নিবন্ধ

ছাড় পায়নি হাসপাতালও, তালিবানের হাতে খুন শিশুকন্যারা

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য Aug 18, 2021 at 9:26 am নিবন্ধ

‘I won’t make a Nation,’ says he. ‘I’ll make an Empire! These men aren’t niggers; they’re English! Look at their eyes- look at their mouths. Look at the way they stand up. They sit on chairs in their own houses. They’re the Lost Tribes, or something like it, and they’ve grown to be English.’ - Rudyard Kipling, ‘The Man Who Would Be King’ (1888)।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হল, এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান তাকে উনবিংশ শতাব্দী থেকেই ঠেলে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী লড়াইয়ের একেবারে মাঝখানে। উপরে রাশিয়া এবং নিচে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, আফগানিস্তান জুড়ে তখন চলছে ‘দ্য গ্রেট গেম’, ইংরেজ ও রাশিয়ান গুপ্তচরদের পরস্পরকে টেক্কা দেবার রোমহর্ষক প্রতিযোগিতা। কিপলিং-এর বিখ্যাত কিশোর নায়ক কিম বেছে নিয়েছিল এই গ্রেট গেমের গুপ্তচরের কাজ। জন বুকানের ‘দ্য হাফ হার্টেড’ উপন্যাসেও রয়েছে আফগানিস্তান পেরিয়ে আসা রাশিয়ান আক্রমণকারীদের রুখে দেবার কথা।
আর যারা এই দেশের বাসিন্দা, সেই আফগানদের কি বশে আনতে চেষ্টা করেনি ইংরেজরা? বিলক্ষণ করেছিল। আমির দোস্ত মহম্মদকে হটিয়ে অনুগত শাহ সুজাকে রাজা বানিয়ে ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের জনসাধারণকে বশে রাখতে চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু ফল হয়েছিল একেবারে উলটো। আফগানিস্তানে তখনও পুরোদস্তুর বহাল ছিল মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা। রাজার নিজের কোনও সেনাবাহিনী ছিল না, গ্রামের মোড়লরাই ছেলেদের নিয়ে রাজার নামে যুদ্ধ করে টাকা পেত। সুজা মোড়লদের প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দিলে তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে, এবং সোজাসুজি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। দুর্ধর্ষ আফগানদের চটালে যে কী মারাত্মক ফল হতে পারে, হাতেনাতে টের পায় ব্রিটিশরা। তিন বছর ধরে দুর্দান্ত লড়াই করে ১৮৪২ সালে প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদের হারিয়ে দেয় আফগানরা। মনে রাখতে হবে, এটা এমন একটা সময় যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রশ্নাতীত। এ সময় তাদের হারিয়ে দেওয়া তো ছেড়েই দিন, সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ করাও ছিল প্রায় রূপকথার মতোই অকল্পনীয় ব্যাপার। সাধে ‘দ্য ম্যান হু উড বি কিং’ গল্পে কাফিরিস্তানিদের ভূয়সী প্রশংসা শোনা গিয়েছিল কিপলিং-এর মুখে! ব্রিটিশদেরও যে হারানো যায়, তার প্রমাণ আফগানরা এভাবে না দিলে হয়তো ১৮৫৭ সালে ভারতবাসী মহাবিদ্রোহ করবার সাহসটাই পেত না। এরপরেও ইংরেজদের সঙ্গে আরও দু’বার লড়াই হয় আফগানদের। শারলক হোমসের গোয়েন্দাকাহিনির পাঠক পাঠিকাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসে ডাঃ ওয়াটসন যে যুদ্ধে আহত হয়ে লন্ডনে ফিরে এসেছিলেন, তা ছিল দ্বিতীয় অ্যাংলো আফগান যুদ্ধ। ওয়াটসনের চোট যেন যুদ্ধে নাজেহাল ব্রিটিশ সিংহের নড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন।
১৯২৬ সালে আফগানিস্তানের মসনদে বসেন প্রগতিশীল রাজা আমানুল্লা খান। বহুবিবাহ প্রথা বিলোপ, নারী-পুরুষ সমানাধিকার কায়েম করা, মেয়েদের জন্য স্কুল, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার প্রবর্তন ইত্যাদি একের পর এক আধুনিক সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন তিনি। অবশেষে জনসভায় রানি সোরাইয়া প্রকাশ্যে নিজের হিজাব ছিঁড়ে ফেলায় চরম গোলমালের সৃষ্টি হয়। তিন তিনখানা গৃহযুদ্ধের আগুনে ছারখার হয়ে যায় আফগানিস্তান, আমানুল্লা ও সোরাইয়া ভারতে পালিয়ে এসে প্রাণরক্ষা করেন।
