আত্মহত্যা ও অমরত্বের রোলার কোস্টার
সিরিজ : আফসোসপরিচালনা : অনুভূতি কাশ্যপগল্প ও সৃজন : অনির্বাণ দাশগুপ্ত, দিব্য চ্যাটার্জী, সৌরভ ঘোষ সঙ্গীত : নীল অধিকারীমাধ্যম : অ্যামাজন প্রাইম
ননসেন্স লিটারেচার আর ফ্যান্টাসি ফিকশনের পৃথিবী দুটো কেউ যদি ঘেঁটে দেয়? কৌতুকের প্রথাগত ধারণাকে ভেঙেচুরে ছড়িয়ে দেয় মানসিক গ্লানির ধূসর দিগন্তে? থ্রিলারের বুনোট যদি জড়িয়ে ফেলে মরতে চাওয়া শিকার আর তাকে মারতে চাওয়া এক শিকারীকে? এই সমস্ত কিছু একসঙ্গে ঝাঁকিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে পরিবেশন করেছেন ‘আফসোস’ সিরিজের কলাকুশলীরা।
এই কাহিনির মূলে আছে নকুলের আফসোস। তিনবার প্রেমে ব্যর্থ, চারবার চাকরি থেকে বিতাড়িত, বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত নকুল তার শেষ আশ্রয় খোঁজে সাহিত্যিক হওয়ার বাসনায়। ছ-বছরের চেষ্টায় লেখা একমাত্র গল্প যখন কোন প্রকাশকের পছন্দ হয় না, তখন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় সে বেছে নেয় আত্মহননের পথ এবং সেখানেও, এগারোবার চেষ্টার পরেও, সে কোনোভাবেই সফল হতে পারে না! বাঁচা-মরার চেষ্টায় নকুল মনে পড়িয়ে দেয় সুকুমার রায়ের গঙ্গারাম আর তার ম্যাট্রিকপাশের নাছোড় তাগিদকে। নকুলের মনোবিদ শ্লোকা গতেবাঁধা চিকিৎসা থেকে বেরিয়ে নকুলের আত্মহত্যার ইচ্ছেকে চ্যালেঞ্জ করে। তাকে জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে চায়। ফল হয় উল্টো। নকুল নিজের খুনের সুপারি দিয়ে বসে এক এজেন্সিকে এবং সেই দায়িত্ব নেয় এমন এক খুনি যার সাফল্যের খতিয়ান মিথের সমান!
গল্প এভাবেই এগোলে কমেডির চেনা ছকে ফেলে পপকর্ন চিবোতে অসুবিধে হত না, কিন্তু এর পাশাপাশি উত্তরাখণ্ডের এক ছোট আশ্রমে এগারোজন সাধুর খুন কাহিনির চলনে নতুন মোচড় আনে। একমাত্র জীবিত সদস্য, ফোকটিয়া বাবা পালিয়ে আসেন মুম্বাইতে। তাঁর ঝুলিতে গুরুর দেওয়া অমৃতের শিশি, শত শত বছর ধরে সযত্নে রক্ষিত এই গুপ্তরহস্যকে বিদেশি খুনেদের হাত থেকে বাঁচানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। একদিকে রহস্যভেদে তাঁর পিছু নেয় লোকাল থানার ইন্সপেক্টর বীর সিং আর অন্যদিকে এক অমর মানুষের সন্ধানে নকুলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন পলাতক সাধুবাবা। নকুলকে মারতে ব্যর্থ হয়ে শ্লোকাকে তুলে নিয়ে যায় ভাড়াটে খুনি উপাধ্যায় আর আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের হাতে পড়ে যান ফোকটিয়া আর তাঁর অমৃতের শিশি। দেখতে দেখতে বোঝা যায় অনির্বাণ, দিব্য ও সৌরভের লেখা মূল গল্পের নাম, ‘গল্পের গরু গাছে’, কতটা সার্থক!
