এক আকাশের শূন্যতা
মেলাতে ঢুকতে সমীরের একটু দেরিই হল। এটাই চিন্তা ছিল, কিন্তু কিছু করবারও ছিল না। আসলে বাড়ি থেকে বেরোতেও একটু দেরি হয়ে গেছিল। পত্রিকার একটা অ্যাডের পেমেন্ট পাবার কথা ছিল। কলেজের বিজ্ঞাপন, সম্পাদক সায়কদা কোনও একটা সোর্স খাটিয়ে বিজ্ঞাপনটা জোগাড় করেছিলেন। অবশ্য সমীরকে এটা নিয়ে চারবার যেতে হল। একবার প্রপোজাল জমা, একবার অ্যাডের ম্যাটার আনতে, পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর চেক রিলিজের অনুরোধ নিয়ে আর শেষবার এই চেক আনতে। খুব খারাপ অবস্থা, সমীরের শরীর আর চলছে না। খুব ভোরে উঠতে হয়েছে। নেহাত আগে থেকে সায়কদা সব কিছু বলে রেখেছিলেন, না হলে অত দূর গিয়ে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসা যেত না। তাও সব কিছু সামলে মেলায় ঢুকতে অন্যদিনের থেকে একটু দেরি হয়ে যায়। সমীর তাও একবার সায়কদাকে বলেছিল, ‘একটা দিন আপনি বসলে হয় না, মানে আমার তো ফিরতে ফিরতেই অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।’
–আমারও তো তাই। স্কুল শেষ হবে চারটে, তারপর আসতেই পাঁচটা সাড়ে পাঁচটা বেজে যাবে। যদিও তখন বইমেলার পিক আওয়ার, তাও দুটো থেকে টেবিল বন্ধ থাকলে একটা উল্টো প্রতিক্রিয়া হবে। তুমি কী বলো?
সমীরেরও টেবিল বন্ধ করবার এক্কেবারেই ইচ্ছে নেই, কিন্তু আগে তো অর্থ মন্ত্রকটা দেখতে হবে। আরেকটা ব্যাপার হল ওই ‘উল্টো বই’ নামের বইয়ের স্টলটা। প্রথম দিনেই মেলা শেষ হবার আগে সমীর ওদের স্টলেই নিজেদের পত্রিকাগুলো রাখছে, কিন্তু ওদের একটা শর্ত আছে, ‘স্টল খোলার সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের সব পত্রিকা ও বইগুলো বের করে নিতে হবে।’
সমীর কোনও ভাবনাচিন্তা না করে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেছিল। না হলে অবশ্য এই দুটো ব্যাগ নিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হত। ঘড়ির দিকে তাকাতেই এই চিন্তাটা মাথার মধ্যে পাক খেতে আরম্ভ করে। সমীর বাস থেকে নেমে পা চালায়, তাও শেষরক্ষা হয় না। মেলার মাঠে পৌঁছে দেখে ‘উল্টো বই’-এর স্টলের সামনে এক্কেবারে মাঠেই সমীরদের ‘অক্ষাংশ’ পত্রিকার ব্যাগ তিনটে পড়ে আছে। মেলায় ভিড় বাড়ছে, লোকজন ব্যাগে লাথি মেরেই পেরিয়ে যাচ্ছে। সমীর তাড়াতাড়ি গিয়ে ব্যাগ তিনটে তুলে নিজেদের পত্রিকার টেবিলে নিয়ে আসে। তারপর ব্যাগ থেকে সব পত্রিকাগুলো বের করে টেবিলে সাজাতে শুরু করে। আর তখনই হঠাৎ চোখে পড়ে, এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার দিকে। ওঁরা খুব আস্তে আস্তে লিটল ম্যাগাজিনের বিভিন্ন টেবিল লক্ষ করতে করতে মেলায় ঢুকছেন। একবার তাঁদের দেখে টেবিলের দিকে পিছন ঘুরে পত্রিকাগুলো সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সমীর। এই সময় কানে আসে, ‘একটু শুনবেন?’
