তিন দাম্ভিক মানুষ আর এক ‘সাধারণ’ পরিচালকের গল্প
সত্যজিৎ রায় যখন ‘পথের পাঁচালী’-র জন্য হন্যে হয়ে প্রযোজক খুঁজে বেড়াচ্ছেন, সেই সময়েও নাকি কেউ তাঁকে মুখের উপর ‘না’ বলতে পারতেন না। এর কারণটাও ভেবে বের করেছেন বিজয়া রায়, “সম্ভবত এই ছ ফুট চার ইঞ্চির লোককে মুখের ওপর না বলতে তাঁদের অস্বস্তি হত।” তা ছাড়া এই ‘ওরিয়েন্ট লংম্যান’-এর ব্যক্তিত্বটাও এমনই ছিল যে তাঁর সামনে আলটপকা কথা বলতে অস্বস্তি হওয়ারই কথা। ইন্ডাস্ট্রিতে তো তাঁর বদনামই ছিল - তিনি নাকি অসম্ভব নাকউঁচু আর দাম্ভিক। তা এহেন মানুষটির সামনে গিয়ে হাজির হয়েছেন এক নবীন পরিচালক। একেবারেই ছোটোখাটো গোলগাল নিপাট ভালোমানুষটি। কী, না, একটা আবদার আছে তাঁর। একটা নতুন সিনেমা শুরু করতে চলেছেন তিনি, যার শুরুতেই গানে গানে বলা হচ্ছে —
“ফেলিনি-গোদার-ত্রুফো-সত্যজিৎ রায়
ইহাদের সকলেরে রাখি গো মাথায়।”
কিন্তু গোল বেধেছে এরপরেই। গানের কথার সঙ্গে সঙ্গে পালটাতে থাকবে ছবিও, এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু মাঠে নেমে দেখা গিয়েছে, বাকি সকলের ছবি জোগাড় হলেও ফেলিনির ছবি আর কিছুতেই মিলছে না। আর সেই ছবি সংগ্রহের জন্যই খোদ সত্যজিৎ রায়ের দ্বারস্থ হয়েছেন পরিচালক। সব শুনে দিন সাতেক সময় চেয়ে নিলেন সত্যজিৎ। নির্ধারিত দিনে ফের বিশপ লেফ্রয় রোডে হাজির হলেন পরিচালক মশাই। দরজা খুলেই গৃহস্বামীর উক্তি— “একটা পেয়েছি, বুঝলে? একটু গ্রেইন আছে যদিও, তবে মনে হয় তোমার কাজ চলে যাবে।” উৎফুল্ল পরিচালক দরজা দিয়ে ঢুকেই থমকে গেলেন। একপাশে যে মস্ত বুকশেলফটা রয়েছে, তার সামনে মেঝের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে স্তূপাকৃতি পত্রপত্রিকা। দেশি বিদেশি। খোলা আধখোলা। সেই ভিড় থেকেই একটা পত্রিকা তুলে অনুজ পরিচালকের দিকে বাড়িয়ে ধরেছিলেন ছ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা সেই মানুষটি। ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁর নাকি দাম্ভিক বলে ঘোর বদনাম। একাধারে বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, মিউজিক ডিরেক্টর, পত্রিকা সম্পাদক, লেখক, শিল্পী এবং আরও অনেক তকমাই যাঁর নামের সঙ্গে জোড়া যায়, সেই সত্যজিৎ রায় নিজের পাহাড়প্রমাণ কাজের ফাঁকে পাহাড়প্রমাণ পত্রপত্রিকা খুঁজে বার করে রেখেছেন সেই ছবিটি, যা চেয়েছিলেন ওই অনুজ পরিচালক।
দাম্ভিক আর নাকউঁচু বলে বদনাম অবশ্য ছিল সেই মানুষটিরও, যিনি না থাকলে বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। জেফ্রি কেন্ডালের শেক্সপিয়ারিয়ানা দলে অভিনয় থেকে নিজের গড়া লিটল থিয়েটার গ্রুপ, উৎপল দত্ত নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সেই মানুষটির ‘কল্লোল’ বাড়িতে গিয়েও একদিন কড়া নেড়েছিলেন ওই পরিচালক। উৎপল দত্তকে না পেলে নাকি পরের ছবিটা হবেই না তাঁর। কিন্তু এমনই ভাগ্য, মুম্বইয়ের ফ্লাইট ধরার জন্য তক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছেন উৎপল। কোনোমতে তাঁর হাতে বইটা গুঁজে দিয়ে একবার পড়ার আরজিটুকু জানিয়ে দিলেন পরিচালক।
