নাট্যজগৎ ও পিকাসো
চতুর্থ পর্ব: নাট্যচরিত্র পিকাসো
***************************
নগরায়ণের গতি, বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিশ শতকে রাজনীতি, সমাজব্যবস্থার পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের আঙিনাতেও প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই অগ্রগতির ফলস্বরূপ শিল্প-সাহিত্যে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। চিন্তাভাবনার পরিবর্তনের ছায়াসঙ্গী হয়ে ক্রমবিকাশ ঘটতে শুরু করে নতুন ধরনের শিল্পকর্মের। সাহিত্যক্ষেত্রে জন্ম হয় ‘স্ট্রিম-অফ-কন্সিয়াসনেস’ ধারার উপন্যাসের, ফরাসি সিম্বলিস্ট থিয়েটারের থেকে প্রভাবিত হয়ে পিকাসোর হাত ধরে শিল্পকর্মের জগতে উদয় হয় ‘কিউবিস্ট ঘরানা’র। এইসবের সঙ্গে শুরু সাহিত্য ও শিল্পের যুগলবন্দী। আর এই মিলনক্ষেত্রের পথিকৃৎ ছিলেন পিকাসো। বার্সেলোনা ও প্যারি দুই শহরেই পিকাসো বিভিন্ন শিল্পচক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ফলে নানা ধরনের শিল্পধারার সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ছিল পিকাসোর। প্যারি-র নক্ষত্রখচিত শিল্পীমহলে যুক্ত থাকার সুবাদে পিকাসো নাট্যজগতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, ব্যালে ও অন্য নাটকের মঞ্চসজ্জার কাজ করেছেন জীবনের একটা দীর্ঘ সময়। পরবর্তীতে নিজে রঙ-তুলি ছেড়ে কাগজ-কলমে মনোনিবেশ করেন, লিখে ফেলেন দুটি নাটক। পাঁচের দশকের শেষদিক থেকে তিনি প্রত্যক্ষভাবে আর নাট্যজগতের সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। কিন্তু পিকাসোর নাট্যজগতের সঙ্গে এই সংযোগ তাঁর এই মঞ্চসজ্জা ও নাট্যরচনাতেই শেষ হয়ে যায়নি। পিকাসো নিজে যুক্ত না থাকলেও, নাট্যজগত তাঁর কাছে ফিরে এসেছে বারবার। পিকাসোর জীবন, কর্মকান্ড নাট্যজগতকে প্রভাবিত করেছে এবং করে চলেছে তাঁর মৃত্যুর পরেও। অন্য নাট্যকারদের রচনায় চরিত্ররূপে পিকাসো বারবার ফিরে এসেছেন, বারবার ফিরে এসেছে তাঁর বর্ণময় জীবন।
পিকাসোর শিল্পকর্মকে কেন্দ্র করেও নাটক রচিত হয়েছে, ফের্নান্দো আরাবাল-এর Guernica (১৯৬১), হেরোনিমো লোপেজ মোসো-র Guernica (Happening) (১৯৬৯) এবং ফ্রান্সিস্কো তোরেস মনরেয়াল-এর Guernica and After (১৯৮২) – এই তিনটি স্পেনীয় নাটক পিকাসোর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘গের্নিকা’কে কেন্দ্র করেই রচিত। আরাবাল-এর নাটকটি একটি একাঙ্ক নাটক যেখানে নাটককার গের্নিকার ধ্বংসের সময়ে মানব-সম্পর্ক, হতাশা ও মুনাফাদখল – এই সবকিছুকে দেখেছেন ‘অ্যাবসার্ডিস্ট’ দৃষ্টি থেকে। নাটকটিতে মাত্র একবারই পিকাসোর নাম উচ্চারিত হলেও এটিই প্রথম নিদর্শন যেখানে পিকাসো পুনরায় ফিরে আসছেন নাট্যজগতে, প্রভাবিত করছেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের। মোসো-র নাটকটিতে চরিত্রেরা পিকাসোর বিখ্যাত চিত্রকর্মটিকে পুনরায় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, যেন তারা এক প্রহেলিকা তৈরি করছে। তারা গের্নিকা বোমাবর্ষণের দিন সকালে কী করছিল সেই নিয়ে কথা বলতে থাকে। এভাবে তারা যেন ফিরিয়ে দেয় একটি “context that is missing from the painting”, বলেছেন এলিজাবেথ ড্রাম। মোসো তাঁর নাটকে কাব্য, স্বগতোক্তি ও চিত্রটির অভূতপূর্ব প্রয়োগ করেছেন যা পিকাসোর চিত্রকর্মটিকে আরও ভালো করে বুঝতে সাহায্য করে। মনরেয়াল-এর নাটকটি আসলে পিকাসোর শিল্পকর্ম ও নাট্যকর্মের প্রতি এক শ্রদ্ধার্ঘ্য। তিনটি ভাগে বিভক্ত এই নাটকটির প্রথম ভাগে পিকাসোর প্রথমদিকের আঁকা ‘কমেদিয়া দে’লার্ত’ চরিত্রগুলিকে উপস্থাপিত করা হয়, দ্বিতীয় ভাগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার দৃশ্যে এই চরিত্রেরা পালিয়ে যায় এবং তৃতীয় ভাগে যুদ্ধশেষে তারা আবার ফিরে আসে। গোটা নাটক জুড়েই নাটককার পিকাসো বিভিন্ন শিল্পকর্মের ছবি মঞ্চে দেখিয়েছেন, কখনও ‘পারাড’-এর যবনিকাকে, কখনও ‘গের্নিকা’কে।
