গল্প

আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে

রোহণ কুদ্দুস April 11, 2021 at 8:17 am গল্প

দোকানটা বাবার। নাম রেখেছিল ঠাকুমা। বলাকা। দাদুর ইচ্ছে ছিল বইয়ের দোকান হোক। কিন্তু বাবা খুলে বসল কফিশপ। দাদু রসিকতা করে বলত ‘পানশালা’। প্রতি সপ্তায় একদিনই খোলা হত এই পানশালা। শনিবার সকাল দশটা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। বাবা চলে যাওয়ার পর এখন আমার ওপর দায়িত্ব বর্তেছে। প্রতি শনিবার। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত। আমার ছুটি নেই। টানা বত্রিশ বছর।

আজ সকালে বলাকায় এসে টেবল-চেয়ার মোছামুছি করছি, সে এল। অন্য সপ্তার মতোই। প্রথম খদ্দের। হালকা গোলাপি সিল্কের শাড়ি। কপালে ছোট লাল টিপ। একটা লম্বা বিনুনি। দেখে মনে হয় সাতের দশকের সিনেমার পর্দা থেকে নেমে এসেছে আমাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে। আমি মনে মনে তার নাম দিয়েছি প্রভা।

আজও প্রভা এসে বসল তার নির্দিষ্ট টেবলে। এক কোণের সেই টেবলের দুদিকে দুটো চেয়ার। দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে সে। হাতের কাজ শেষ করে আমি তার প্রথম পাত্র হাতে হাজির হলাম। ল্যাটে। নিঃশব্দে একটা কোস্টার টেনে টেবলে কাপটা রাখলাম। সঙ্গে একটা ছোট প্লেটে তিনটে বিস্কুট। প্রত্যেক সপ্তার মতো চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখা বাদামি ব্যাগটা থেকে সেই ছবিটা টেনে বের করল প্রভা। 

“একে দেখেছেন?”

ছবিতে এক তরুণ আর তরুণী। পাশাপাশি বসে। কোনও ফোটো স্টুডিওতে তোলা। রঙিন সেই ছবির তরুণীর পরনে গোলাপি সিল্কের শাড়ি। কাঁধে বাদামি ছোট ব্যাগ। তিন দশকে এই ছবি একইরকম থেকে গেছে। তরুণীটির মতোই। সে ব্যগ্র চোখে তরুণটির দিকে দেখায়— “একে দেখেছেন? এখানে এসেছিল?” চেক শার্ট পরিহিত মোটা ফ্রেমের চশমা পরা বাবরি চুলের সেই তরুণের দিকে তাকিয়ে নিরুত্তর থাকি সাধারণত। আজ মাথা নেড়ে বললাম, “না। এখানে আসেনি।” তরুণীর নিষ্প্রভ মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি টেনে আনি— “কে বলতে পারে, আজ হয়তো আসবে।”

প্রভা একটা বই খুলে কফির কাপ টেনে নিল আলগোছে। এভাবেই ঘণ্টা দু-এক পর পর তাকে কফির জোগান দিয়ে যাই। মাঝরাতে দোকান বন্ধ করার সময় হলে ধীরে ধীরে সে বেরিয়ে যায়।


একটু পরেই শুরু হল নিয়মিত খদ্দেরদের আগমন।

ইনস্পেক্টর সুবিমলবাবু বাবার বন্ধু ছিলেন। চাকরিতে দু-দশক কাটানোর পরে কোনও এক অপরাধীচক্রের নেকনজরে পড়েন। তারপর যা হয় আর কি। প্রথমটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। সুবিমলবাবু নিজে বোধহয় খবর পেয়েছিলেন তাঁর কোনও চর মারফত। একদিন বাজারের মাঝে তাঁকে কারা যেন ক্ষুর মারল। ডাক্তার ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। তারপরও একসপ্তা যমে মানুষে টানাটানি চলল। শেষে যমেরই জয় হল। তারপর থেকে তিনি বলাকায় প্রতি শনিবার আসেন।

সুবিমলবাবুর দাবার সঙ্গী অম্লান চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি বোধহয় সালকিয়ার দিকে। ইংরাজি পড়াতেন স্কুলে। ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। অবসর নেওয়ার কিছুদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার সময় বাসের পাদানি থেকে হাত ফসকে চাকার তলায় চলে গেলেন। তিনি ঢুকতেই সুবিমলবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন— “মাস্টার, আজ পয়সা এনেছ তো? গত সপ্তায় বাজি হেরেছিলে।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালেন— “পুলিশের কাছে স্কুলমাস্টার কিস্তিমাত।” জানালার কাছে নির্দিষ্ট টেবলে তাঁরা বোর্ড সাজাতে সাজাতে অম্লান চট্টোপাধ্যায় ইশারা করলেন। তাঁদের জন্যে একটা বড় কফি পট আর দুটো কাপ দিয়ে আসতে হয়।