সেই রাতেই মুম্বই থেকে একটা ট্রাংক কল পেলেন তিনি। বই শেষ করে হুকুম জারি করছেন উৎপল দত্ত, “এ ছবি করতেই হবে, প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করুন।” এদিকে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে উৎপলের শুটিংয়ের ডেট পাওয়া যাবে না বলে সেদিনই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তাঁর সহধর্মিণী, অভিনেত্রী শোভা সেন। ভয়ে ভয়ে সে কথা বলতেই তুরন্ত জবাব আসে, “গুলি মারুন ওই অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক মহিলার কথায়। আমি কথা দিচ্ছি ডেট বা অন্য কোনও ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হবে না।”
কলেজের অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট সাম্মানিক পাননি বলে নিজে অভিনয় করেননি উৎপল দত্ত, নাম উল্লেখ না করে এমন কথাই জানিয়েছিলেন এক সাহিত্যিক। অথচ সেই উৎপল দত্ত-ই এখানে শুটিংয়ের দিন কিংবা পারিশ্রমিক নিয়ে কোনোরকম টালবাহানা পর্যন্ত করেননি। ছবিটি নিয়ে তিনি কতখানি ভাবিত ছিলেন তা বোঝা যায় অভিনয়ের জন্য আর-এক শিল্পীর নাম প্রস্তাব করায়। সেই রাতের ফোনেই ছবির অন্যান্য চরিত্রাভিনেতা প্রসঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়ে উৎপল দত্ত বলেছিলেন, “কোনও একটা রোলে অজিতেশকেও ভাবুন না— অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।” প্রতিদ্বন্দ্বী-সমান শিল্পীর জন্য কাজের সুযোগ করে দেওয়ার মতো সৌজন্য দেখাতে পিছপা হননি সেই ‘দাম্ভিক’ মানুষটি।
এদিকে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কেও খানিক কুণ্ঠা কাজ করছিল পরিচালকের মনে। তাঁর কথায়, “প্রথম দর্শনে (অজিতেশকে) মনে হয় বেশ দাপুটে আর উদ্ধত ধরনের মানুষ।” কিন্তু উৎপল দত্তের কথা ফেলে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং চিত্রনাট্য শোনার জন্য স্টুডিয়োতে ডেকে পাঠানো হল অজিতেশকে। এরপর কী হল, তা শোনা যাক পরিচালকের বয়ানেই—
“চারটে বাজার মিনিট দুয়েক আগে দরজার পর্দার ওপাশে জুতোর ঘষটানির শব্দ। থামে, চলে, আবার থামে। কাঁটায় কাঁটায় যখন ঘড়িতে চারটে, জুতোর মালিক ঘরে ঢোকেন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। খানিকটা অপ্রস্তুতের মতো বলেন, ‘সরি, একটু আগেই পৌঁছে গেসলাম, তাই—’”
বাকি কথা সংক্ষিপ্ত। চিত্রনাট্য পড়া শেষ হতেই অজিতেশের প্রশ্ন, “আমার সংলাপের পাতাগুলি পেতে পারি?”
কিন্তু আর সব কথাবার্তা? সাম্মানিকের পরিমাণ?
সপাট উত্তর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, “যদি আপনার বাজেট অ্যালাও না করে, কিছুই দেবেন না। নইলে যতটুকু করবে তাই দেবেন।”
সাম্প্রতিক কালে বাকি দুনিয়াটার মতো সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও শ্রম আর পারিশ্রমিকের সমীকরণ টানা হয়ে চলে সর্বদা। তা নিশ্চয়ই জরুরি। তবে এই শব্দগুলো কখনও কখনও বড়ো হতে হতে গ্রাস করে নেয় তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যা কিছু। এমনকি যা তার মূল আধার, সেই শিল্পের মান আর মর্যাদাও নজর আন্দাজ হয়ে যায় না কি কখনও? সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ক্রমশ বোধহয় হারিয়েই যান সত্যজিৎ-উৎপল-অজিতেশের মতো ‘উদ্ধত’ আর ‘দাপুটে’ মানুষেরা। তাঁদের পথেই এবার পা বাড়ালেন সেদিনের সেই পরিচালকও। আর সৌজন্যের মতো বিপন্ন শব্দটিও বুঝি আরও খানিক হারিয়েই গেল তরুণ মজুমদার-দের সঙ্গে।
....................
[ঋণ: সিনেমাপাড়া দিয়ে। তরুণ মজুমদার। দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা। ২০২১।]