নিবন্ধ

কাস্ত্রোকে ভালোবেসে হত্যা করতে চেয়েছিলেন যে গুপ্তচর

বিদিশা বিশ্বাস May 22, 2021 at 8:39 am নিবন্ধ

১৯৬০-এর একেবারে শেষ প্রহর। আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হতে চলেছেন জন কেনেডি। আর অদূর ভবিষ্যৎ নিজেকে প্রস্তুত করছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের জন্য। এমন সব চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রাক্কালে, ১৯৬০ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে হোটেল হাভানা হিলটনের ২৪০৮ নং স্যুইটে অপেক্ষারত এক রহস্যময়ী নারী। উদ্দেশ্য এমন এক পুরুষকে হত্যা করা, যাঁর গোটা জীবৎকাল জুড়ে প্রায় ৬০০ হত্যার চক্রান্ত চলবে।

রাত গাঢ় হয়। পুরুষটি আসেন। নারীটিকে প্রশ্ন করেন– তুমি কি আমায় হত্যা করতে ফিরে এসেছ? উত্তর আসে– হ্যাঁ। পুরুষটি তাঁর নিজের লোডেড .৪৫ পিস্তলটি তুলে দেন সেই নারীর হাতে। কিন্তু গুলি চলে না। কোন এক অমোঘ প্রেমে সে রাত বিয়োগান্তক হতে গিয়েও সম্ভোগের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। 

না, কোনও হাড়কাঁপানো থ্রিলারের প্লট নয়। এ কাহিনির সব চরিত্রই বাস্তবিক। নারীটি মার্কিন গুপ্তচর, নাম মারিতা লরেঞ্জ। পুরুষটি কিউবার সমাজতান্ত্রিক নেতা। আর কেউ নন, স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো।

কে এই মারিতা লরেঞ্জ? কী তাঁর সম্পর্ক ‘কিউবান হিরো’ কাস্ত্রো-র সঙ্গে? তা জানতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে, মারিতা এবং কাস্ত্রোর প্রথম পরিচয়ের দিনে। বিলাসবহুল জাহাজ ‘বার্লিন’ নোঙর করল কিউবার হাভানা বন্দরে। জাহাজে উনিশ বছরের মারিতা। সঙ্গী বাবা হেইনরিখ লরেঞ্জ। কিউবার নবনির্বাচিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও উপস্থিত ছিলেন বন্দরে। তেত্রিশ বছরের আকর্ষণীয় সুপুরুষ ফিদেল এবং অসামান্য সুন্দরী মারিতা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। আক্ষরিক অর্থেই মহা সমারোহে মারিতার জীবনে প্রথম প্রেম ঘনিয়ে ওঠে। প্রথম দর্শনের কিছুদিন পরে কাস্ত্রোর ব্যক্তিগত বিমান মারিতাকে নিউইয়র্ক থেকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কিউবায়। তারপর বহু রাতের সুখস্মৃতি আর এক উত্তাল প্রেমের সাক্ষী থাকে হোটেল হাভানা হিলটনের ২৪০৮ নং স্যুইট। যেখানে ঠিক পরের বছরই তাঁকে ফিরতে হবে। তবে এবারের উদ্দেশ্য অভিসার নয়। উদ্দেশ্য প্রেমিক পুরুষটিকে হত্যা। কিন্তু কেন?

১৯৯৩ সালে ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান ল্যুইস বারদচের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মারিতা দাবি করেন, ১৯৫৯-এর অক্টোবর মাস নাগাদ তাঁর খাবারে মাদক প্রয়োগ করা হয়, তখন তাঁর গর্ভে কাস্ত্রোর সন্তান। সন্দেহ করা হয় আসলে কাস্ত্রোকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছিল, কিন্তু এর শিকার হন মারিতা। এরপর কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে কিউবা থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রে। বিচ্ছিন্ন হয় কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর সমস্ত সংযোগ। মারিতা নিজের আত্মজীবনীতে দাবি করেন মাদক প্রয়োগের ঘটনার পর তিনি সে রাতে হাসপাতালে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। যার নাম আন্দ্রে। যিনি ফিদেলের আশ্রয়ে বড়ো হয়েছেন। ১৯৮১ সালে শুধুমাত্র একবারই নিজের সন্তানের সঙ্গে মারিতার সাক্ষাৎ হয়। যদিও এ ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। 

