ইচ্ছেমতো শরীর ভেঙে জুড়তে পারে গুবরে
পেট্রোলের দাম যতই আকাশছোঁয়া হোক, রাগ করে যে গাড়ি ছেড়ে রোজ বাস-মেট্রোতে ঝুলবেন, ইচ্ছে থাকলেও সে উপায় নেই। অব্যবহারে গাড়ি নষ্ট হবে যে! তাই সাধের গাড়িটির স্বার্থে কিছু না কিছু মূল্য আপনাকে দিতেই হয়। মাঝে মাঝে গভর্নমেন্টের রাগ গিয়ে পড়ে গাড়ির উপর, মনে হয় এ ব্যাটা আছে বলেই তেলের শ্রাদ্ধ হচ্ছে! একবার ভাবুন তো, যদি গাড়ির ইঞ্জিনখানা টুকরো টুকরো করে রাখা যেত তেলের দাম না কমা অবধি? আর দাম কমলে, আবার সেগুলো জুড়ে আস্ত ইঞ্জিন বানিয়ে তেল ঢাললেই যদি ছুটতো গাড়ি?
আপনি ভাবছেন গাঁজাখুরি, বিজ্ঞানীরা ভাবছেন গুবরে। আজ্ঞে হ্যাঁ, মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানো গোলগাল গুবরে পোকা। তবে সবাই নয়, এক বিশেষ প্রজাতির পোট্যাটো বিট্ল নিজের শীতঘুমের সময় প্রায় এমনটাই করে থাকে। শীতকালে যখন কানাডা পুরু বরফের চাদরে ঢেকে যায়, তাপমাত্রা চলে যায় মাইনাস কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে, তখন কলোরাডো পোট্যাটো বিট্ল মাস চারেকের জন্য জমিয়ে ঘুম লাগায়। কিন্তু শুধু তো চোখ বুজে নাক ডাকলেই হল না, খাওয়াদাওয়া ছাড়া এতটা সময়ে শরীর যাতে না বিগড়োয় সে খেয়ালও রাখতে হয়। তাই পোট্যাটো বিট্লরা করে কী, নিজেদের বিপাকক্রিয়া প্রায় নব্বই শতাংশেরও বেশি কমিয়ে ফেলে! খাবার হজম ও পুষ্টির গোটা প্রক্রিয়াটাই এক ধাক্কায় এতটা কমে যাওয়ায় খাবার জোগাড় করা নিয়ে আর চিন্তা থাকে না। কিন্তু কীভাবে গুবরেগুলো বিপাকের হার এতটা কমিয়ে ফেলে, সেইটা সবার অজানা।
সেই অজানার খোঁজে মাঠে নেমেছিলেন কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী, তাদের পুরোভাগে ছিলেন ব্রেন্ট সিনক্লেয়ার এবং জ্যাকলিন লেবেনজন। তারা গবেষণাগারের কৃত্রিম পরিবেশে আলো আর তাপমাত্রার মরসুমি পরিবর্তনকে নকল করলেন, আর তার প্রভাব লক্ষ করলেন একদল কলোরাডো পোট্যাটো বিট্ল-এর উপর। উদ্দেশ্য সোজাসাপ্টা – পোকারা কী করে বিপাককে বোকা বানায়, তাই দেখা। জীবকোশের বিপাকক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় অক্সিজেন, যা কিনা একটা লম্বা রাসায়নিক বিক্রিয়ার শৃঙ্খলের শেষ প্রান্ত থেকে টুক করে ইলেকট্রনকে তুলে নেয় নিজের পিঠে। এর ফলে যে শক্তি উদ্ভুত হয়, কোশ তাকে সঞ্চয় করে রাখে এটিপি অণুর মধ্যে। আর এই গোটা ব্যাপারটা চলে কোশের মধ্যে থাকা প্যাঁচালো অঙ্গাণু মাইটোকন্ড্রিয়ার ভিতরে। মনে করে দেখুন, ক্লাস নাইনের লাইফ সায়েন্স বইয়ের সেই অমোঘ উক্তি – “মাইটোকন্ড্রিয়া ইজ দ্য পাওয়ার-হাউজ অফ দ্য সেল”! আর এটিপি হল সেই পাওয়ারের এক একটা ক্ষুদে প্যাকেট। কাজেই বিজ্ঞানীরা বিপাকক্রিয়ার পরিমাপ করতে চাইলে, কতটা অক্সিজেন শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে বা কতগুলো মাইটোকন্ড্রিয়া সক্রিয় আছে, সেইটা দেখলেই হয়। প্রথমটা অপেক্ষাকৃত সহজ, তাই বিজ্ঞানীরা অক্সিগ্রাফ যন্ত্র বাগিয়ে তা মাপতে বসলেন। যন্ত্রে মাপ দেখাল শূন্য। একবার না, প্রতিবার।
