‘তেনা’-দের গ্রাম
১ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ভূত-শিকারি মেজকর্তা’-র একটি গল্প ‘মাথায় চন্দ্রবিন্দু’। সেই গল্পে পাই –“কোনও রকমে বেনাপোলের হাটে গিয়ে পৌঁছে গেঁয়োখালার রাস্তাটা ধরে এগোলেই হল। গোটা অঞ্চলটারই মাথায় যেন চন্দ্রবিন্দু দেওয়া। সব সেই ‘তেনা’দের রাজত্ব। ” একটা-আধটা ভূত নয়, একেবারে “গোটা অঞ্চলটার মাথাতেই যেন চন্দ্রবিন্দু দেওয়া” ! কী করে সম্ভব তা ? সম্ভব ! বাংলা ভূতের গল্পেই একমাত্র সম্ভব ! কারণ, ম্যালেরিয়ার মহামারি ! মহেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দের ভাই, তাঁর ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ নামের চমৎকার বইটিতে লেখেন –“তখন বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া ছিল না। আমাদের শৈশবে প্রথম ম্যালেরিয়া আরম্ভ হইল। বাংলাদেশ ছাইয়া ফেলিল। ..... ম্যালেরিয়ার ভয়ে সকলে আসিয়া কলিকাতায় আশ্রয় লইল। ... বর্ধমান তখন খুব স্বাস্থ্যকর স্থান। রেল-পথ খোলা হইলে চারিদিকে ম্যালেরিয়ার জ্বর উঠিল। ” শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসে জ্ঞানদার মামী ভামিনী বলেছিল - “পল্লীগ্রামে সাপের কামড়ে আর ক’টা লোক মরে, মরে যা তা ঐ ম্যালোয়ারিতে। ” ১৮৬২ সালে বর্ধমান জেলার মহামারির কারণ জানতে লাটসাহেব সিসিল বীডন নিয়োগ করলেন ডঃ এলিয়টকে। রিপোর্টে গ্রামের নিকাশি ব্যবস্থার খারাপ হাল, পুকুরের মজে-যাওয়া অবস্থা আর বসতবাড়িতে আলো-হাওয়ার সমস্যার কথা লেখা হল ; সরকারি উদ্যোগে এ’সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টাও হল। তবু ১৮৬৩- ৬৪ সালে মহামারি আরো ব্যাপক আকার ধারণ করল। বাধ্যত সরকার নড়েচড়ে বসে তৈরি করলেন কমিশন আর তাতেই ঠাঁই পেলেন একমাত্র ভারতীয় সদস্য রাজা দিগম্বর মিত্র। ১৮৬৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশ পেল কমিশনের রিপোর্ট। বাকি বিদেশি সদস্যদের থেকে বেসুর গেয়ে দিগম্বর মিত্র জানালেন গ্রামবাংলার নিকাশি ব্যবস্থাকে কৃত্রিমভাবে অবরুদ্ধ করে রেলপথ, প্রধান সড়ক এবং উঁচু বাঁধ দেবার ফলেই ম্যালেরিয়া-মহামারির সৃষ্টি। কলকাতা মেডিকেল কলেজের ডাক্তার কার্তিক বসু তাঁর সম্পাদিত ‘স্বাস্থ্য সমাচার’ পত্রিকায়, ১৯৩০ সালে, বর্ধমানের ম্যালেরিয়া মহামারির কারণ হিসাবে দিগম্বর মিত্রের রিপোর্টকেই সমর্থন জানান।
২ ছোটদের গল্প ‘রাতের অতিথি’-র (প্রথম প্রকাশ : ৯ পৌষ, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) গোড়াতেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন - “তোমরা জান না, সে অনেক দিনের কথা, তখন ভারতবর্ষে প্রথম রেল এসেছে। সেই সময় একবার মৃত্যু দেবতার ক্রূর দৃষ্টি এই বাংলা দেশের উপর পড়েছিল। দেয়ালীর সময় যেমন পোকা মরে তেমনি মানুষ মরে দেশ একেবারে শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। নির্জিত নিস্তেজ জাতির উপর বিধাতার এই ক্রোধ যে মহামারীরূপ ধরে দেখা দেবে এ কেউ কল্পনা করতে পারেনি।” বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন শরদিন্দু, সেই আমলের - “সে সময় গ্রামের পাশ দিয়ে রেল লাইন যাবার উঁচু বাঁধ তৈরি হচ্ছিল… গ্রামের লোকেরা হাঁ করে তাদের কাজ দেখত আর ভাবত, না জানি এসব কি হচ্ছে। রেল তারা কখনো দেখিনি তাই এই উঁচু পাড়ের অর্থ কিছুই আন্দাজ করতে পারত না ; কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ বুদ্ধিমান লোক ছিল, সে মাথা নেড়ে বলত, ‘এসব ভাল ব্যবস্থা নয়, কোম্পানী মাটি কেটে জাঙ্গাল তৈরি করছে, বর্ষার জল বেরুতে পাবে না ; তখন দেশের কি অবস্থা হবে !’” এক রাত্রে, এই মৃত্যুঞ্জয় ঘোষেরই আতিথ্য নিল অদ্ভুতদর্শন বিচিত্রস্বভাব এক অতিথি ! শেষ রাত্রে অতিথি কালো কঙ্কাল হয়ে, তাঁর লাঠির আগায় শ্মশানের আগুন নিয়ে রেলপথ বরাবর ছুটতে লাগল। সে আগুন থেকে ধোঁয়া নয়, “যেন রাশি রাশি কালো পোকা” বের হতে লাগল। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নের উত্তরে “রাতের অতিথি” জানাল - “আমি অগ্রদূত, আমার সঙ্গীরা সব আসছে। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি আসছে। বাংলাদেশ ছেয়ে যাবে - ঘরে ঘরে মড়াকান্না উঠবে, তারপর চিতায় দেবার লোকও থাকবে না - ঘরে ঘরে পচা মড়া পড়ে থাকবে। রাস্তায় শেয়াল-কুকুর মড়া নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি করবে।” মনোজ বসুর ‘জামাই’ গল্পে বিনোদ বহুদিন পর স্ত্রীকে তার বাপের বাড়িতে আনতে গিয়ে বুঝতে পারে, শ্বশুরবাড়ির কেউই বেঁচে নেই ; এমনকী তার স্ত্রীও ভূত ! কী করে এমন হল ? - “খুলনা অবধি নতুন রেললাইন বসেছে।… সাংঘাতিক ম্যালেরিয়া। জ্বরজারি কাকে বলে এ অঞ্চলের লোক আগে জানত না। পাথরে-কোঁদা নিরেট দেহ যেন মানুষের। রেললাইন হয়ে অবধি এই কান্ড। গাঙ খালের মুখ বন্ধ করে রাস্তা বেঁধেছে। খানাডোবা চারিদিকে। বর্ষার জল পড়তে না পড়তে নরক গুলজার ! মানুষজন উজাড় হয়ে গেল। ... মহামারিতে এত বড় গাঁয়ের মধ্যে একটি প্রাণীও বেঁচে নেই।”
৩ ম্যালেরিয়ায় উজাড়-হয়ে-যাওয়া গ্রামের কথা, রোনাল্ড রসের স্মৃতিকথা থেকে এস ও’ম্যালির বিবরণ, সর্বত্রই সহজলভ্য। রেলপথ-প্রসার, ম্যালেরিয়া মহামারি এবং গোটা গ্রামের উজাড়-হয়ে-যাওয়া, একই সুতোয় বাঁধা ! বাস্তবে এমনটাই ঘটেছিল ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে। তাঁর পৈতৃক গ্রাম রাহুতা, ম্যালেরিয়ায় ফৌত হয়ে যায় ; মারা যান তাঁর বাবা-মা-ঠাকুমা ! শুধু ম্যালেরিয়া নয়, একইভাবে কলেরা মহামারিতে উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রামও হয়ে উঠেছে বাংলা ভূতের গল্পের প্রেক্ষিত। অখিল নিয়োগী অর্থাৎ ‘স্বপনবুড়ো’-র ‘নিশীথ রাতের হাসি’ গল্পে পাই কলেরায় আচমকা মৃত মা-বাবা-বোন সকলে মিলে নায়ক বিন্দুকে সেবা-যত্ন করে। আর ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘রাতের অতিথি’-তে গয়ায় পিন্ডদান করতে যাবার পথে, গোলক এক পরিবারের আতিথ্য নেয়। পরিবারের কর্তা তাদের সকলের নামে তাকে পিণ্ড দিতে অনুরোধ করে ! কারণ, কলেরার মড়কে গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়ে তারা সবাই ভূত হয়ে গেছেন !
#নিবন্ধ