<b>জঞ্জাল সরাতে রেললাইন বসেছিল কলকাতায়</b>
ব্যস্ত রাস্তায় আস্ত ট্রেন। যাত্রীবোঝাই নয়। জঞ্জাল ভর্তি । গন্তব্য ধাপা স্কোয়ার মাইল। সাবেক থিয়েটার রোড থেকে শুরু করে সার্কুলার রোড ধরে বাগবাজার পৌঁছে ফিরতি পথে শিয়ালদহের উপর দিয়ে পুবদিকে পাড়ি। বগিভর্তি ময়লা খালাস করে এসে আবার দৌড়।
গাঁজাখুরি গপ্পো নয়। আজ থেকে প্রায় আশি বছর আগে উত্তর কলকাতার পথে মাঝেমধ্যেই শোনা যেত এই ট্রেনের ভোঁ। শহুরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া ডাকনামও ছিল একটা। ধাপা মেল। ময়লা তোলার কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, তার জন্যে তৈরি হয়েছিল একাধিক প্ল্যাটফর্ম। বিশ শতকের প্রথম দশকে ক্যাম্বেল হাসপাতাল সম্প্রসারণের সময় তাদের মধ্যে একটির জমি নিয়ে নেওয়া হয়। ক্যাম্বেল হাসপাতাল বললে এখন অবশ্য চট করে কেউ চিনবে না। নীলরতন সরকার হাসপাতাল চেনেন তো?
একটু পিছিয়ে শুরু করা যাক। একটু না, অনেকটাই। আঠারো শতকের তিনটি গাঁ। সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুর। চৌরঙ্গির ওপারে বাঘের আড্ডা। ডাকাতেরও। ইংরেজরা সবে নতুন বসতিতে মানিয়ে নিচ্ছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, আপ্তবাক্য মেনে গড়ে তুলছে কেল্লা। সাহেবপাড়ায় বসছে কাঠের বেড়া। তবু তিষ্ঠোতে পারছে না। একদিকে নবাবের হুকুম, অন্যদিকে জ্বরের তাড়স। পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব বাগে এলেও কলকাতার অবস্থা শোচনীয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তো ছিলই, এর উপর যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদির কারণে লাগল মড়ক। এর ঠিক পাঁচ বছর পর আবারও মারী পরিস্থিতিতে গোরাদের টনক নড়ল। ততক্ষণে প্রায় পঞ্চাশ হাজার নেটিভের পাশাপাশি আটশো সাহেব ফৌত। নিয়মিত জঞ্জাল পরিষ্কার ও বন-জঙ্গল কাটার আদেশ এল কোম্পানির তরফে। ১৭৬৬ সালে বুজিয়ে ফেলা হল পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্বদিকের পরিখা। অন্ধকূপ কাণ্ডের পরে নবাবের নির্দেশে মৃতদেহগুলো ওই খাতেই ফেলা হয়েছিল। ক্রমে পরিত্যক্ত মারাঠা ডিচের মতো পার্শ্ববর্তী এলাকার জঞ্জালের সদ্গতি হত ওখানেই। ১৭৯৯ সালে মারাঠা ডিচ আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেলে আরও মাটি ফেলে পোক্ত করে তৈরি হল বাহার সড়ক বা সার্কুলার রোড। এমন কপাল ছিল স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোডেরও। গঙ্গার পাড়ে পলি জমে নতুন পাড় আর তাতে আবর্জনা ভরাট করে নতুন পথ। কিন্তু এ তো আর জঞ্জাল দূর করার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।
১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি পর্যটক গ্রাঁপ্রে কলকাতায় ঘুরতে এসে বুকসমান উঁচু রেলিং দেওয়া পাঁচিল ঘেরা লালদিঘি ও তার চারপাশে কোম্পানির কর্মচারীদের প্রাসাদতুল্য বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এরই পাশাপাশি চিৎপুরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাঁকে চমকে দেয়। “Voyage in the Indian Ocean and to Bengal undertaken in 1781-1790” বইয়ে লিখে গেছেন সে কথা। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ভ্যালেনশিয়া (Lord Valentia)- লিখেছিলেন, “Chowringhee is an entire village of palaces, and altogether forms the finest view I ever beheld in any city. The Black Town, however, is as complete a contrast to this as can well be conceived. Its streets are narrow and dirty, but the houses of two stories, occasionally brick,but genetally mud and thatched perfectly resembling the cabins of the poorest class in Ireland.” হোয়াইট টাউন আর নেটিভ মহল্লার তফাত স্পষ্ট।
আরও পড়ুন
উন্নয়ন বনাম ‘পবিত্রতা’ : পিয়ের রাভির অ্যাগ্রো - ইকোলজির দর্শন
এই শোচনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ভারপ্রাপ্ত গভর্নরেরা বিস্তর মাথা ঘামালেও কিস্তিমাত করলেন লর্ড ওয়েলেসলি। ১৬ই জুন, ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে পেশ হল ‘ওয়েলেসলিস্ মিনিট’। ধরা পড়ল জলনিকাশি ব্যবস্থার গলদ। রাস্তাঘাট সংস্কার বা নির্মাণের কথা বলা থাকলেও জঞ্জাল নিষ্কাশনের ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব বোধহয় দেওয়া হয়নি। কারণ পরবর্তীতে কলকাতার উন্নতির জন্যে লটারি কমিটির কার্যকলাপে নতুন রাস্তা তৈরি ও উন্নত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা প্রচলন বেশি গুরুত্ব পায়। উনিশ শতকের তিরিশের দশকে নেটিভ কলকাতার দুরবস্থার দিকে প্রথম আঙুল তুললেন ফিভার হসপিট্যাল অ্যান্ড মিউনিসিপ্যাল এনকোয়ারি কমিটি। একের পর এক সুপারিশ-প্রস্তাবে শহরের জঞ্জাল নিষ্কাশন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করল।
ঊর্ধমুখী বাড়তে থাকা জ্বরের ধমক সামাল দিতে তৈরি হয়েছিল পনেরোজন সদস্যের ফিভার হসপিটাল কমিটি। পরে তা কমে দাঁড়াল বারোয়। কমিটির তরফে মি. জে.আর.মার্টিনকে মূলত জ্বরের চিকিৎসার জন্যে একটি হাসপাতাল তৈরি এবং কলকাতার দেশীয় বাসিন্দাদের দুরবস্থার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ এই দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়। এই কমিটিরই অন্তর্গত দ্বিতীয় সাবকমিটির প্রধান কাজ ছিল জঞ্জাল অপসারণ ব্যবস্থার পর্যালোচনা করা। যাবতীয় চিরুনিতল্লাশি সেরে ফিভার হসপিটাল কমিটি ১৮৪০ থেকে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ভিতর পরপর তিনটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে দাখিল করে। এর মধ্যে দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি এই নিবন্ধে প্রাসঙ্গিক। কারণ ফিভার হসপিটাল কমিটির প্রতিবেদনের সূত্রে সরকার পৌর স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করেন এবং ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৬ নম্বর আইন প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল জাস্টিসেস অফ পিস-দের হাত থেকে শহরের জঞ্জাল অপসারণের ভার সরিয়ে নিয়ে কলকাতা উন্নয়ন পর্ষদের হাতে তুলে দেওয়া।