নিবন্ধ

সেকালের কলকাতার মশা

কৌশিক মজুমদার July 15, 2020 at 10:55 am নিবন্ধ

বর্ষা এসে গেছে। ডেঙ্গুকে সঙ্গে নিয়ে। প্রতিবারের মতো এবারেও গ্রীষ্মকালে অনেক প্রতিশ্রুতি শুনেছিলাম, মশা নাকি ধ্বংস করা হবে। কোথায় কী? মশাদের আটকানো কি এতই সোজা!!

বিলেত থেকে সাহেবরা এ দেশে আসার পর যে দুটি জিনিস প্রথমেই তাঁদের পেড়ে ফেলত, এক, পেট খারাপ, আর দুই, এই মশা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, মশার বিরাম নেই। সেই কবে ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘রেতে মশা, দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকেতায় আছি’। ১৮২৩ সালের ১৮ নভেম্বর বাবু রূপলাল মল্লিকের বাড়ি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নাচের আসর বসেছিল। প্রধান গায়িকা ছিলেন ‘প্রাচ্যের কাতলানি’ ভিকি। কিন্তু নাচ দেখবেন কী! মশার উৎপাতে সাহেবরা নিজেরাই নেচে নেচে উঠছেন। গানের সঙ্গে মশার কামড়ের এই অনুপান খবরের কাগজ অবধি গিয়েছিল। এই মশার বিনবিনুনিতে অতিষ্ঠ হয়ে এক সাহেব মশার কবিতা অবধি লিখে ফেলেছিলেন। কিছুটা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না..

‘A ceaseless hum my listening ears regaled:
Mosquitos swarmed around, a thirsty thong
Raised the red bump, and tuned the hollow song.

গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো মশার কামড়ে লবেজান। তাঁর অ্যাডভোকেট জেনারেল স্মিথ সাহেব তাঁকে মশার হাত থেকে বাঁচার এক ঘরোয়া টোটকা দিলেন। “হিসেব করে এমন যুবক বা যুবতির পাশে গিয়ে বসুন, যিনি সদ্য লন্ডন থেকে এসেছেন। নিশ্চিত থাকুন মশারা আপনাকে ফেলে তাঁরই রক্ত খেতে যাবে।” বুঝুন ঠেলা। তবে এ কথা যে ঠিক নয় তা প্রমাণিত মিস এমিলি ইডেনের দিনলিপিতে। তিনি লিখছেন, “স্যার মেটকাফ প্রায় তিরিশ বছর এই দেশে আছেন। এখনও ওঁকে মশা ঠিক ততটাই কামড়ায় যতটা তিরিশ বছর আগে কামড়াত।” কামড়ের ঠেলায় মেমসাহেবদের গলায় মুখে লাল লাল দাগ হয়ে যেত। তাই মশার হাত থেকে বাঁচতে তাঁরা মাঝে মাঝেই হপ্তা দুই তিন পর্দানশিন থাকতেন। কোথাও বেরোতেন না।

মজার ব্যাপার, এই মশারা ছিল ভয়ানক দেশপ্রেমী। নেটিভদের নাকি তারা কামড়াতই না। এর পিছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। শিল্পী চার্লস ও ডয়লি দারুণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “দিনের শেষে সূর্য অস্ত গেলেই মশারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুনগুন শব্দে ইউরোপীয়দের বাড়িতে ঢুকে পড়ত। তাদের আওয়াজ শুনলে মনে হবে যেন তাঁতি তাঁত বুনছে। এ দেশের নেটিভরা ওই সময় উনানে আঁচ দিয়ে রাতের খাবার বানায়। সেই ধোঁয়ায় মশা টিকতে পারে না। অতএব তারা দলবল নিয়ে শহরের ইউরোপীয় অধ্যুষিত এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।” সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য ভৌতিক গল্প ‘নীল আতঙ্ক’-তেও ভারতের মশারা এসেছে। নীলকর সাহেব তাঁর ডায়রিতে লিখছেন, “কানের কাছে আবার সেই রাক্ষুসে মশার বিনবুনুনি আরম্ভ হয়েছে। শেষটায় এই সামান্য একটা পোকার হাতে আমার মতোমত জাঁদরেল ব্রিটিশারকে পরাহত হতে হল? ভগবানের এ কেমন বিধি?”

তবে সবকিছুর ভালো দিকও আছে। এই মশারা না থাকলে সাহেবদের জিনের সঙ্গে অবশ্য পানীয় যে টনিক, তা বোধহয় আবিষ্কারই হত না। ষোড়শ শতকে আমেরিকার জেসুইট পাদরিরা খেয়াল করলেন যে, ওখানকার কোয়েচা রেড ইন্ডিয়ানরা সিঙ্কোনা নামে একটা গাছের ছালের তিতো রস খায়। সে রস খেলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ তো কমেই, এমনকি সেরেও যায়। তাঁদের হাত ধরে এই তিতো ছালের গাছ রোমে আসে। সেই সময় রোমে ম্যালেরিয়ার দারুণ প্রকোপ। একজন পোপ আর বেশ কিছু কার্ডিনাল মশার কামড়ে প্রাণ দিয়েছেন। সিঙ্কোনা গাছের ছালের রস খেয়ে বাকিরা অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। সেই থেকেই ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত এলাকায় কেউ গেলেই তার কোঁচড়ে কিছু সিঙ্কোনা ছাল বেঁধে দেওয়া হত।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা ভারতে এলে তাঁদেরকেও একইভাবে সিঙ্কোনার ছাল দেওয়া হয়েছিল। প্রথম প্রথম নিয়ম মেনে তাঁরা জলে ভিজিয়ে খেতেন। তারপর সোডা ওয়াটারে। শেষে সেই সোডা ওয়াটারে জিন মিশিয়ে দেখলেন, আরে বাঃ, এ তো দারুণ অ্যাপারটিফ! খিদে বাড়ানো, ম্যালেরিয়াকে দূর হটানো, সব এক চুমুকে সম্ভব। এই নতুন তেতো তরলের নাম তাঁরা দিলেন টনিক, মানে রোগহারক। সূর্য ডুবতে না ডুবতে মশা ঘিরে ফেলত চারদিক আর সাহেব মেমসাহেবরা সানডাউনার নামে এই জিন আর টনিক মিশিয়ে পান করতেন। তারপরেই আসত রাতের খাওয়া। কেমন করে যেন ইংরেজদের কালচারে এই জিন আর টনিক ঢুকে গেল। আজও খাঁটি ব্রিটেনে সাহেবরা ডিনার পার্টির আগে জিন আর টনিক খান, এটা না জেনেই যে, এর আসল কারণ ছিল ভারতের মশককুল।



[ পোস্টার অর্পণ দাস ]

#নিবন্ধ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

216065