মগজের জোর : মানব-মস্তিষ্ক কি অসীম ক্ষমতাশালী?
স্কারলেট ইওহানসন অভিনীত ‘লুসি’ নামে একটি ইংরেজি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল বছর আষ্টেক আগে। ওই সিনেমায় দেখানো হয়েছিল বিদেশে পড়তে আসা একটি মেয়ের কথা, যে এক ড্রাগ মাফিয়ার পাল্লায় পড়ে বাধ্য হয় তার পেটের মধ্যে অতি তীব্র এক ড্রাগ বহন করে পাচার করবার জন্য তৈরি হতে। কিন্তু তারপর পরিস্থিতির চাপে পড়ে তার পেটের সেই প্যাকেট যায় ফেটে, আর ওই অতি-তীব্র ড্রাগ মিশে যায় তার রক্তে। যার ফলে লুসির মস্তিষ্ক ধাপে ধাপে তবে দ্রুত জাগ্রত হতে শুরু করে, এবং এরপর দেখানো হয় কীভাবে তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা দশ থেকে বাড়তে থাকে আর প্রতি ধাপে সে কী কী দেখতে থাকে বা তার মধ্যে কী কী পরিবর্তন আসতে থাকে। একদম শেষে যখন তার মস্তিষ্ক পুরো একশো শতাংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে আর তখন কী ঘটে ... নাহ সেটা বলা ঠিক হবে না।
যেটা আমাদের আসলে বলার, এই সিনেমায় দেখানো যে তত্ত্ব, মানুষ তার মস্তিষ্কের মাত্রই দশ শতাংশ ব্যবহার করে থাকে, এটা আসলে কি সত্যি? সত্যি হোক বা না হোক, বহু মানুষ কিন্তু এই তত্ত্ব বিশ্বাস করেন। যেমন আমেরিকায় ২০১৩ সালে করা এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে সে দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ সত্যিই এই তথ্যে বিশ্বাস রাখেন।
কিন্তু একটু খোঁজখবর নিলে জানা যায়, অনেকেই দ্বিধাহীনভাবে জানাচ্ছেন, এমনটা আসলে নয় মোটেই। যেমন ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিউরোলজিস্ট ব্যারি গর্ডন দাবি করেন যে এই ধারণা পুরো ভুল। তাঁর মতে আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় সবটুকুই সবসময় কর্মক্ষম এবং সক্রিয় থাকে, এমনকি ঘুমের মধ্যে হলেও।
একই ধারণা পোষণ করেছেন আরও বহু গবেষক এবং তাঁরা অনেকরকমই যুক্তি দিয়েছেন কেন এই ধারণা ভুল সে ব্যাপারে। যেমন, কেউ বলছেন যদি মস্তিষ্কের মাত্র দশ শতাংশ কাজ করত, তাহলে মারাত্মক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত লাগলে স্মৃতিভ্রংশের মতো বড় আকারের স্থায়ী সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম হত, কারণ মাথার অধিকাংশ জায়গাই যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে, স্মৃতি মোছার সূযোগই তো আসবে অনেক কম। আর একদল বলছেন, যদি দশ শতাংশ কর্মক্ষম থাকে, তবে বিবর্তনের নিয়মে অনেক কাল আগে থেকেই মস্তিষ্কের বাকি নিষ্ক্রিয় অংশগুলির আস্তে আস্তে হারিয়ে যাওয়ার কথা আর সে ক্ষেত্রে আমাদের মাথায় আর অতটা অংশ জুড়ে থাকত না ওই অঙ্গটি, ওর আকার নিঃসন্দেহে অনেক ছোট হত।
এইসব যুক্তির বাইরেও রয়েছে অকাট্য প্রমাণ, যেখানে স্পষ্টই দেখা যায় যে দিন আর রাতের অধিকাংশ সময়ই আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় সমস্তটাই থাকে কর্মক্ষম, সক্রিয়; এমনকি ঘুমের মধ্যেও। খুব সাধারণ কোনো কাজ যেমন কোনো দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা থেকে শুরু করে কঠিন কোনো অঙ্কের সমাধানে মাথা ঘামানো, সব ক্ষেত্রেই মস্তিষ্কের অধিকাংশ জায়গাই বার্তা পাঠায়, আমরা জেগে আছি।
আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষম অবস্থায় কীরকমভাবে কাজ করে চলে, তার ছবি তোলা আজকাল অনেকটাই সহজসাধ্য হয়েছে। দুটো ভালো উপায়, PET (Positron Emission Tomography) আর fMRI (Functional Magnetic Resonance Imaging), ইদানীং মস্তিষ্কের কতটা অংশ বা ঠিক কোন অংশ কখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, সেটা একদম নিশ্চিত করে বলে দিতে পারে। এর মধ্যে প্রথম পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয় এক ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থ (ট্রেসার বলে একে), যাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মাথার মধ্যে। ভেতরে গিয়ে এই জিনিসটি গলে যায় আর এর থেকে বেরিয়ে আসে পজিট্রন কণা। পজিট্রন আসলে ইলেকট্রন কণার অ্যান্টি-কণা, মানে প্রায় সবরকম ধর্মই একই, শুধু আধান বা চার্জ একদম বিপরীত (ইলেকট্রনের নেগেটিভ, পজিট্রনের পজিটিভ)। এখন যদি মস্তিষ্কের কোনো এলাকা সক্রিয় থাকে, তবে ওই সব এলাকা এলাকায় পজিট্রনের নির্গমন বেশি হবে। এবার যদি যন্ত্রের সাহায্যে ওই পজিট্রনের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, তবে নিশ্চিত করেই বলা সম্ভব, কোন সময় আমাদের মস্তিষ্কের কোন এলাকা সক্রিয় হয়ে রয়েছে।
কিন্তু এই ধারণার সূত্রপাত ঠিক কবে?
সেটা ১৯৩৬ সাল। লাওয়েল থমাস (Lowell Thomas) নামে এক সাংবাদিক আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ এবং মোটিভেশনাল লেখক ডেল কার্নেগির ‘How to Win Friends and Influence People’ নামে একটি বইয়ের ভূমিকা লেখেন। সেই ভূমিকায় তিনি এই কথাটি প্রথম লেখেন যে একজন স্বাভাবিক মানুষ তাঁর মানসিক ক্ষমতার মাত্রই দশ শতাংশ কাজে লাগাতে পারেন। এখন মানসিক ক্ষমতা যেহেতু সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে জড়িত, তাই এর পর থেকেই একটা ধারণা জন্মে গেল যে আমরা তাহলে নিশ্চয় আমাদের মস্তিষ্কের দশ শতাংশ ব্যবহার করতে পারি। আর যেহেতু সেল্ফ-হেল্প জাতীয় বইগুলোর বিক্রির ক্ষেত্রে এই মস্তিষ্ককে জাগিয়ে তোলা বা তাকে বেশি মাত্রায় সক্রিয় করে তোলবার মাধ্যমে বেশি করে কাজ বা পড়াশুনোকে মাথার মধ্যে জমিয়ে রাখবার কথা বিশদে ব্যাখ্যা করাটা বেশ প্রয়োজনীয়, তাই ওইসব বইয়ে এই জাতীয় কথা বলতেই হয়।
থমাস সাহেব তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন 1907 সালে 'সায়েন্স' পত্রিকায় প্রকাশিত আর একটি নিবন্ধেরও [The Energies of Men, William James, Science, 1 March 1907, vol 25, Issue 635 pp. 321-332], সেই লেখার লেখক ছিলেন মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম জেমস আর তিনি লিখেছিলেন যে ‘We are only making use of a small part of our possible mental and physical resources.’ উইলিয়াম জেমস তাঁর লেখায় কোনো শতাংশের উল্লেখ না করলেও আমাদের মস্তিষ্কের যে কিছু অংশ কাজে লাগাতে পারি আমরা আর বাকিটা রয়ে যায় সুপ্ত অবস্থায়— এই মিথের জন্ম এখান থেকেই বলে মনে করেন অনেকে।
যাই হোক, মস্তিষ্ককে ষাট কিংবা আশি শতাংশ সক্রিয় করে ফেলবার পর মাথা খাটিয়ে দূরে রাখা কোনো চেয়ারকে স্রেফ ইচ্ছের জোরে এনে ফেলা যাবে হাতের নাগালে, অথবা শুধু ইচ্ছেশক্তি দিয়ে আট দশ জন গুণ্ডার হাতে থাকা ছুরি সোজা বেরিয়ে এসে লেগে যাবে দেয়ালে, এমন সব অবাস্তব ঘটনা যে ঘটতে পারে, এই আস্থা ভূতে বিশ্বাস রাখবার মতোই ভিত্তিহীন, তবে রোমাঞ্চকর তো বটেই।