দ্রোগবা, ফুটবল ও একটি গৃহযুদ্ধের গল্প
আইভরি কোস্ট—পশ্চিম আফ্রিকার প্রায় নাম-না-জানা এক দেশ। ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ক্রমশ উন্নতিশীল এক দেশ। ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময়ে সেখানে শুরু হলো ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। দেশটা স্পষ্টত দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল; দেশের উত্তরভাগের মালিকানা বিদ্রোহী Guillaume Soro–এর হাতে। দক্ষিণভাগে রাজধানী আবিদজান ও তার পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলে কোণঠাসা হয়ে টিকে আছে প্রেসিডেন্ট Laurent Gbagbo–এর বাহিনী। জাতিসংঘের উপস্থিতি, ফ্রান্সের মধ্যস্থতা কোনোকিছুই দেশটার হৃদয়কে জুড়তে পারছে না। রাজপথে টহলরত সেনা, প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি-বিনিময়, ট্যাঙ্কের সতর্ক পাহারা ও ভবিতব্যের মতো মৃত্যুদূতের অপেক্ষার সঙ্গে বাধ্যত অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে আইভরি কোস্ট-বাসী। উভয়পক্ষের প্রায় ৬০০ সৈন্য ও প্রায় ১৫০০ সাধারণ মানুষের মৃত্যুর চিহ্ন নিয়ে তারা তখন এক ‘মসিহা’র আগমনের প্রতীক্ষারত।
তিনি এলেন—৮ অক্টোবর, ২০০৫ সালে। পরনে তার ১১ নম্বরের কমলা জার্সি, বুকে হাতি-সম্বলিত লোগো, পায়ে ফুটবল। তিনি দিদিয়ের দ্রোগবা। ২০০৪ সালে ২৪ মিলিয়ন ইউরোতে ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব চেলসিতে সই করে দ্রোগবা তখন দেশের মানুষের নয়নমণি। শুধু দ্রোগবা নয়, কোলো তোরে, ইমানুয়েল ইবৌ, দিদিয়ের জোকোরার মতো ‘সোনালি প্রজন্ম’-এর প্লেয়াররা সেই সময়ে ইউরোপের মাটিতে দাপিয়ে ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে। ২০০৬-এর বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ণায়ক ম্যাচে সুদানের মুখোমুখি তাঁরা। এদিকে সুদানের সঙ্গে ড্র, অন্য ম্যাচে মিশরের বিরুদ্ধে ক্যামেরুনের শেষ মুহূর্তের পেনাল্টি মিসে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার দরজা খুলে গেল তাঁদের সামনে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে জন্ম হলো এক রূপকথার।
৯০ মিনিটের যুদ্ধে শ্রান্ত দ্রোগবাদের মনে হলো এর চেয়ে উপযুক্ত সময় হতে পারে না। সতীর্থদের ডেকে নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বললেন, “Men and women of Ivory Coast, From the north, south, centre and west, we proved today that all Ivorians can coexist and play together with a shared aim - to qualify for the World Cup. We promised you that the celebrations would unite the people—today we beg you on our knees. Please lay down your weapons and hold elections”[সূত্র: youtube]। হ্যাঁ, যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল, নির্বাচন হয়েছিল, শান্তি ফিরেছিল। এখানেই শেষ নয়, দু’বছরের মধ্যে ফের গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাস দেখা দিলে তিনি আফ্রিকান কাপের মাদাগাস্কারের সঙ্গে ম্যাচটি বউয়াকাতে অনুষ্ঠিত করার অনুরোধ জানান। বউয়াকা, যা কিনা বিদ্রোহীদের ঘাঁটি, সেই ম্যাচে প্রায় ২৫০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের নেতা একসঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত উচ্চারণ করেন। পাঁচ গোলে জেতা ম্যাচটিতে দ্রোগবার শেষ গোলটির সঙ্গে সমগ্র স্টেডিয়াম গর্জন করে ওঠে।
সেদিন শুধু দ্রোগবারা জেতেনি, জিতেছিল ফুটবল, জিতেছিল আত্মঘাতী গোলে হারতে বসা একটা গোটা দেশের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। সেদিন সাতাশি মিনিটে মাঝমাঠের লফ্টেড পাসটাকে অসামান্য কন্ট্রোলে রিসিভ করে গোলটা দ্রোগবাই করেনি; করেছিল আইভরি কোস্টের আড়াই কোটি মানুষের মুক্তিকামনা, করেছিল বিশ্বের সমস্ত প্রান্তে বৈষম্য ও যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা কোটি কোটি মানুষের চেতনা। ক্লাবের হয়ে ২১০টি ও দেশের হয়ে ৬৫টি গোল করা দ্রোগবার ফুটবল জীবনে সাফল্যের কমতি নেই। তবে চার বারের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও একবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা দ্রোগবার সবচেয়ে বড়ো ট্রফি তাঁর দেশের শান্তি। বলা হয়, দ্রোগবা হলেন বড়ো ম্যাচের প্লেয়ার। ক্লাব পর্যায়ে ১০টা ফাইনাল ম্যাচে ১০ গোল করে, ১০টা ফাইনালই জিতেছেন। মনে পড়তে পারে ২০১২ সালে চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে শেষ মুহূর্তে ফার্স্ট বারের কোণা দিয়ে করা হেডে সমতা ফেরানোর গোলটির কথা। যে গোলটির সময়ে ধারাভাষ্যকার মার্টিন টাইলারের করা মন্তব্য হয়তো দ্রোগবার জীবনের সঙ্গেও মিলে যায়, “Drogba!!! And he pulled the rabbit out of the hat again! Can you believe it? Chelsea won’t let go of the Champions League”। মাঠের বাইরের দ্রোগবাও এইভাবে ঝোলা থেকে জাদু ফুটবল বের করে মাতৃভূমির হাতটা শক্ত করে ধরে থাকেন।
পোস্টার : অর্পণ দাস
#খেলা #ফিচার #শিবাজী আইচ #দ্রোগবা #গৃহযুদ্ধ