আসা যাওয়ার মাঝের গল্প
চলাচল লেখক:রাজা ভট্টাচার্য প্রকাশনা: দ্য ক্যাফে টেবল
এ এক আসা যাওয়ার মাঝের গল্প । এই গল্প চলাচলের। সারাটা জীবন জুড়ে আমাদের সুখ দুখ-এর চলাচল, হাসি কান্নার লুকোচুরি। কখনো সে কান্না বিষাদে, তো কখনো তা আনন্দাশ্রু। জীবনের ওঠা-নামা যেন সুরের বিস্তারের মতই কখনো চড়ায়, আবার কখনো বা খাদে। সপ্তসুরের প্রতিটা স্বর, গায়নের প্রতিটি মোচড় যেন জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতার সঙ্গীত রূপান্তর। এইরকম-ই এক গানের গল্প রাজা ভট্টাচার্যের লেখা ‘চলাচল’। দ্য ক্যাফে টেবল-এর প্রকাশনায়, লেখকের ভাষায় এই বই ‘একাধারে পাঠ্য এবং শ্রাব্য’।
এগারোটি পর্ব সমন্বিত বইটি লেখকের জীবনের টুকরো টুকরো, আপাতদৃষ্টিতে সামান্য, কিন্তু স্মৃতির কাঁচা সিমেন্টের রাস্তায় চিরস্থায়ী পদক্ষেপ ফেলে যাওয়ার মতই গভীর অর্থবাহক কিছু ঘটনার কথা বলে। বয়স যত এগিয়েছে, এই সামান্য ঘটনাগুলিই তাদের অসামান্য প্রভাব বিস্তার করেছে লেখকের মনের গহনে। আর ততই সুরের পরিবেশে বেড়ে ওঠা লেখকের জীবনের প্রতিটি অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে মনের মধ্যে বহুদিন ধরে স্বযত্নে লালিত হারানো সুরের মাধ্যমে। সরকারী স্কুলের চাকরি পেয়ে অত্যুৎসাহী এক যুবকের শিক্ষকজীবনের প্রাথমিক অভিজ্ঞতায় সাজানো আদিপর্ব। আর আবারও একবার সব বিভেদ ভুলিয়ে, আশা-হতাশার তুলনাকে পরাজিত করে জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন সেই আধুনিকতম শিল্পী রবিঠাকুর। আমার গুরু বলেন, গান যত না সুর-লয়ের, তার থেকেও অনেক বেশি প্রাণের; সেখানেই সুর, সেখানেই লয়। তাই রাজাবাবু স্যারের তত্ত্বাবধানে বেসুরো খামখেয়ালি অথচ সরল নিষ্পাপ কচি-কাঁচার দল তাদের অন্তর্নিহিত সুরের প্রার্থনা জানায় তাদের অন্তরের দেবতাকে। আর সেই প্রার্থনা অনুরণিত হতে থাকে সভাপর্বের সভাকক্ষের দেওয়ালে দেওয়ালে। সুর-কথার মোহময়তার আবিষ্ট, সকলের কাছে জড়বুদ্ধি সম্পন্ন অর্পণের সর্বশক্তিমানের পায়ে অকৃপণ আত্মসমর্পণ, কয়েক মুহূর্তের তাৎক্ষণিক ঘটনা হয়েও পাঠকের চোখ এক অজানা আবেগে ভিজিয়ে দেয়। আমাদের মনের প্রত্যেকটি আবেগ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রতিটি অনুভূতি যেন কোমল আর শুদ্ধ পর্দার স্বরের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সংযুক্ত। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই সুর-লয়েরই বহিঃপ্রকাশ। তাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি সব মিলেমিশে একাকার হয়ে মনের ভিতরের সুরের সবটুকু আকুতি নিয়ে ঝরে পড়ে, সম্মোহিত করে বারবার। আর এভাবেই একলব্য পর্ব পার করে আসে অনুশাসন পর্ব। সঙ্গীতের অনুশাসন; সঙ্গীত নিজেই এক অনুশাসন , এক নিরন্তর সাধনা । সেই সঙ্গীতের অনুশাসনে চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়া , হারিয়ে যাওয়া এক ছেলেও ফিরে আসে জীবনের স্রোতে জীবনকে ভালোবেসে, সুরকে ভালোবেসে। সুর দেশ-কাল-সময়ের বেড়াজাল চেনে না, ভাষা-বিভেদ বোঝে না । তবু স্বকীয় মহিমায় কথার ছবি তৈরি করে আমাদের ভাবায়। জীবনের পথে সুরের এই চলাচল বারবার জীবন জুড়ে মান-অভিমানের মোড়ক ছিঁড়ে জীবনের অস্তিত্বকেই বুঝিয়ে দেয়। অকৃত্রিম নিষ্ঠা আর অনড় ভালোবাসা বিভেদবিহীন এই সুরের মর্যাদা রক্ষা করে এসেছে সর্বদা; সুর নিয়েছে তার স্থায়ী আশ্রয়। অতি সাধারণ থেকে অনন্য সাধারণ, সকলের মনের গহনেই সাধ এবং সাধনার ছায়ায় সুরের চারাগাছ মহীরুহে পরিণত হয়েছে কখনো ক্লাসিকাল বন্দিশ, কখনো বা বড়ু চণ্ডীদাসের পদাবলী, আবার কখনো রক্ত গরম করা গণসঙ্গীতের হাত ধরে। আর মানবজীবনকে অতিক্রম করে মিশে গিয়েছে নির্জন গঙ্গাপাড়ের জলের সুরে, ঘুমভরা রাতের চাঁদের আলোয় ভেজা মাঠ-গাছপালার গন্ধে; আবার কখনো প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্যবাহক অট্টালিকার ইঁটের পাঁজরে পাঁজরে। লেখকের লেখার ছন্দে,সুরের মূর্ছনায় বারবার একাকার হয়ে গিয়েছে অতীত আর বর্তমান। কথার জাদুতে সুরের সম্মোহনে পাষাণ ভেঙে নেমেছে জলের ধারা, বহুদিনের সঞ্চিত আবেগবাষ্প অর্গল ভেঙে হয়েছে মুক্ত। ক্রমাগত সেই সুরের নির্যাস আত্তীকরণ করেছে সকলে, আর সামাজিক দূরত্ব মুছে হয়ে উঠেছে আপনারই জন। সপ্তসুরের আবেষ্টনে প্রাণের আকুতিতে মিলে গিয়েছে রবি ঠাকুরের শব্দমাখা আবেগে। রাজাবাবু স্যারের শিক্ষক জীবনেরই এক মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখক ইতি টেনেছেন এই বইয়ের। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সহজ সরল ভাষায় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ এবং প্রতিটি অনুভূতির তারে অন্তরের গভীরতম সুরের সংযোগ বারবার স্পর্শ করে পাঠকের হৃদয়। আর তাই শুধুই লেখকের নিছক লেখা নয়, এই সুরের চলন আমদের প্রত্যেকের জীবন জুড়েই। বাবা-জ্যাঠার সান্নিধ্য, রেওয়াজের ক্লাস, মায়ের নিখাদ স্নেহ আর প্রশ্রয়, বন্ধুদের অকৃত্রিম সাহচর্য, অমলিন মফস্বলের সরল প্রকৃতি আর ছাত্র-শিক্ষকের সুনিবিড় বন্ধন যেন আমাদের সকলের জীবনেরই স্বরগ্রামে সপ্তসুরের ‘চলাচল’।