পিকাসোর জীবনকে নিয়েও অনেক নাটক রচিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে প্রথম দিকের নাটক হল মেরি গেজ রচিত My Name is Pablo Picasso (১৯৮৪)। নাটককার তাঁর এই নাটকটি সম্পর্কে বলেছেন “I wrote a Cubist play which breaks the traditional rules of theatre just as Picasso defied the traditional rules of art”. এই নাটকে পিকাসোর জীবনের প্রসঙ্গ এসেছে, নাটকটির অনেকাংশে পিকাসোর প্রেমিকা ফার্নান্দে ওলিভিয়ের ও পিকাসোর সম্পর্ক নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। মার্গারেট হলিংসওয়র্থ রচিত Poppycock (১৯৮৭) নাটকেও পিকাসোর ব্যক্তিজীবন ধরা পড়েছে। পিকাসো ও তাঁর সঙ্গিনী, চিত্রকর, ডোরা মার-এর সম্পর্ক, কথোপকথন নিয়ে নাটকটি লেখা হয়েছে। হলিংসওয়র্থ ও তাঁর সহপাঠীরা ‘ক্লাউনিং টেকনিক’ নামে একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন, যেখানে তারা মাস্ক তৈরি করেন ও চরিত্র গঠন করেন সেই মাস্কের ভিত্তিতেই। তাঁর নিজের এই নাটক সম্পর্কে হলিংসওয়র্থ বলেছেন, “Much of my work explores the power politics between men and women, and clowning provided me with an excellent tool with which to mine this territory in a non-naturalistic way. Clowning deals in extremes, so I chose to go with three of the most powerful men in the century and look at them in a relationship with one woman who had featured in each of their lives.”
পিকাসোকে নিয়ে লেখা নাটকগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল স্টিভ মার্টিন রচিত Picasso at the Lapin Agile (১৯৯৬)। নাটকটি ১৯০৪ সালে প্যারি শহরের লাপাঁ আজিল ক্যাফে-কে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। উক্ত ক্যাফেটি বিশ শতকের শুরুর দিকে শিল্পী, লেখকদের জনপ্রিয় আড্ডার স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। এই নাটকটি শুরু হয় ঐ ক্যাফেতে আইনস্টাইনের আগমন দিয়ে। পিকাসোকে নাকি ঐ ক্যাফেতে প্রায়শই দেখা যায়, এমনটা শুনে সুস্যান নামের এক মহিলা সেখানে আসেন পিকাসোর খোঁজে। আইনস্টাইন ক্যাফের পরিচারিকা জার্মেন-র সঙ্গে তাঁর নতুন বই The Special Theory of Relativity নিয়ে কথা বলতে উদ্যত হন। অন্যান্য চরিত্রেরা নতুন শতাব্দীর আগমন ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে থাকে। এমনসময় সাগু নামে এক শিল্প-ব্যবসায়ী সেখানে আসেন শিল্পী মাতিস-এর একটি চিত্রকর্ম নিয়ে। তারা সকলেই পিকাসোর সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব। পিকাসোর সেখানে আবির্ভাবের পর পিকাসো ও আইনস্টাইনের বার্তালাপই নাটকটির কেন্দ্রবিন্দু হয়। তাঁরা দুজনেই নিজেদের কাজ সম্পর্কে সাদা কাগজে প্রকাশ করতে থাকেন, দেখা যায় দুজনের কাজই আসলে ফর্মুলা – আইনস্টাইনের ফর্মুলা সংখ্যা ও অক্ষরে পরিপুর্ণ আর পিকাসোর ফর্মুলা লাইন ও ছবিতে। দুজনেই যেন এক স্বপ্ন এঁকেছেন যা বাস্তবে অসম্ভব। ঐ ক্যাফে এক নতুন ব্যক্তি আসেন যিনি নাকি টাইম-ট্র্যাভেল করে এসেছেন পিকাসোকে তাঁর পরের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘ল্য দ্যমইসেল দ্য’আভিগনঁ’ সম্পর্কে জানাতে। মার্টিন ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঘটনাসমূহকে একসুতোয় বেঁধেছেন, বিশ শতকের দুই সর্বজনবিদিত চরিত্রের নিজেদের ভিন্নধর্মী কর্মক্ষেত্রে এক ‘কমন গ্রাউন্ড’ খোঁজার চেষ্টাকে দেখিয়েছেন।