তাঁদের পরের টেবলে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছে এক যুবক। নির্ঘুম চোখ, উশকোখুশকো চুল তার। পার্টির কাজকর্ম মেনে নিতে না পেরে একবুক অভিমানে গলায় দড়ি দিয়েছিল সে। কফির থেকে খবর কাগজই খায় সে বেশি। প্রতি সপ্তাতেই একটাই কাগজ সে কী যে এত পড়ে কে জানে। আড়চোখে দেখেছি তারিখ ১৫ মার্চ ২০০৭। এমন মুখ গুঁজে থাকে যে হেডলাইন দেখার সুযোগ হয়নি কোনোদিন। মাঝে মাঝেই গলা থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ে— “হুঁঃ!” বা “যত্তসব!” একে বেশি ঘাঁটানোর সাহস হয় না। আর কফি নেবে কি না জিজ্ঞাসা করাতে একবার লাল চোখ মেলে ধরেছিল— “বাবার বানিয়ে দেওয়া কফিশপে বসে বসে লোকজনকে কফি খাওয়াচ্ছেন। পয়সাটা কে দেবে?”


সত্যি বলতে কী, পয়সা এ কোনোদিনই দেয়নি। সারাদিন বসে বসে দু-তিন কাপ কফি খেয়ে সন্ধের মুখে বিদায় নেয়। অবশ্য শুধু এর কথাই বা বলি কেন? ঠিকঠাক টাকাপয়সা কে-ই বা আর মেটায়? কেউ কেউ কবেকার দু-টাকা বা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দেয়। একজন তো একবার তিন ডলার দিয়েছিল। পরে ভাঙিয়ে শ-,দেড়েক টাকা পাওয়া গিয়েছিল। কে যেন নিজের চুলের ক্লিপও খুলে দিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত কলেজপড়ুয়া ওই চারজনের দলটার কেউ হবে। সারাক্ষণ একটা টেবল ঘিরে ধরে নিজেদের মধ্যে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর। আর মাঝে মাঝে হি-হি-হা-হা। টুকরোটাকরা কথাবার্তায় বুঝেছি ক্লাস ট্রিপে একটা বাসে করে এরা মুর্শিদাবাদ যাচ্ছিল।

এরা সারা সপ্তা কোথায় থাকে, কোথা থেকে আসে আমার জানা নেই। এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যায় সে ধারণাও নেই। বাবা শেষদিন পর্যন্ত কিছু বলে যায়নি। প্রথম শনিবার দোকান খোলার পরে আস্তে আস্তে ধারণা পেতে থাকি। মরণের ওপার থেকে এই মানুষগুলো কীসের টানে প্রতি শনিবার এখানে ফিরে ফিরে আসে জানি না। কিন্তু সে টান আমারও কম নয়। রবিবার থেকে দিন গোনা শুরু হয় আমার। সারাজীবন কোথাও যাওয়াই হল না এই জন্যে। আমি না থাকলে সপ্তার শেষে বলাকার দরজা খুলে দেবে কে?    

   

“তারপর? আজ কী প্ল্যান?” আমার কাছে এগিয়ে এসে হলদেটে দাঁত বের করে প্রশ্ন করছে প্রসন্ন সান্যাল। বিকেলও নামেনি ঠিক করে। এর মধ্যেই কোথা থেকে সুরাপান করে হাজির হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলে বলে খাঁটি হুইস্কি। কফির একটা বড় মাগ বাঁধা তার জন্যে। 

আমি তার মুখের দুর্গন্ধ এড়াতে মুখ নামিয়ে কফির ব্যবস্থা করতে থাকি। নাছোড়বান্দা প্রশ্ন তবু—“আজ কী প্ল্যান তাহলে? দোকান বন্ধ করে চলো আমার সঙ্গে।” পেছন থেকে আর এক প্রৌঢ় টিপ্পনি কাটেন— “এই নাও এসে গেছে তোমার চুনিলাল!” প্রসন্ন টাল সামলে ঘুরে দাঁড়ায়— “একদম বাজে বকবে না। আমি তোমাদের মতো প্রিটেনশাস পিগ নই।”

আস্তে আস্তে বিকেল আরও কমলা হয়। টেবলগুলো ভরে উঠেছে। নিজেদের অভ্যাসমতো কেউ নীরব আবার মুখর। একচিলতে চকোলেট কেক নিয়ে এগিয়ে গেলাম প্রভার টেবলে। বই থেকে মুখ তুলে শুকনো গলায় বলল, “আজ শরীরটা ভালো লাগছে না।” তারপর একটু থেমে রাস্তার দিকের বড় জানালাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে।”