জীবনের প্রথম প্রেমে আকস্মিক আঘাত নিয়ে মারিতা ফিরে এলেন নিউইয়র্ক সিটি। এই সময় মারিতার মা অ্যালিশা লরেঞ্জ তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন প্রভাবশালী ফটো জার্নালিস্ট অ্যালেক্সান্ডার রোর্ক জুনিয়রের। অ্যালিসা এবং অ্যালেক্সান্ডার এই সময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মারিতাকে কাস্ত্রোর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করতে থাকেন। মারিতার অজান্তেই তাঁরা ১৯৬০ সালের মে মাসে “Fidel Castro Raped My Teen-Age Daughter” শীর্ষক একটি নিবন্ধ বিক্রি করে দেন এক নামী পত্রিকায়। বস্তুত এ সমস্ত কিছুই CIA-এর গোপন প্ররোচনায় চলতে থাকে। কাস্ত্রোর উপর তীব্র অভিমান মারিতাকে কাস্ত্রো বিরোধী কর্মসূচিতে সক্রিয় করে তোলে। তিনি একদিকে FBI-এর গুপ্তচর হিসাবে কাজ করতে থাকেন, অন্যদিকে CIA এক গোপন চুক্তিতে মারিতাকে মিয়ামিতে প্রশিক্ষণে পাঠায়। এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মারিতা প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬০-এর ডিসেম্বরে ফিরে যান কিউবাতে। প্রেমিক পুরুষটিকে প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দিতে। CIA-র তরফ থেকে মারিতাকে বটুলিজম নামক দুটি বিষাক্ত ট্যাবলেট দেওয়া হয়। মারিতার কাজ ছিল ফিদেলের পানীয়তে সেটি মিশিয়ে দেওয়া। 

নাৎসি শাসিত জার্মানিতে মারিতার জন্ম। বাবা হেইনরিক লরেঞ্জ ছিলেন জার্মান নৌবাহিনীর অধিনায়ক। মা অ্যালিসা লফল্যান্ড ব্রডওয়েতে অভিনেত্রী হিসাবে জীবন শুরু করলেও তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ ও ফরাসি গুপ্ত বিপ্লবী দলের এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তী জীবনে তিনি CIA-র হয়েও গুপ্তচরবৃত্তি করেন। ১৯৪৪ সালে মারিতার যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়েস, সেসময় তাঁর মা অ্যালিসা লরেঞ্জকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে বার্গেন-বেলসেন বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়। অন্যদিকে তাঁর বাবা হেইনরিক যুদ্ধবন্দি হিসাবে ব্রিটিশ বন্দিশিবিরে আটক হন। ফলে অভিভাবকহীন মারিতার স্থান হয় বার্গেন-বেলসনের ভয়াবহ শিশু-সংশোধনাগারে। মিত্রবাহিনীর সহায়তায় পারিবারিক পুনর্মিলন সম্ভব হলেও মাত্র সাত বছর বয়সি মারিতা এক আমেরিকান সৈনিকের হাতে ধর্ষিতা হন। শৈশবের এই ঘটনা মারিতার ব্যক্তিমানস গঠনে বিশেষ প্রভাব ফ‍্যালে। শিশু মারিতা একজন দুর্ধর্ষ লাস্যময়ী প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রত্যাঘাতপ্রিয় নারী হিসাবে বেড়ে ওঠেন। কিউবা সহ ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপ্রধান মারকোস পেরেজ জিমেনেজের সঙ্গে প্রণয়-তিনটি বিবাহ-কেনেডি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে গোপন সংযোগ-FBI ও CIA এর গুপ্তচর হিসাবে দীর্ঘ ২৫ বছরের কর্মযোগ– সব মিলিয়ে এক রঙিন জীবন কাটিয়েছেন মারিতা। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বহুবার বহু মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন তিনি। কেবল একটিবার ব্যর্থ হন। ব্যর্থ হন ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে। যতটা ঘৃণা জমে থাকলে জীবনের প্রথম প্রেমকে নিজের হাতে হত্যা করা যায়, মারিতা ফিদেলকে ততটা ঘৃণা করে উঠতে পারেননি কোনও দিন। 



তথ্যসূত্র:

১)https://en.wikipedia.org/wiki/Marita_Lorenz

২)https://roar.media/bangla/main/history/marita-lorenz-the-spy-who-loved-castro

৩)https://www.vanityfair.com/culture/2016/03/marita-lorenz-fidel-castro-conspiracy-theories 



[ কভার পোস্টার: অর্পণ দাস ]

#বাংলা #নিবন্ধ #ডিটেক্টit #বিদিশা বিশ্বাস #কাস্ত্রো #মারিতা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

17

Unique Visitors

214979