নিবন্ধ

কবিতার পেয়ালা

শাওন নন্দী July 25, 2020 at 4:22 am নিবন্ধ

আড্ডা -১

হতে পারে আপনি আমার পুরনো বন্ধু । হতে পারে আজই আপনার সঙ্গে আমার আলাপ । আমাদের আরেক বন্ধুর সঙ্গে অবশ্য আমাদের দুজনেরই সম্পর্ক অনেক দিনের । আজ, মূলত তার জন্যই আমাদের এখানে আসা । সে আমাদের কমন ফ্রেন্ড, কবিতা । এ হল আমাদের তিনজনের আড্ডাখানা । এই অতিমারি আক্রান্ত দিনকালে যখন ব্যাধিটা আর শুধুই শারীরিক নয়, ঘরে আটকে বসে থাকার একঘেয়েমি আর অনিশ্চয়ের ভয় যখন দিনকে দিন চেপে বসছে মনের ওপরে, ঠিক তখন নিরাময় না হোক অন্তত শুশ্রূষার মতো আমাদের মনের রাস্তাটা এসে পৌঁছল ‘সিলি পয়েন্ট’-এ । যে খোলামেলা নতুন তৈরি বাড়িটার বারান্দায় বসে কবিতার পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে দু-চারটে মনের কথা ভাগ করে নিতে চাইব আমরা তিনজন। ‘আপ , ম্যায় ঔর’ ... বন্ধু কবিতা !

ভাবছেন কবিতার পেয়ালায় আবার কবিতাই চুমুক দেবে ? এও কি সম্ভব ? ... বস্তুত আপনিও তো আপনার পেয়ালায় চুমুক দেন মাঝেমধ্যে, আমি আমার । এ খুব অসম্ভব কথা কিছু নয় । তবে একথা ঠিক, এই অন্যরকম আড্ডায় বকবকানির প্রাথমিক ভূমিকাটা আমারই । কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার কথায় ভাবনায় এক মুহূর্তের জন্য আপনারা বাদ পড়বেন না, আপনাদের কথা আর ভাবনার কিছু কিছু যদি আমার কথা ছুঁয়ে না-ই যেতে পারে, তবে আর আড্ডা কিসের ! ... প্রতি শনিবার আমরা একবার মুখোমুখি হবার চেষ্টা করব । যদিও দিনকাল ভালো নয় । যদি কোনো এক শনিবার না আসতে পারি, বুঝবেন বান্দা মনে মনে আপনার পাশটিতেই বসে ছটফট করছে, পরের হপ্তায় আবার মুখোমুখি বসার জন্য ।

এক পেয়ালা কবিতার এই সব কথায় ধোঁয়ার আবছায়া থাকবে, থাকবে মনের চলকে ওঠা, হয়তো থাকবে আড্ডা জমিয়ে তোলার মৌতাতও ... শুধু যেটা থাকবে না, সেটা হল পণ্ডিতি । এর কারণ বোঝা খুব সহজ, সেটা হল এই আড্ডাবাজ বস্তুত মূর্খ মানুষ । তাই আপনি পণ্ডিত হলেও আমার অপারগতার কারণেই আমি পণ্ডিতের আড্ডা এখানে দিতে আসব না । যাকে সংস্কৃত ভাষায় আপনারা ‘অ্যাকাডেমিক’ বলে থাকেন, আমি তার কিছুই জানি না । কবিতার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, কোনো কোনো জায়গায় সে পাণ্ডিত্য দেখায় বটে, কিন্তু অন্তরে তার এমন কোনো দেখনদারি নেই ।

নইলে একদিন কথায় কথায় সে এইকথা আমাকে বলবেই বা কেন যে, আমি কেমন বন্ধুতা পছন্দ করব ... হিপোক্রিটিকের না হিপোপটেমাসের ? ... কবিতার স্বভাবই ওই, সে তো চট করে সোজা কথা বলার মানুষ নয় । আমি বললুম, ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বললে বুঝতে সুবিধে হয় । কবিতা বলল, আরে বুঝলে না ? আমাকে নিয়ে কথা বলতে কে না পছন্দ করে ? যে ‘আবোল তাবোল’ পর্যন্ত পড়েনি, সে-ও কবিতা নিয়ে ঠিক ঘন্টা দুয়েকের টানা আবোল-তাবোল বক্তিমে ঝেড়ে দিতে পারে । কিন্তু জেনুইন ক্রিটিক যাঁরা, তাঁরা আমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নিজেদের জানার বিজ্ঞাপন করেন না, আমাকে আমার মর্যাদাটুকু দিয়ে জানার আলোর সাজ পরিয়ে দেন । আমাকে সুন্দর করে তোলেন ।