সমীর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়, সেই ভদ্রলোক। ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘একটু কথা ছিল, বলা যাবে?’ সমীরের হাতে তখনও ‘অক্ষাংশ’ পত্রিকার বেশ কয়েকটা সংখ্যা ধরা। তাড়াহুড়ো করেই বলে, ‘বলুন। ’
উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের একটা লম্বা শ্বাসের শব্দ সমীরের কানে আসে। তার পরেই ভদ্রলোক তাঁর ব্যাগের ভিতর থেকে একটা বই বের করে সমীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমার ছেলের লেখা, আপনি হাতে নিয়ে দেখতে পারেন।’
শেষের কথাগুলো সমীরের খুব একটা ভালো লাগল না। এমনি করে অনেকেই হাতে একটা বই দিয়ে যান। তারপর খুব মিষ্টি ভাবে কিনতে বলেন। এটাও একরকমের ব্যবসার পদ্ধতি। সমীর ভদ্রলোকের দিকে আরেকবার তাকাল। বেশ বয়স হয়েছে। সব চুল পেকে গেছে। কথা বলবার সময় একটু হাঁপও উঠছে। সমীর নিজে তার বাবা মাকে ছেড়ে একা এতদূরে পড়ে থাকে। বাবা বেশ অসুস্থ। প্রতিমাসে ভাত না খেলেও বাবার জন্যে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা ওষুধের খরচ পাঠাতে হয়। মায়ের বয়স হচ্ছে, একা কাজ করতে কষ্ট হলেও কিছু করবার নেই। এখনও পর্যন্ত কোনও কাজের লোককে রাখতে পারেনি। সমীর সব কিছু দেখে, কিন্তু কিছু করতে পারে না। পত্রিকার সম্পাদক সায়কদার মাইনে বাড়ানোর ক্ষমতা নেই। তাও বিজ্ঞাপন তুলে সেখান থেকে টুয়েন্টি পার্সেন্ট কমিশন দেয়, আর সমীর ঘোরাঘুরির জন্যে একটা টাকা পায়। সমীর অনেক সময় হেঁটে কাজ সেরে বাসের ভাড়াটা নেয়। এমনি ভাবেই চলতে থাকে। ভদ্রলোককে দেখে সমীরের নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার জন্যে প্রথম পাতাটা খুলতেই ধাক্কা খায়। বইটার প্রথম পাতাতে একটা কমবয়সি ছেলের ছবি। আর তার নিচে লেখা আবির্ভাব ও তিরোধান। তার পর সূচি পত্র দেখে। বেশ কয়েকটা কবিতা ও গল্প ছাপা রয়েছে, পিছনেও একটা ছবি।
সমীর ছবিটা ভালো করে দেখে সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার ছেলে?’
–হ্যাঁ বাবা, আমাদের একমাত্র ছেলে। একবছর হল ও আর আমাদের মধ্যে নেই। খুব ছোট বয়েস থেকে ও কবিতা গল্প লিখত। বিভিন্ন পত্রিকাতেও ওর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তারপর….
–কী হয়েছিল ?
–বলতে পারব না। জ্বর এল, কয়েকটা দিন হাসপাতাল ঘর চলল, তারপর শেষ। ডাক্তারও কিছু ধরতে পারল না। এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল, কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল।
শেষের কথাগুলো বলবার সময় ভদ্রমহিলার কথায় লম্বা শ্বাস লেগে থাকল। সমীর কিছু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কী করতে হবে?’
এবার ভদ্রলোক বললেন, ‘ও চলে যাওয়ার পর আমরা ওর পড়ার টেবিলে রাখা একটা ডায়রিতে এই সব লেখা পাই। বিভিন্ন পাবলিশারের কাছে যাই। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা, এই সবের তো বাণিজ্যিক মূল্য নেই। কেউই ওর লেখা ছাপতে রাজি হয় না। আমরা শেষমেশ নিজেদের টাকাতেই এটা ছাপাই। ওর মা তো অসুস্থ, আমাকে চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিতে হয়েছে। যা টাকা পেলাম সেখান থেকেই…’
একটু থেমে আবার বলেন, ‘কয়েকদিন আগে বইগুলো বাড়িতে নিয়ে এসেছি। তুমি বাবা তোমাদের টেবিলে ছেলের এই বইটা যদি রাখো, আমাদের ভালো লাগবে। যদি দু-একটা কপি বিক্রি হয়, তবে ওর আত্মা শান্তি পাবে। আমরা বই বিক্রির পুরো টাকাটাই একটা অর্গানাইজেশনকে দিয়ে দেব।’
সমীর ভদ্রলোকের কথাগুলো শুনে কিছু সময়ের জন্যে চুপ করে যায়। এই টেবিলটা তো ওর নিজের নয়, ও একজন মাইনে করা কর্মচারী। পত্রিকার সম্পাদক যদি এসে কিছু বলতে আরম্ভ করেন? কিন্তু এইরকম একজনের অনুরোধ না রাখাটাও তো খুব একটা সহজ কথা নয়। একটু ভেবে সমীর বলে উঠল, ‘আপনি রেখে যান। এই যে, টেবিলের বাঁ পাশে রাখুন। তবে বেশি রাখবেন না। দুটো রাখুন। মেলার শেষের দিন বই বিক্রি হলে টাকা নিয়ে যাবেন, না হলে বই দুটো।’
ওঁরা বই দুটো সমীরের দেখিয়ে দেওয়া জায়গাতে রেখে ঠিক যেমন ভাবে আস্তে আস্তে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। ওঁরা চলে যাওয়ার পর, পত্রিকা বিক্রি ও আশেপাশে টেবিলের সাথে কথা বলবার ফাঁকে সমীর বইটার পাতা উল্টে দেখতে লাগল। অল্প বয়সের কাঁচা লেখা, কিন্তু কত স্বপ্ন জড়িয়ে আছে, কত আশা, লেখক হবার কত তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
সায়কদা কিছু বলেননি। বইটা উল্টেপাল্টে দেখে বলেছেন, ‘ঠিক আছে, টেবিলের একটা পাশে থাকুক না, অসুবিধার কী আছে!’