সত্যিই ঝড় উঠল সন্ধের মুখে। আমাদের বড় আলোগুলো জ্বলে উঠেছে ততক্ষণে। একবার যেন দপদপ করে উঠল। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎ করে গ্লাসডোর ঠেলে হুড়মুড় করে ঢুকলেন এক বৃদ্ধ। বিভ্রান্ত চাহনি। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে হঠাৎ করে ঢুকে পড়েছেন মনে হল। পরনে নার্সিংহোমের গাউন। নীল রঙের পাতলা সেই পোশাক থেকে, তাঁর আঙুলের ডগা থেকে, চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে। একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে সবাই নিজের নিজের আলোচনায় ফিরে গেল। শুধু একজন নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রভা।

চেয়ার-টেবলের সারির মধ্যে দিয়ে বৃদ্ধর দিকে এগিয়ে গেলাম। সামান্য কাঁপছেন ঠান্ডায়। আমার কাঁধের তোয়ালেটা এগিয়ে দিলাম। সেটা হাতে নিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে প্রভা। অস্ফুটে সে উচ্চারণ করল— “বিভাস!” বৃদ্ধ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে ধূসর হাসলেন— “তুমি!”


তরুণের সেই বাবরি চুল বিদায় নিয়েছে। পাতলা চুল থেকে সযত্নে জল মুছিয়ে দিচ্ছে তরুণী। তাদের টেবলে এক কাপ কড়া কফি নিয়ে গেলাম। 

“শীতটা কেটে যাবে।”

বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন— “থ্যাংকিউ।”

আমি ইতস্তত করে বললাম, “আমার কাছে শুকনো জামাকাপড় আছে। আপনি চেঞ্জ করতে চাইলে…”

বাবার একজোড়া শার্ট-প্যান্ট তোলা ছিল একটা ক্যাবিনেটে। ক্যাফিনের ঘ্রাণ ছাপিয়ে ন্যাপথালিনের মন হুহু করা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল একনিমেষে। কাউন্টারের একচিলতে আড়ালে বৃদ্ধ সেই জামাকাপড় পরে আবার গিয়ে বসলেন প্রভার সামনে। তার হাতের ওপর শীর্ণ শিরা ওঠা হাত রেখেছেন। পরম মমতায় প্রভা তাঁর আঙুলে নিজের আঙুল তুলে নিয়েছে। অস্ফুটে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সামান্য ঈর্ষায় ক্ষণিকের জন্যে বুক চিনচিন করে উঠল।


একটু পরে নিজের চেয়ার থেকে উঠে এল প্রসন্ন সান্যাল।

“তাহলে কী প্ল্যান?”

আমি বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করলাম— “কীসের প্ল্যান?”

প্রভাদের টেবলের দিকে ইশারা করল— “ওদের কী হবে? ওরা কি একসঙ্গেই…”

এ প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। এখান থেকে সবাই একা-একাই বেরোয়, এতদিন তা-ই দেখে এসেছি। আজ কী হবে তা আমার জানা নেই। তবু প্রসন্ন সান্যাল আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে রেখেছে। আরও কেউ কেউ হয়তো একইরকম প্রশ্ন করছে মনে মনে। রাত বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে।

এমন সময় প্রভা উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সেই বৃদ্ধও। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। হাতে হাত রেখে তারা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। এমন সময় কে যেন হাততালি দিয়ে উঠল। খবর কাগজ নিয়ে বসে থাকা সেই রাগি যুবক। আজ দুর্যোগে আটকে পড়েছে সে। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে হাততালি দিতে শুরু করেছে। ক্রমে সবাই নিজের নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে শুরু করল। সমবেত সেই করতালির মধ্যে আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে সলজ্জ হেসে রঙিন ফোটোগ্রাফের সেই একজোড়া মানুষ বলাকার দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেলেন।


বারোটা বেজে গেছে। কাউন্টারে বসে টাকাপয়সা গুনছি। এত বছরে আজ সবথেকে বেশি বিক্রি হয়েছে আমার পানশালায়। মোটমাট তিনশো বাইশ টাকা। একটা বড় সবুজ মার্বেল। ইস্তানবুল থেকে কলকাতার ব্যবহৃত একটা এয়ার টিকিট। 

একে একে আলো নেভানো হচ্ছে। তবু কারও যেন ফেরার তাড়া নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে এখনও। আজ হঠাৎ করে অনুভব করা গেল সকলেই আসলে অপেক্ষায়। শুধু প্রভাই কী করে যেন জানত সেটা।   

সুবিমলবাবুর কথায় অম্লান চট্টোপাধ্যায় গান শুরু করলেন— “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে…”

বাইরে মেঘ কেটে গেছে। বলাকার টেবলে চেয়ারে ম্লান চাঁদের আলো এসে পড়েছে বড় জানালাটা দিয়ে।



[ অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র ]
#বাংলা #গল্প #রোহণ কুদ্দুস #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

0

Unique Visitors

181887