কিন্তু হিপোক্রিটিকদের শ্রেণি আলাদা । তাঁরা যা বলেন, তা বিশ্বাস করে বলেন, এমনটা তো নয় ! তাই মন খুলে তাঁদের সঙ্গে দুটো কথা বলব, তার উপায় নেই । আমাকে সাইডে ঠেলে ‘দুর্দান্ত পাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত’-কে সত্যি করে তোলাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় । তুমি ভাই আড্ডা মারতে এসে অমন জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা বললে, আমার সঙ্গে তোমার পটবে না । ... আমি আশ্বস্ত করে বললাম, আরে সে ভয় তোমার একেবারেই নেই, আমি যে মিছিমিছি পণ্ডিতের ভাণ করব, সেইটুকু জ্ঞানগম্যিও যদি বিধাতা দিতেন, তাহলে কি লোকে আমায় এমন হেলাফেলা করতে পারত ? ... হ্যাঁ এটা ঠিক, এমন একটা কাজ আমি করে খাই, সেখানে তোমাকে নিয়ে দু-চার কথা বললে তবেই রুজি-রুটি টিকে থাকবে । কিন্তু, সে সব কথায় আমার মূর্খামিই ধরা পড়ে । ছেলেছোকরার দল ওই ক্ষমাঘেন্না করে দেয় আর কি ! ...

কিন্তু হিপোপটেমাসটা কী ব্যাপার ? ... কবিতা বলল, আরে ... এও বলে দিতে হবে ? তুমি কবিতার রূপক কিস্যু বোঝোনা দেখছি ! চিড়িয়াখানায় হিপো দ্যাখোনি ? ... তেড়ে বললাম, কে বলল দেখিনি ? কতবার দেখেছি ! ... চিড়িয়াখানা, সার্কাস, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট, আয়না ... ! কবিতা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, থাক থাক, ওতেই হবে । চিড়িয়াখানার ডোবার ওই এঁদো জলে তাদের গা ডুবিয়ে বসে থাকতে দেখেছ ? ... বললাম, হ্যাঁ ডাঙায় চরতেও দেখেছি দৈবাৎ ... আসলে তো ডুব মেরে থাকাই ওদের পছন্দ বলে মনে হয় , অনেকটা তোমারই মতো ।

মিচকি হেসে কবিতা বলল, ঠিক বলেছ । আমার বন্ধু হতে হলে ওটাই আসল কথা । ডুব দিতে হবে । মাঝেমধ্যে চোখ-নাক তুলে পাবলিকের সামনে ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ করবে । বাকি সময়টা ডুবে থাকতে পারলে, একমাত্র তবেই আমার কিছুটা কাছাকাছি পৌঁছনো যাবে ।

আমার সাধ্য বলতে সেইটুকুই ।

পাঁচিলের ওপার থেকে দাঁড়িয়ে কেউ পাঁউরুটির টুকরো, ডিমের সাদা, কলার খোসা , লেবুর কোয়া ... যা খুশি ছুঁড়ে দিতে পারেন ... তবু, আমি হিপোক্রিটিক হতে পারব না । এ আমার হিপো-জন্ম । আর তাও খেমতা বলতে আফ্রিকার নদী-টদি নয়, চিড়িয়াখানার ঘোলা ডোবায় দু-চারটে ডুব মারা ।

এই সব নিয়েই আড্ডা । আমার না-পারাগুলো আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে রাখল । ... যেটুকু যা পারা, সে না হয় আগামী শনিবার থেকেই শুরু হবে ...



অলংকরণ : বিবস্বান দত্ত

#গদ্য #কবিতা #শাওন নন্দী #কবিতার আলোচনা #সাপ্তাহিক সিরিজ #সিরিজ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

91

Unique Visitors

183111