ছয়ের দশকের মধ্যভাগে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের মতই আফগানদের শিক্ষিত সমাজে মাথাচাড়া দেয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শ। রাজতন্ত্র তখনও কায়েম থাকলেও অবশেষে ১৯৭৩ সালে জাহিরের বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ নিয়ে বিরাট জনসমর্থনকে হাতিয়ার করে গদিতে চড়ে বসেন দাউদ খান, আফগানিস্তানকে গণতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করলেও প্রকৃতপক্ষে স্থাপন করেন একনায়কতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে আফগানিস্তানে প্রচুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন দাউদ, শিল্প ও শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে দেশে। দাউদের শাসনের প্রথম পর্যায় আফগানিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম গৌরবজনক অধ্যায়।
কিন্তু মেঘ জমছিল ঈশান কোণে। দাউদ ঠাণ্ডা যুদ্ধ প্রসঙ্গে নেহরুর ভারতবর্ষের দেখানো সমদূরত্ব নীতির পথে হাঁটতে চাইলে তা মোটেই ভাল চোখে দেখে না সোভিয়েত ইউনিয়ন। দাউদের সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটতে থাকে আফগান কমিউনিস্ট পার্টিরও। সঙ্গে যোগ দেয় গোঁড়া ইসলামপন্থীরা, চারিদিক থেকে কোণঠাসা হয়ে ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করতে থাকেন দাউদ খান। কমিউনিস্ট বিদ্রোহে নৃশংসভাবে গাড়ির পিছনে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয় দাউদকে, দেশের নতুন নেতা হন নূর মহম্মদ তারাকি। তারাকির প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডে খেপে গিয়ে আবার গৃহযুদ্ধ শুরু করে ইসলামিক পার্টি, মদত দেয় তারাকির প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট পার্টির শাখা। প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট নেতা হাজিবুল্লার হাতে নিহত হন তারাকি, আফগান কমিউনিস্ট পার্টির দিশাহীনতা এবং তথাকথিত বামপন্থী হাজিবুল্লার ধর্মান্ধতা দেখে এবার দেশে সরাসরি ঢুকে পড়ে সোভিয়েত সেনা, শুরু হয় আফগানিস্তানে বিদেশিদের দাদাগিরির প্রথম অধ্যায়। হাজিবুল্লাকে হটিয়ে বাবরাক কারমালকে গদিতে বসায় সোভিয়েতরা। কারমাল উদারপন্থী এবং প্রগতিবাদী হলেও একটি মারাত্মক ভুল করেন। তিনি নিজে পুশতু ছিলেন না বলে আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ পুশতুদের অগ্রাহ্য করে অন্যান্য জাতির লোকজনদের নানারকম ক্ষমতার আসনে বসাতে শুরু করেন। এর ফলে পুশতুরা ক্রমশ কারমালের উপর রেগে উঠতে থাকে।
এই সময় আসরে নামে আমেরিকা। তখন পুরোদমে চলছে ঠাণ্ডা যুদ্ধ, ভিয়েতনাম ইথিওপিয়া প্রভৃতি জায়গায় কমিউনিস্টদের হাতে নাজেহাল হবার পর যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা কামড় দিতে মরিয়া। কমিউনিস্টদের দেশ থেকে তাড়াবার জন্য তখন ছক কষছে ইসলামিক পার্টির সবচেয়ে উগ্র এবং দক্ষিনপন্থী শাখা - মুজাহিদিন। আমেরিকা সরাসরি গিয়ে হাত ধরে তাদের। সঙ্গে জিয়াউল হকের পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং ব্রিটেনের এমআইসিক্স। পুশতুদের অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে তাদের ধরে ধরে দলে টানতে শুরু করে মুজাহিদিনরা। আমেরিকার সিনেমার পরদায় তখন মুজাহিদিনের পরিচয় ‘গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামী’, তাদের সাহায্য করতে হাজির ভিয়েতনাম ফেরত জন র‍্যাম্বো। গ্রাম্য গেরিলা মুজাহিদিন যোদ্ধাদের হাতে রাতারাতি এসে যায় আনটি এয়ারক্রাফট মিসাইলের মত অত্যাধুনিক অস্ত্র। গোঁড়া ইসলামিক জেহাদে বারুদ যোগায় মার্কিন ধনতন্ত্র, গ্রামে গ্রামে মাথা তুলতে শুরু করে মুজাহিদিনরা। আমেরিকানরা মুজাহিদিনদের মদত দেবার এই গোপন প্রোজেক্টের নাম দেয় ‘অপারেশন সাইক্লোন’। তারা নতুন প্রেসিডেন্ট ডঃ নাজিবুল্লার বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের উসকাতে থাকে এই বলে যে, নাজিব দেশটা ক্রমশ রাশিয়ানদের হাতে তুলে দিচ্ছে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও চুপ করে বসে থাকে না। মুজাহিদিনদের শেষ করবার জন্য গ্রামাঞ্চলে গিয়ে অবাধে বোমাবর্ষণ চালাতে থাকে তারা, মারা যায় অজস্র সাধারণ মানুষ। এই সময়ের বিবরণ পাওয়া যায় সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ’ বইটিতে। সোভিয়েতরা তখন কাবুল শহরে দাড়িওয়ালা যুবক দেখলেই জেলে পুরে দিত, তারপর নানাভাবে তাদের বাধ্য করত সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য। সোভিয়েত বোমাবৃষ্টির ফলে গ্রামাঞ্চলে সুস্থ জীবনযাপন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ থাকতে শুরু করে বাড়ির মাটি খুঁড়ে বানানো বাঙ্কারে। খাওয়া দাওয়া, সংসার, বৈবাহিক জীবন, এমনকি সামাজিক অনুষ্ঠান অবধি হতে থাকে বাঙ্কারেই। গ্রামের মানুষ সমর্থন করে মুজাহিদদের, নাজিব সরকারের সমর্থকদের বলা হয় দেশদ্রোহী।
১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরোক্ষে নাজিবুল্লাকে সাহায্য করে চলেছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর পুরোপুরি একা হয়ে যান তিনি, এদিকে তাঁর পার্টি তখন আভ্যন্তরীণ গোলমালে জেরবার। ১৯৯২ সালে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসে মুজাহিদিনরা, কিন্তু নিরঙ্কুশ ক্ষমতালাভের জন্য আবার যুদ্ধ শুরু করেন নেতা গুলবদিন হেকমতিয়ার। আবার লাশের পাহাড় জমতে থাকে আফগানিস্তান জুড়ে। এক বছর পরে আবার খোঁজ পড়ে বাঙ্কারের। লাশ পচে যাবার আগে সরিয়ে ফেলার সময়টুকু যুদ্ধে বিরতি, তারপর আবার শুরু হয় গোলাগুলি চালানো।
এই নৈরাজ্যের মধ্যেই ১৯৯৪ সালে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে পঞ্চাশজন ছাত্র নিয়ে তৈরি নতুন সংগঠন, তালিবান। তালিব শব্দের অর্থ ছাত্র এবং বান শব্দের অর্থ দল। পাকিস্তান থেকেও ধীরে ধীরে অজস্র পাখতুন উদ্বাস্তু এসে যোগ দেয় তালিবান শিবিরে। মোল্লা ওমর প্রচার করতে থাকে একমাত্র তালিবানরাই পারে আফগানিস্তানকে এই অরাজক অবস্থার থেকে মুক্তি দিতে। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোল্লা ওমরকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির সূত্রে চিনতেন। ‘মোল্লা ওমর, তালিবান ও আমি’ বইতে তিনি বলছেন, ওমর ছিল আদ্যপান্ত ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং পুরুষতান্ত্রিক একজন মানুষ। তালিবানরা মহিলাদের মানুষ বলে মনে করত না, তাদের চোখে নারী খালি পুরুষদের সেবা এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। নৈরাজ্য থেকে রেহাই পেতে তালিবানদের উপর আস্থা রেখেছিল আফগান মানুষ, গ্রামে থাকা তালিবানদের খাবার দাবার দিয়ে সাহায্যও করত তারা। আমেরিকা পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের মদতে বিপুল শক্তিধর তালিবানেরা অবশেষে ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে, এবং দেশের নতুন নাম দেয় ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তান। সারা দেশজুড়ে চূড়ান্ত সংরক্ষণপন্থী শরিয়তি আইন চালু করে তারা। নিষিদ্ধ হয় সিনেমা, গান, থিয়েটার, ভিডিও, ফুটবল, দাবা, ঘুড়ি ওড়ানো, ছবি আঁকা, ফটো তোলা, এনজিও চালাবার অধিকার, ইন্টারনেট, এবং দশ বছরের অধিক বয়েসি মেয়েদের শিক্ষা। ইতিহাস বিজ্ঞান প্রভৃতি পড়া মানা, কারণ সেগুলি নাকি অ-ইসলামী। কাবুলের ন্যাশনাল মিউজিয়াম এবং দেশের অন্যান্য প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র