর বই বিক্রি করে বিদ্রোহের স্বপ্ন ফেরি? কিছু মনে করবেন না স্যার, মধ্যবিত্তদের এখনও এত ভয় পান আপনারা?” “এক থাপ্পড় মারব স্কাউন্ড্রেল! আমাদের ক্ষমতা জানিস?” “আঃ স্যার! এইবার ঠিক আছে, এতক্ষণ কেমন সমানে সমানে কথা বলছিলেন। ওসবে আমি অভ্যস্ত নই, হেঁ হেঁ।” “জেনারেল, সংযত হন। বরুণবাবু, পরিস্থিতিটা ভালো করে বুঝুন। নাটক একটা ইনফিরিয়র ফর্ম অফ প্রিমিটিভ আর্ট। এতে মানুষকে সহজে ভুল পথে চালনা করা যায়। অথচ রাষ্ট্রের বারণ সত্ত্বেও আপনি নাটক লিখেছেন, সেগুলোর পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন, এমনকি ডেমনস্ট্রেশন করেছেন, ইয়াং রিসোর্সকে ভুল বুঝিয়ে তাদের ইনভল্ভ করেছেন। কাদা ঘেঁটে নোংরা তো কম করেননি, এখন নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে প্রাণ ভিক্ষা করলে হয়তো সাজা কম হবে।” “বাবা তো ভিক্ষা করা শেখাননি স্যার।” “আশ্চর্য মানুষ তো আপনি! বাঁচার ইচ্ছে নেই? এখনও চল্লিশ পেরোননি, দুনিয়াটা দেখার ইচ্ছে নেই?” “আমি তো মানুষ দেখেছি স্যার, আর বই পড়েছি। অনেক বই। অনেক মানুষ। আমার দুনিয়া যত বড় হয়েছে, আপনাদের দুনিয়া তত ছোট হতে থেকেছে। আমি মরে গেলেও তো আপনার দুনিয়া আর বাড়বে না।” “মৃত্যুর সাজা সামান্য সাজা, আপনি বেঁচে থাকবেন। শুধু পৃথিবী থেকে আপনার অস্তিত্ব মুছে যাবে। কেউ জানবে না যে আপনি আছেন; একটা সময়ের পর, আপনিও...। যাকগে, শেষ ইচ্ছা-টিচ্ছা কিছু থাকলে, এই কমিটির সামনে বলে দিন।” “বইহীন, বান্ধবহীন নির্বাসন তো মৃত্যুরই সামিল স্যার। একটা বই সবে পড়া শুরু করেছিলাম, শেষ করে যাওয়া যায়?” “বলিহারি! কী নিয়ে সে বই?” “আমাদের নিয়ে স্যার। আমার মতো দুনিয়াদারদের নিয়ে লেখা। আপনার মতো সম্রাটদের নিয়ে লেখা। কীভাবে আপনার রাজত্বের বেড়া টপকে ডানা মেলে আমার কল্পনা, আবার কীভাবে সেই কল্পনার রং শুষে আপনার সাম্রাজ্যের সীমানা বেড়ে চলে, সেইসব আখ্যান নিয়ে, বড় ভালোবাসা দিয়ে ইতালো ক্যালভিনো সাজিয়েছেন তাঁর সাধের ‘Invisible Cities’। পড়ে দেখবেন নাকি স্যার?”
(গল্পে ব্যবহৃত ‘কলন্দর’-এর ভাবনা ‘অন্তর-রঙ্গ’ নাট্যগোষ্ঠীর ‘হেরো রাজার কলন্দর’ নাটক থেকে অনুপ্রাণিত)
অলংকরণ: সোমদত্তা চক্রবর্তী
#story #sunday #Sayandeep Gupta #Raise your voice #Freedom of speech #Freedom of thinking #Say no to oppression #গল্প #সায়নদীপ গুপ্ত #দেশদ্রোহী #কথা বলার স্বাধীনতা #চিন্তার স্বাধীনতা