সমীরকে প্রতিদিন টেবিলে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত থাকতে হয়। তার মধ্যেই সায়কদা এসে যান। তারপর সমীরের ছুটি। সমীর মেলা ঘোরে। বই দেখে। পুরোনো বইয়ের স্টলে যায়, বই নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় গ্রামের মেলার কথা মনে পড়ে। তখন কাকা জ্যাঠারা মেলা দেখতে টাকা দিত। খুব বড় অঙ্কের টাকা না হলেও সেইটুকুই ছিল সাত রাজার ধন। কত কী কেনার প্ল্যান হয়ে যেত তাই দিয়ে। এই বইমেলা দেখার জন্যে কেউ যদি ওরকম টাকা দিত! সমীর একবার সায়কদার কাছ থেকে নিজের মাইনের কিছু টাকা অগ্রিম নেওয়ার কথা ভেবেছিল। তারপর থেমে যায়। মাইনের পুরো টাকাটাই বাড়িতে পাঠাতে হয়। সেখানে কম হলে ওষুধ কেনা বা অন্যান্য বিষয়ে সমস্যা হয়ে যেতে পারে। তাই ভেবেছে বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য কিছু জায়গায় পাওয়া টাকা থেকে দেখবে শেষ দিনে কিছু বই কেনা যায় কি না।
শেষ দিনে স্টল ও টেবিল পিছু একটা করে মিষ্টির প্যাকেট ও একটা স্মারক দেওয়া হয়। সায়কদা অ্যালটমেন্টের কাগজ দেখিয়ে সেসব নিয়ে এসে সমীরের হাতে মিষ্টির প্যাকেটটা তুলে দেয়। বলে, ‘এটা তুমিই নিয়ে যাও। আমার বাড়িতে বাবা মা দুজনেই সুগারের পেশেন্ট। আমি বরং এই স্মারকটা নিচ্ছি।’
টেবিলের একদিকে সেই দুটো বই রেখে সমীর ও সায়ক তাদের সমস্ত পত্রিকাগুলো একে একে গুছিয়ে রাখতে থাকে। এমন সময় টেবিলের সামনে সেই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা আসেন। সমীর তাঁদের দুজনকে দেখে সৌজন্য বিনিময় করে খুব আস্তে আস্তেই বলে, ‘বইদুটো বিক্রি হল না স্যার। আমার খুব খারাপ লাগছে।’
–না না, খারাপ লাগার কী আছে, ও তো আর দেখতে আসবে না। একটা বইও যদি বিক্রি হত, আমাদেরই একটু ভালো লাগত আর কি। দেখি, এই বইমেলাতে না হলে অন্য বইমেলাতে এমনিই দিয়ে দেব। বেশি তো ছাপাইনি।
কথাগুলো বলে ভদ্রলোক বই দুটো ব্যাগে রাখতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় সমীর বলে উঠল, ‘শুনুন, আমাকে একটা বই দিয়ে যান। দেড়শো টাকা দাম তো?’
তার পরেই মানিব্যাগ থেকে টাকাটা বের করে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বলে, ‘এই যে, ধরুন।’
–না বাবা, তোমাকে টাকা দিতে হবে না। তুমি এমনি রাখো।
–তা হয় না, এই যে আপনি বললেন, ‘বই বিক্রির টাকাটা কোথায় একটা দান করবেন। বিলিয়ে দিলে তো আপনার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে না।’
এ বছরের মতো মেলা শেষের দরজায়। একটু পরেই ঘণ্টা বেজে উঠবে, সবাই হাততালি দিয়ে আগামী বছরের বইমেলাকে এই বছরেই স্বাগত জানাবে। শুধু অক্ষাংশ পত্রিকার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অসহায় বাবা মায়ের মুখে একটুকরো হাসি কেউ দেখতে পেল না।
[ অলংকরণ: অভীক ]
#বাংলা #গল্প #ঋভু চট্টোপাধ্যায়