শিল্পকর্মের অধিকাংশই নষ্ট হল তালিবানদের হাতে, সেগুলি নাকি ইসলামের পক্ষে অবমাননাকর। রেহাই পেল না বামিয়ানের বিরাট বুদ্ধমূর্তিও। গরিব মানুষদের ঘর থেকে জোর করে মুরগি প্রভৃতি তুলে নিয়ে গিয়ে ভোজ করত তালিবানেরা, ইসলামের নামে চালাত ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার। পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হল, এমনকি দাড়ির কায়দার উপরেও বসানো হল শর্ত। মহিলাদের ছবি ছাপা চলবে না, জোরে কথা বললে চলবে না, বোরখা না পরলে চলবে না, সঙ্গে পুরুষ না নিয়ে একা রাস্তায় বেরোনো চলবে না, আঁটোসাঁটো পোশাক পরা চলবে না, রূপচর্চা করা চলবে না, চাকরি করা চলবে না, বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়ানো চলবে না, হিল তোলা জুতো চলবে না, শরীরের কোনও অংশ এমনকি জুতোর ভেতর থেকে পায়ের পাতা দেখা গেলেও চলবে না। মহিলাদের জীবন তালিবানি আমলে হয়ে উঠল পশুর থেকেও দুর্বিষহ। প্রতিবাদ করলেই জুটবে অপমান, প্রকাশ্য রাস্তায় মারা হবে বেত, ঘটবে প্রাণসংশয়। অল্পবয়স্ক মেয়েদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো তালিবানদের যৌনদাসী হিসেবে, রেহাই পেত না বিধবারাও। কাবুলের গাজি স্টেডিয়ামকে রূপান্তরিত করা হয় এক বিরাট বধ্যভূমিতে, যেখানে পাথর ছুঁড়ে বা হাত পা কেটে হত্যা করা হতো প্রতিবাদীদের। নেতারা প্রচার করতেন সারা বিশ্বে ইসলাম ছড়িয়ে দেবার বাণী, লোভ দেখাতেন পবিত্র জেহাদে শহীদ হয়ে স্বর্গলাভ করবার। শিশুরা একটু বড় হলে পড়ার বইয়ের বদলে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো বন্দুক। তালিবানদের রোজগারের অন্যতম উৎস ছিল আফগানিস্তানের পোস্ত চাষ, পাকিস্তানে রফতানি হবার পর যা থেকে উৎপন্ন হতো হেরোইন প্রভৃতি মাদক। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনতাওয়া অঞ্চলেও তালিবানরা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে, ২০১২ সালে তেহরিক-ই-তালিবানের সদস্যরাই আক্রমণ চালিয়েছিল মালালা ইউসুফজাইয়ের উপর। তালিবান শাসনে আফগানিস্তানের নারী ও শিশুদের নারকীয় অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায় খালেদ হোসেইনির ‘দ্য কাইট রানার’, ‘আ থাউজ্যাণ্ড স্প্লেনডিড সানস’ এবং ‘অ্যান্ড দ্য মাউনটেইনস ইকোড’ উপন্যাসে।
১৯৯৮ সালে মাসুদ আহমেদের নর্দার্ন এলায়েন্স তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেও ২০০১ সালে তারা হেরে যায়। ইতিমধ্যে আমেরিকার সঙ্গে তালিবানদের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গিয়েছে অনেকটাই। তেল নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দাদাগিরিকে মোটেই ভালো চোখে দেখছিল না তারা। গোলমাল চরমে উঠল ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর কুখ্যাত উগ্রপন্থী আক্রমণের পর। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন বলে দিয়েছেন নতুন শতাব্দী হবে ‘আমেরিকান সেঞ্চুরি’, আর সেই আমেরিকার নাকের ডগায় কিনা এমন ভয়ঙ্কর আক্রমণ! নাইন ইলেভেনের স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারেনা আমেরিকা, অশুভ স্বপ্নের মতো তা বারবার ফিরে আসে ‘অলিম্পাস হ্যাজ ফলেন’ প্রভৃতি সিনেমায়। ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক আল কায়দা জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েছে তালিবান, এই অভিযোগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ মহাক্রোধে ঘোষণা করলেন আফগানিস্তানে সেনা অভিযান চালাবেন। দোসর হল টনি ব্লেয়ারের ইংল্যান্ড, শুরু হল ‘অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডম’। সেই সময় আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধবাজ মনোভাবের খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় পিটার