পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পুরোদস্তুর গোয়েন্দা হলেন মেয়ে
বর্মাতেই মেয়েটির জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। কিন্তু গুপ্তঘাতকের হাতে মায়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই এতদিনের চেনা জগৎটা ছেড়ে কলকাতায় চলে আসতে হয়েছিল তাকে। তখন তার বয়স ষোলো-সতেরো মাত্র। কিন্তু ভবানীপুরের পৈতৃক বাড়িতে ফিরে এসেও সেই ভিনদেশি দস্যুর কবল থেকে রেহাই পেল না কৃষ্ণা। দুঃসাহসী বর্মি দস্যু ইউ-উইন কলকাতার বুকেই খুন করল তার বাবাকেও, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার সত্যেন্দ্র চৌধুরীকে।
অচেনা নতুন শহরে একটি অনাথ কিশোরী মেয়ের এরপর কী করার থাকতে পারে? শোকে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়া, বড়জোর পুলিশের সাহায্য নেওয়া ছাড়া? কৃষ্ণা কিন্তু সব পরিচিত ছক ভেঙে সিদ্ধান্ত নিল, সে নিজেই মোকাবিলা করবে এই দুর্দান্ত দস্যুর। অচিরেই অপহৃত হল সে, সঙ্গে লোপাট গুপ্তধনের নকশাও।
এহেন ছকভাঙা পথেই উনিশ শতকের জনপ্রিয় লেখিকা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী গড়ে তুলেছিলেন কৃষ্ণাকে। আজ্ঞে হ্যাঁ, কৃষ্ণা রক্তমাংসের মানুষ নয়, সে বইয়ের চরিত্র। কিন্তু হাজার চরিত্রের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার মতো মেয়ে সে নয়। কারণ, তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য পেয়েছিল প্রথম মেয়ে গোয়েন্দার ধারাবাহিক সিরিজ।
উনিশ শতকের প্রৌঢ়ত্বে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দাকাহিনি বলে একটি নতুন জঁরের জন্ম হলেও রীতিমতো গোয়েন্দার ভূমিকার মেয়েদের অবতীর্ণ হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। গোয়েন্দাসুলভ বুদ্ধি বা শারীরিক সক্ষমতা কেবল পুরুষেরই অর্জন, এই অনড় মিথের শিকড়ে শুধু আঘাত হানাই নয়, পূর্বপ্রচলিত ওই ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের দুনিয়াকে চমকে দিল যে মেয়ে গোয়েন্দা এবং সেই চমকের জের ধরে রাখল আগামী অনেকগুলো বছর, তার জন্মও হল আর-এক মেয়ের হাতেই। ‘আকস্মিক বিপদে পড়ে শুধু উপস্থিত বুদ্ধির জোরে কেমন করে উদ্ধার পেতে পারেন’ মেয়েরা, এ বইয়ে রয়েছে তার ইঙ্গিত– ‘শুকতারা’-র বৈশাখ, ১৩৫৯ সংখ্যায় সিরিজ প্রবর্তনের এই বিজ্ঞাপনটিই এযাবৎ প্রচলিত মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার মিথকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। অবশ্য কৃষ্ণার জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে তার আগের দশকেই। দেব সাহিত্য কুটীরের বিখ্যাত দুটি সিরিজ ‘প্রহেলিকা’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-তে চারটি কাহিনি প্রকাশের পর, কৃষ্ণা যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জনের পরিবর্তে সাধারণের উপকারে লাগার মতো কোনও কাজে সে লিপ্ত হতে চায়, তখনই তাকে নিয়ে একটি একক সিরিজ প্রবর্তনের কথা ভাবে এই প্রকাশনা। আর ‘মহিলা গোয়েন্দা’ বিষয়টিই যখন প্রায় অচেনা, সেকালে এই ঝুঁকি নেওয়া যে বিফল হয়নি, তা বোঝা যায় অব্যবহিত পরেই মেয়ে গোয়েন্দা অগ্নিশিখা রায়কে নিয়ে প্রভাবতী দেবীরই আরও একটি সিরিজ প্রবর্তনে। লেখিকা জানান- “শুধু ছেলেদের ছাড়া মেয়েদের ‘অ্যাডভেঞ্চারে’র বই এ পর্য্যন্ত কেউ লেখেন নি। এই কারণেই ‘কুমারিকা সিরিজের’ আবির্ভাব। কোন আকস্মিক বিপদ এলে কলেজের মেয়েদের যা করা প্রয়োজন, ‘কুমারিকা সিরিজ’ পড়লেই তার ইঙ্গিত পেয়ে যাবে।”
উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে সুগঠিত চেহারা, মাতৃভাষা ছাড়াও পাঁচ-সাতটা ভাষায় অনর্গল বাক্যালাপের দক্ষতা, অশ্বারোহণ, মোটর চালানো, কৃষ্ণা ও শিখার গুণাবলির তালিকা কমবেশি একই। একজন যেমন মা-বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে অকুতোভয়, অন্যজন অনায়াসে অপরের হুকুমের পরোয়া না করে নিজের শর্তে জীবনে বাঁচার ঘোষণা করে। সেদিনের নারী নয়, নারী যা হয়ে উঠতে পারে, মেয়েদের সামনে সেই আগামীর মডেল উপস্থিত করতে চেয়েছিলেন চিরন্তনী শিক্ষিকা প্রভাবতী দেবী। তাঁর ধারণার আদর্শ নারী গড়ে তোলার তাগিদেই কৃষ্ণার জবানিতে জানিয়েছিলেন- “মেয়েরাও মানুষ মেসোমশাই! তারাও যে শিক্ষা পেলে ছেলেদের মতোই কাজ করতে পারে, আমি শুধু সেইটাই দেখাতে চাই। চিরদিন মেয়েরা অন্ধকারে অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে, আমি তাদের জানাতে চাই, পিছিয়ে নয়- সামনে এগিয়ে চলার দিন এসেছে, কাজ করার সময় এসেছে,- মেয়েরা এগিয়ে চলুক, তাদের শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিক।” এমন মেয়ে স্বপ্নে ছিল তাঁর! স্বপ্ন বলেই লাগাম ছিল না তাতে। ছিল আতিশয্য আর অতিনাটকীয়তা। পাশাপাশি মেয়েদের সম্বন্ধে প্রচলিত দীর্ঘদিনের নির্বুদ্ধিতার মিথ ভাঙতে পারলেও সহজ ছিল না সুপ্রাচীন পিতৃতন্ত্রের শিকল ভাঙা। কৃষ্ণা সিরিজের বিজ্ঞাপনে সদ্যস্বাধীন দেশের ‘মা-বোন’দের পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হবার ডাক দিলেও সে স্বনির্ভরতার মধ্যে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কোনও ভাবনা ছিল না, কেবলমাত্র ‘স্বৈরাচারীদের অত্যাচার’ থেকে আত্মরক্ষাই ছিল তার লক্ষ্য।
আসলে একুশ শতকের অনেকখানি আলোকিত পথে দাঁড়িয়ে ফেলে-আসা পথের অপারগতাকে যত সহজে চিহ্নিত করা যায়, সেই সময়ে আদৌ কি ততখানি সম্ভব ছিল সেই না-পারাকে পেরিয়ে যাওয়া? এই দ্বন্দ্বের উত্তর খুঁজতে হয়তো ফিরে তাকাতে হয় প্রভাবতী দেবীর লেখক সত্তার পাশাপাশি ব্যক্তিক জীবনের দিকেও। দেখা যায়, অন্তত তিনশো বইয়ের সম্ভার, শিক্ষকবৃত্তি, সরস্বতী উপাধি, ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ, অত্যধিক জনপ্রিয়তার দরুন তাঁর নাম নকল হওয়া, এই আলোর বৃত্তের পরিধিতে রয়েছে আঁধারে ঘেরা এক জীবন। যেখানে ন’বছর বয়সে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফেলে-আসা বাড়ির জন্য মনখারাপ করায় বাঁকা কথা কানে আসে। মুহূর্তে নতুন বাড়ি আর সম্পর্ক, দুই-ই ছেড়ে বালিকা প্রভাবতী ফিরে এসেছিলেন পুরোনো ঠিকানায়। ফিরে যাওয়া হয়নি আর কখনোই। কিছুদিন পরে আবার ঠিকানা বদল, এবার ভাইয়ের পড়াশোনার জন্য। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের সংসারে বোনের স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর চেয়ে ভাইয়ের কলেজে ভরতি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল বই কি।
বারবার এমন ছেড়ে যাওয়ার বাধ্যতাই হয়তো তাঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল মেয়েদের নিজের ঘর গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে। তাই চলতি ছকের মধ্যেও বারবার তাঁর কলমে উঠে আসছিল শিক্ষিতা, কর্মপটু, স্বয়ংসম্পূর্ণ মেয়েদের ছবি। যার গহনে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায় গৎ-বন্দি তকমা পাওয়া এই লেখিকা পৌঁছোতে চাইছেন নারীর অনাশ্রয় আর সহায়হীনতার ইতিহাসে। সেই একই পরম্পরার অংশভাক প্রভাবতী দেবী তাদের সমাজ-নিয়তির প্রতারণা থেকে বাঁচাতে চাইছিলেন আত্মশৃঙ্খল আর কর্মশৃঙ্খলার নিদান দিয়ে। আর এই প্রণোদনা থেকেই হয়তো জন্ম গোয়েন্দানী কৃষ্ণা আর শিখার। কে জানে, নিজের জীবন-অভিজ্ঞতায় মেয়েদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে যেভাবে চিনেছিলেন তিনি, তা-ই অবচেতনে তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল কি না এমন আত্মপ্রত্যয়ী দুটি নারীচরিত্র সৃষ্টি করতে!
...............................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]