আপাত অসম্ভব এই গল্পের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এমন কিছু এক্সপেরিমেন্ট যা ভারতীয় ওয়েব-সিরিজকে সাবালকত্বের পথে কিছুটা অক্সিজেন দেয়। ব্যর্থতাজনিত অবসাদ আর আত্মহত্যার প্রবণতাকে এতটুকুও খাটো না করে, তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে থ্রিলার ও হিউমারের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন। নকুলের ভাড়াটে খুনি উপাধ্যায়ের চরিত্রটি সম্ভবত ভারতীয় ওয়েবমাধ্যমে প্রথম মহিলা সুপারি-কিলার। উপাধ্যায়ের আপোসহীন খুনি মানসিকতা, অয়েল পেইন্টিংয়ের দক্ষতা, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শখ – এই সবকিছু তার চরিত্রে এমন ফ্লেভার নিয়ে আসে, থ্রিলারের অত্যুৎসাহী দর্শকমাত্রেই ‘কিলিং ইভ’ সিরিজের ভিলানেলের কথা মনে করতে বাধ্য। আত্মহত্যায় সাহায্য করার এজেন্সি, ভালবাসার প্রতিশ্রুতি পেয়ে জীবনকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছে আর সেই ইচ্ছের সঙ্গে সাক্ষাৎ মৃত্যুর চোর-পুলিশ খেলা – গল্পের মধ্যে বারবার কৌতুকের মোড়কে মানব অস্তিত্বের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলোর গায়ে বিদ্রুপের চাবুক আছড়ে পড়তে থাকে। অমৃতের শিশি হয়ে ওঠে অবাস্তব আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতিরূপ, যার পিছনে একদল মানুষ হন্যে হয়ে ছুটে চলেছে আর কিছু মানুষ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে সীমিত সাধ্যের ভালোথাকাটুকু আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে।
এমন ছকভাঙা চিন্তার শেষেও ‘আফসোস’ থেকে যায়। যতটা যত্ন নিয়ে এই কাহিনির মূল ভাবনাকে মাটি-জল দেওয়া হয়েছে, যত আগ্রহ নিয়ে এর মূল চরিত্রগুলি সৃজন করা হয়েছে, খুব বেশি হলে তার ষাট শতাংশ প্রচেষ্টা নিয়োজিত হয়েছে ভালোভাবে গল্প বলার জন্য। আটটা পর্ব জুড়ে রহস্য ও রসবোধের লাগামহীন উত্তেজনা বজায় রাখতে গিয়ে গল্পের সুতোয় একাধিক জট পাকিয়েছে, বেশ কিছু চরিত্রকে হাতে পেয়ে নষ্ট করা হয়েছে। উপরি হিসেবে টেনে আনা হয়েছে মহারাজা রঞ্জিত সিং ও বিজ্ঞানী জগদীশ বসুর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে এবং গল্পে তাদের উপস্থিতির যুক্তিও একান্তই খেলো। শুধুমাত্র চোখধাঁধানো অভিনয়ের জোরে গুলশন দেভাইয়ার নকুল, হীবা শাহের উপাধ্যায়, রবিন দাসের ফোকটিয়া বাবা গল্পের হাজার খামতিকে তাপ্পি মেরে রাখেন। গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্রে আকাশ দাহিয়া এবং রত্নাবলী ভট্টাচার্য তুখোড় অভিনয় করেছেন, সেই জায়গায় শ্লোকার ভূমিকায় অঞ্জলি পাটিল যথাযথ বললেও অনেক বলা হয়। বিভিন্ন বর্ণময়তা থাকা সত্ত্বেও সেভাবে কোনও চরিত্রের গভীরেই পরিচালক ডুব দেননি, তবে গল্পের খাতিরে তার দরকারও ছিল না। নীল অধিকারীর আবহসঙ্গীত সিরিজের ভাবটিকে কোথাও বিচ্যুত হতে দেয় না, আবার তাকে উন্নততর স্তরে নিয়ে যেতে সাহায্যও করে না। কিন্তু দিনের শেষে, এই তাপ্পিমারা গল্পের শরীরেই যে অদ্ভুত ম্যাজিক ছেয়ে থাকে, তা আসলে আমাদের শীর্ষেন্দু-সত্যজিৎ-ত্রৈলোক্যনাথের অদ্ভুতভাষ্যের সার্থক উত্তরাধিকার।
#ওয়েব সিরিজ রিভিউ