জ্যাকসনের ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’ ফিল্ম সিরিজের প্রবল জনপ্রিয়তায়। তিন বছর বাদে তালিবান সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসেন রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে তারা আফগানিস্তানে সফলভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আফগান সেনা ও পুলিশকে উগ্রপন্থার মোকাবেলা করবার ট্রেনিং দিতে থাকে মোতায়েন থাকা মার্কিন সেনা, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করার জন্য সাহায্যও পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।
২০১৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অপারেশন এনডিওরিং ফ্রিডমের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও যুদ্ধ থামেনি আফগানিস্তানে। ঝরেছে অনেক রক্ত, খরচ হয়েছে কোটি কোটি ডলার। আমেরিকা দাবি করে, আজ অবধি প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলার গিয়েছে এই যুদ্ধের পিছনে, মারা গেছে সাড়ে তিন হাজার মার্কিন সৈন্য। জনতার ক্ষোভ আকাশ ছুঁয়েছে - এভাবে নিজেদের ছেলেদের বিদেশ বিভূঁইয়ে মরতে পাঠাতে রাজি নয় তারা। ‘হোয়াইট হাউস ডাউন’ ছবিতে দেখা যায়, যুদ্ধে ছেলেকে হারিয়ে শোকে অধীর এক বাবা রাগে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টকেই মেরে ফেলার ছক কষেছেন। এছাড়া আবু ঘ্রাইবের ভিডিও জনসমক্ষে চলে আসায় ভালোই মুখ পুড়েছে মার্কিন সরকারের, প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা। যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জারহেড, বয়েজ অফ আবু ঘ্রাইব, আইরন ম্যান, গ্রোন আপস টু প্রভৃতি একাধিক ছবি, শার্লক এর মত জনপ্রিয় সিরিজ, মায় হালের ‘দ্য ফ্যাল্কন অ্যান্ড দ্য উইন্টার সোলজার’। করোনা অতিমারির সময় এমনিতেই মার্কিন অর্থ মন্ত্রকের উপর প্রবল চাপ, তাই আগের রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের আফগানিস্তানে মোতায়েন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আটকাননি বাইডেন। এ বছরের পয়লা মে থেকে মার্কিন সেনা ঘরে ফেরা শুরু করতেই ঘটেছে বিপত্তি, মাত্র এক মাসের মধ্যে ঝড়ের বেগে আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক অঞ্চল দখল করে ফের আফগানিস্তান অধিকার করেছে তালিবানরা।
স্বভাবতই আঙুল উঠেছে আমেরিকার দিকে। স্তম্ভিত বিশ্ব প্রশ্ন তুলছে, এতদিন তাহলে আফগানিস্তানি সেনাদের কি প্রশিক্ষণ দিল আমেরিকা? এত সহজে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল তাদের গড়ে তোলা প্রতিরোধ? বাইদেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমেরিকা বছরের পর বছর আফগানিস্তানের রক্ষাকর্তা হয়ে ওখানে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না। এতদিনেও যে আফগান সেনা ভালো যুদ্ধ করতে শিখল না এটা তাদের সমস্যা, আমেরিকার নয়।
দায় সত্যিই নিতে হবে আফগান প্রশাসনকে। কুড়ি বছর সময় পেয়েও কেন একটা শক্তপোক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলেন না তাঁরা? আশরাফ ঘানির প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ ছিল, এছাড়া দেশের চরম সঙ্কটের সময় তিনি যেভাবে টাকার ব্যাগ নিয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে গেলেন, তা নিঃসন্দেহে অতি ন্যক্কারজনক কাজ। কিন্তু আমেরিকাই বা দায় এড়াবে কোন মুখে? বুশ যেভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দামামা বাজিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির মতো প্রবেশ করেছিলেন আফগানিস্তানে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়, যেমন সমালোচনা করতে হবে আজ বাইডেনের দায় অস্বীকার করবার চেষ্টাকে। দিনের পর দিন আফগানিস্তানে আমেরিকা বসে থেকেছে নেশন বিল্ডিং-এর দোহাই