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আমল থেকে শহর পরিষ্কার রাখার ভার ছিল কলকাতার গোরা জমিদারের। পরে সে দায়িত্ব পেলেন জাস্টিসেস অফ পিস। সেকালে আবর্জনা ফেলার জন্যে ছিল বলদ গাড়ি। কখনও বা ঘোড়ার গাড়িও। যেখানে সেই বলদ, ঘোড়া বদলানো হত অথবা ময়লা ফেলার গাড়ি রাখা হত তাকে বলা হত গোখানা। লর্ড ওয়েলেসলির Town Improvement Committee বা লটারি কমিটির আমলে জঞ্জাল পরিষ্কারের দিকটি প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন ছিল। ফিভার হসপিটাল কমিটির সময় থেকে এইদিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হতে থাকে। তবে এত সহজে ভবি ভোলেনি। যখন তখন আবর্জনা ফেলে রাস্তা নোংরা করা শহুরে বাসিন্দাদের বাঁ হাতের কাজ। তাদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জঞ্জাল ফেলতে রাজি করাতে গিয়ে সরকারকে রীতিমতো আইনের দ্বারস্থ হতে হয়।
১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, জঞ্জাল সংগ্রহকারী গাড়ি একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘণ্টা বাজিয়ে কোনো একটি এলাকার উপর দিয়ে যাবে। এলাকার বাসিন্দারা সেই সময় তাদের বাড়ির জঞ্জাল সেই গাড়িতে পৌঁছে দেবে। কয়েকদিনের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত আধিকারিকরা বুঝে যান কলকাতার বাসিন্দাদের কাছে এই নিয়মানুবর্তিতার আশা নিরর্থক। হোয়াইট টাউনের বাসিন্দারাও পিছিয়ে ছিলেন না। তবে তাঁরা রাজার জাত। তাই ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপীয়দের ভিড় বেশি এমন এলাকায় সরাসরি বাড়ি থেকেই জঞ্জাল সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়। বাকিদের জন্যে সরকার, রাস্তায় জঞ্জাল নিক্ষেপের নির্দিষ্ট সময় বেঁধেই ক্ষান্ত দেন।
আঠারো শতকের তিন গাঁ আড়ে বহরে বেড়ে কল্লোলিনীর দিকে এগোচ্ছে। গোশকটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গোখানা রীতিমতো কারখানা। জঞ্জালবাহী গাড়ির মেরামতির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার নামের ফলক, বাড়ির নম্বর তৈরি ইত্যাদির কাজও করা হত। তবু ১৭৬৭ সালে তাদের একচেটিয়া দাপটে ভাগ বসাতে এল মিউনিসিপ্যাল রেল।
শহর কলকাতার আবর্জনা প্রথম দিকে চুল্লির সাহায্যে পুড়িয়ে ফেলা হত। যত দিন যায়, এই ব্যবস্থার খামতিগুলো চোখে পড়তে থাকে। ইতিমধ্যে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে পৌরসভার ব্যবহারের জন্যে লবণহ্রদের এক বর্গমাইল এলাকা সরকার অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করেন। তিরানব্বই হাজার দুশো পঁচিশ টাকার বিনিময়ে জমিটি হস্তান্তরিত হয়। ১৮৬৭ সাল থেকে শুরু হয় লাইন পাতার কাজ আর ১৮৬৮ সালে পুরোদস্তুর কাজ শুরু করে দেয় জঞ্জাল রেল।
“আগে জঞ্জাল নিয়ে যাবার জন্যে কলকাতার ভিতরেই কর্পোরেশনের একটা রেলপথ ছিল। এই রেলপথটা তৈরী করা হয়েছিল ১৮৬৮-৬৯ খ্রীষ্টাব্দে। তার মানে কর্পোরেশন গঠিত হবার পাঁচ বছর পরে। এটা বাগবাজারের অন্নপূর্ণা ঘাটের সামনে থেকে শুরু হয়ে সমস্ত বাগবাজার ষ্ট্রীটের উত্তরাংশ দিয়ে কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীটে এসে সারকুলার রোড ধরে ধাপা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল।” কলকাতা গবেষক অতুল সুরের স্মৃতিচারণে পাওয়া এই রুটম্যাপের বাইরে জঞ্জাল রেলের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন অজিতকুমার বসু। তাঁর গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুসারে, “রেলপথটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল— প্রথমটি থিয়েটার রোড থেকে আরম্ভ হয়ে সারকুলার রোডের মধ্য দিয়ে বাগবাজার পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। আর দ্বিতীয় পথটি পূর্বদিকে প্রসারিত হয়ে ধাপা স্কোয়ার মাইল পর্যন্ত চলে যায়। প্রথম রেলপথে সারা শহরের জঞ্জাল বোঝাই হয়ে শিয়ালদায় আসত, আর দ্বিতীয় রেলপথ দিয়ে ঐ জঞ্জাল খালাস হবার জন্য স্কোয়ার মাইলে যেত। প্রথমে ৮ মাইল দীর্ঘ রেললাইন পাতা হয়।...১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে রেললাইনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ১২ মাইল করা হয়।... প্রথম দিকে ক্রেনের সাহায্যে রেলের বগিতে জঞ্জাল তোলার ব্যবস্থা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা ফলপ্রসূ না হওয়াতে প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করা হয়।...প্রতিটি রেল বগি ১০ টন করে জঞ্জাল অপসারণ করত। ১৯১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে ৩৬,০০০ রেল বগি ভর্তি জঞ্জাল ধাপায় পাঠানো হয়।”
বেঁকে বসলেন ছোটলাট। জঞ্জাল রেলের
দৌলতে সার্কুলার রোডের অবস্থা দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর হয়ে
উঠছিল। দুর্গন্ধের চোটে টিকতে পারছিলেন না বাসিন্দারাও। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে
বাংলাদেশের স্যানিটারি কমিশনার
ডাঃ ডি বি স্মিথ মিউনিসিপ্যাল রেল সম্পর্কে তীব্র অসন্তোষ জানিয়ে যান। তদানীন্তন ছোটলাটের
কানে সে খবর পৌঁছলে তিনি নিজেও সরেজমিনে দেখে কিছু পরামর্শ দিয়ে যান। সরকারি মহলে জঞ্জাল রেলের বিকল্প নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। ইতিমধ্যে ১৮৯৬ সালে কলকাতায় প্রথম মোটরগাড়ি এসে পৌঁছয়। বিশ শতকের শুরুর দিকে লোয়ার
সার্কুলার রোডের লাইন গুটিয়ে ফেলা হয়। পরিবর্তে দক্ষিণ কলকাতার ময়লা অপসারণের
জন্যে দুটি মোটর-লরি কেনা হয়েছিল।
তবে এত সহজে মিউনিসিপ্যাল রেলকে
মুছে ফেলতে পারেননি সুভাষচন্দ্র বসুও। তখন তিনি কলকাতা পৌরসভার প্রধান কর্মকর্তা
(১৯২৫ খ্রি.)। সমাজের সর্বস্তরে জঞ্জাল রেল নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে বঙ্গীয়
ব্যবস্থাপক সভায় দু বছরের মধ্যে জঞ্জাল রেল তুলে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন।
পাকাপাকি অবসর নিতে কতদিন
লেগেছিল?
দুইয়ের পর একটা শূন্য বসিয়ে নিন।
আজ্ঞে হ্যাঁ! কুড়ি বছর।
অতুল সুর মশায়ের হিসেবেও তাই
দাঁড়ায়।
তারপর...
আর কি! এখন মোটর লরি বাহিনী।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
১. অতুল সুর।কলকাতা। কলকাতা: সাহিত্যলোক।
সাহিত্যলোক সংস্করণ: ১৪ এপ্রিল ২০১৬
২. অজিতকুমার বসু। কলিকাতার রাজপথ: সমাজে ও
সংস্কৃতিতে। প্রথম খণ্ড । কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা লি। জুলাই ২০১৭
৩. হরিসাধন মুখোপাধ্যায়। কলিকাতা
সেকালের ও একালের। সম্পাদনা: নিশীথ রঞ্জন রায়। সহযোগী সম্পাদনা: অরবিন্দ
ভট্টাচার্য। কলকাতা: পি এম বাক্চি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। জানুয়ারি ২০০২
বিশেষ ধন্যবাদ:
দীপঙ্কর দত্ত