১৯৯৯-তে ব্রায়ান ম্যাকআভেরা পিকাসো ও পরিবার এবং বন্ধুদের নানা স্মৃতিকথার ওপর ভিত্তি করে Yo! Picasso!: Beside Picasso নামে একটি নাটক লেখেন যেখানে তিনি পিকাসো ও পুরোনো বন্ধু হাইমে সাবার্তেস-এর মধ্যে এক কাল্পনিক কথোপকথন দেখান। পিকাসো ও সাবার্তেস-ই নাটকের একমাত্র চরিত্র, তারাই পিকাসোর জীবনের বিভিন্ন পুরুষ ও মহিলার ‘রল-প্লে’ করে নাটক জুড়ে। নাটকে দেখানো হয় সাবার্তেস বলছেন পিকাসোর তাঁর মহিলা সঙ্গীদের প্রতি খারাপ ব্যবহারের ব্যাপারে বোঝা দরকার, অনুশোচনা করা প্রয়োজন। জেফ্রি হ্যাচার ২০০৩-এ A Picasso শিরোনামে একটি নাটক লেখেন। নাটকটি ১৯৪১-এর নাৎসি দখলে থাকা প্যারি শহরকে নিয়ে লেখা যেখানে পিকাসোকে ডাকা হয়েছে নাৎসিদের দখলে আসা তিনটি চিত্রকর্মের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য। পিকাসোকে বার্লিনের নাৎসি সংস্কৃতি মন্ত্রকের মিস ফ্লেচার নামের এক মহিলা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। পিকাসো মিস ফ্লেচারের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জানেন এবং বেশকিছু ‘মাইন্ড গেম’-এর মাধ্যমে তার উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করতে উদ্যত হন।
এরিয়েল ডর্ফম্যান-এর Picasso’s Closet (২০০৬) নাটকে নাটককার একটি প্রশ্ন করেছেন কি হত যদি পিকাসো ১৯৭৩ পর্যন্ত বাঁচতেন না, যদি ১৯৪৪ সালেই তিনি নাৎসিদের হাতে খুন হয়ে যেতেন! তাঁর এই নাটক প্যারি-র বন্দিদশায় পিকাসোর জীবন কেমন ছিল সেটি বোঝার চেষ্টা করে। নাৎসি দখলের দিনগুলিতে পিকাসো কীভাবে দিন কাটাতেন, তাঁর বন্ধুমহলে ইহুদিদের যখন কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনিই বা কী করেছিলেন – এসব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন নাটককার।
পিকাসোর জীবন ও শিল্পকর্ম পদে পদে অন্যান্য নাট্যকার ও শিল্পীদের প্রভাবিত করে এসেছে। পিকাসো হয়ে উঠেছেন তাঁদের ‘সোর্স অফ ইন্সপিরেশন’। আর তাঁরা ঘটিয়েছেন ব্যক্তি পিকাসো ও শিল্পী পিকাসোর জীবনের এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন নাটকে, শিল্পকর্মে। এই ধারা আগামীদিনেও বজায় থাকবে একথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।
**********************************
আরও পড়ুন: নাট্যজগৎ ও পিকাসো - ১ম পর্ব
তথ্যসূত্র:
Drumm, Elizabeth. Painting on Stage: Visual Art in Twentieth-Century Spanish Theater. USA: Rosemont Publishing & Printing Corp., 2010.
Hollingsworth, Margaret. Poppycock in “Endangered Species”. Toronto: Act One Press, 1988.
Martin, Steve. Picasso at the Lapin Agile and Other Plays. New York: Grove Press, 1996.
“Mary Gage - Screenwriter, Author and Playwright.” Mary Gage - Screenwriter, Author and Playwright. Web. 06 June 2012. http://marygage.net/plays.htm.
McAvera, Brian. Yo! Picasso!: Beside Picasso. London: Oberon Books, Ltd., 2002.
Arrabal, Fernando. Guernica and Other Plays. Trans by Barbara Wright. New York: Grove Press, Inc., 1967.
Richardson, John. A Life of Picasso: Volume I: 1881-1906. New York: Random House, 1991.
--- A Life of Picasso: Volume II: The Painter of Modern Life, 1907-1917. New York: Random House, 1996.
--- A Life of Picasso: Volume III: The Triumphant Years, 1917-1932. New York: Alfred A. Knopf, 2007.
--- The Mediterranean Years: 1945-1962. London: Gagosian Gallery, 2010.
#পাবলো পিকাসো #চিত্রশিল্প #নাটক # নাট্যজগৎ #কিউবিজম # সিরিজ #সিলি পয়েন্ট #অলর্ক বড়াল #বাংলা #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #web portal