দিয়ে, পৃথিবীর কাছে নিজেদের তুলে ধরেছে মানবতাবাদের পরাকাষ্ঠা হিসেবে, বিশ্বজুড়ে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের’ গুণকীর্তন প্রচার করবার জন্য তৈরি হয়েছে আমেরিকান স্নাইপার, জিরো ডার্ক থার্টি, দ্য হার্ট লকার প্রভৃতি একের পর এক জনপ্রিয় ছবি। গুপ্তচরের দল যখন বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই বারবার সতর্ক করছিল এই বলে যে, দক্ষিণ আফগানিস্তান আস্তে আস্তে তালিবানদের হাতে চলে যাচ্ছে, তখন কেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয় নি হোয়াইট হাউস? আজ যখন আফগানিস্তানের মানুষ পাগলের মতো বিমানের পিছনে দৌড়চ্ছেন তালিবানের রাজত্ব ছেড়ে পালানোর জন্য, তখন আমেরিকা স্বার্থপরের মতো আগে নিজের সেনাদের বের করে নিয়ে আসার জন্য উদগ্রীব। ‘With great power comes great responsibility’ - এ কথা একজন আমেরিকান সুপারহিরোর কাকার মুখেই প্রথম শুনেছিল বিশ্ব। আজ আমেরিকা নিজেই মওকা বুঝে সেই বাণী পরিপাটি ভুলে মেরে দিয়েছে। এবং সবচেয়ে বড় কথা, সোভিয়েতকে শায়েস্তা করতে গিয়ে আফগানিস্তানের মাটিতে ধর্মীয় মৌলবাদের বীজকে মহীরুহ বানিয়েছে আমেরিকাই। ঠাণ্ডা যুদ্ধের দায় সোভিয়েতকেও অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু তালিবানের অবৈধ পিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া কেউ নয়।
আবারও ফিরে আসতে হয় সেই শুরুর কথাতেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বারেবারে বিশ্বরাজনীতির সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে আফগানিস্তান, বাইরের শক্তি এসে দখল নিতে চেয়েছে তাদের, অশান্ত করেছে আফগান জীবনযাত্রার স্বাভাবিক ছন্দ। এর সঙ্গে রাজনৈতিক সুবিধের জন্য কাজে লাগানো হয়েছে সাধারণ গ্রামবাসীদের অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা এবং পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে। আজ কাবুল বিমানবন্দরের সামনে বন্দুক হাতে তাণ্ডব চালাচ্ছে তালিবানিদের দল, নির্বিচারে হত্যা করছে প্রতিবাদী মানুষদের। রাশিয়া ও পাকিস্তান রীতিমতো স্বাগত জানিয়েছে তালিবান সরকারকে, বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং নিজের দেশের উইঘুর উদ্বাস্তুদের কথা ভেবে সমর্থনের পথে হাঁটছে চিনও। বেকায়দায় পড়ে গেছে ভারত, দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিকভাবে একা পড়ে যাবার চিন্তায় মন্ত্রীদের কপালে ভাঁজ। এ তো গেল রাজনীতির কথা। কিন্তু আফগানিস্তানের যে হাজার হাজার নারী ও শিশুদের জীবন আবার অন্ধকারে চলে গেল, তার কী হবে? ২০২০ সালেও পড়াশোনা করে পুলিশে চাকরি নেবার অপরাধে প্রকাশ্য রাস্তায় বছর তেত্রিশের খাতেরাকে ধর্ষণ করে ছুরি চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল তালিবানি জঙ্গিরা। আতাতুর্ক হাসপাতালে ঢুকে গণধর্ষণ করেছিল নার্সদের, সদ্যোজাত শিশুদের মধ্যে বেছে বেছে গুলি করে হত্যা করেছিল শিশুকন্যাদের। ইতিমধ্যেই জায়গায় জায়গায় আবার শুরু হয়েছে মহিলাদের উপর অত্যাচার, খোলা জুতো পরার অপরাধে মারা হয়েছে বেত, কোথাও আবার উপড়ে নেওয়া হয়েছে চোখ। অসীম সাহসের নিদর্শন দেখিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন আফগানিরা, আত্মরক্ষার তাগিদে বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছেন মহিলারাও। তালিবান নিঃসন্দেহে সুস্থ মানবতার শত্রু। রাজনৈতিক লাভক্ষতির অঙ্ক ভুলে মানবতার স্বার্থে প্রত্যেক দেশের উচিত অবিলম্বে আফগানিস্তান সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা।

অলংকরণ- অভীক 
#তালিবান #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য #অভীক #ওয়েবজিন #মৌলবাদ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

47

Unique Visitors

184105