জ্যাকলিন নিশ্চিত, যন্ত্রখানা দেহ রেখেছে। যখন দেখা গেল যন্ত্রের কোনও গোলমাল নেই, তখন ভাবলেন, তাহলে নিশ্চয়ই পরীক্ষার কোনও ধাপে বড়সড় ভুল থেকে গেছে। সে সম্ভাবনাও যখন খারিজ হল, তখন বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, একবার সক্রিয় মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যাটা মেপে দেখা যাক। বিপাকক্রিয়ার হার কমে গেলে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা কমে – এটা মোটামুটি একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। গুবরেদের ক্ষেত্রেও যদি মাইটোকন্ড্রিয়া কিছু কমেই থাকে, বিপাকক্রিয়ার হার তো শূন্য হওয়ার কথা নয়! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই জ্যাকলিন চোখ রাখলেন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের পর্দায় আর অমনি তাঁর মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখা কলোরাডো বিট্ল-এর ডানার পেশিকোশের সারি ভেসে উঠেছে সে পর্দায়, আর সেখানে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা – শূন্য।
অনেক খুঁজেপেতে সে যাত্রায় গুটিকতক মাইটোকন্ড্রিয়া পেয়েছিলেন তিনি, সেও না-পাওয়ারই সমান। কোন এক অদ্ভুত খেয়ালে গুবরেপোকারা নিজেদের ডানার পেশির অধিকাংশ মাইটোকন্ড্রিয়া নষ্ট করে ফেলেছে। ফলে সেসব পেশি এখন অকেজো বললেও কিছুই বলা হয় না। এতে শীতঘুমের সময়ে নাহয় পুষ্টির চাহিদা জন্মাচ্ছে না, কিন্তু শীতের শেষে কী হবে? এই ঘুমই চিরঘুম হয়ে যাবে যে! গরিবের জন্য অনুপম আছেন, গুবরেদের জন্য প্রকৃতি। তার আলো-হাওয়া-উষ্ণতা জানান দেয় ‘বসন্ত এসে গেছে’। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা চালিয়ে গেলেন, পরীক্ষাগারের পরিবেশ করে তুললেন বসন্তসম, আর তাঁদের ফের চমকে দিয়ে গুবরেরা নতুন করে তৈরি করতে থাকল মাইটোকন্ড্রিয়া। একসময় সম্পূর্ণরূপে গড়ে তুলল নষ্ট করে ফেলা পেশি। সাধারণত কোনও রোগের প্রভাবে মাইটোকন্ড্রিয়া নষ্ট হলে সেই ঘটনাকে বলে ‘মাইটোফ্যাজি’। ব্রেন্ট আর জ্যাকলিন মিলে দেখালেন, শীতের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মাইটোফ্যাজির মাধ্যমেই গুবরেরা পেশির মাইটোকন্ড্রিয়াগুলি ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু যে আজব ক্ষমতায় তারা গোটা পেশির শতসহস্র কোশের ততোধিক মাইটোকন্ড্রিয়া আবার নতুন করে তৈরি করে, তা বিজ্ঞানের কাছে এক বিস্ময়! এই ঘটনা প্রকৃতিতে বিরল না হলেও, এত উচ্চক্ষমতায় তার প্রকাশ বিরলতম। যেসব মহাকাশচারীরা দীর্ঘ দিন ধরে মহাকর্ষশূন্য জায়গায় থাকেন, তাঁদের পেশিতেও মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়। আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক কসরৎ করলে আস্তে আস্তে আগের অবস্থায় ফিরে আসে। অথচ কলোরাডো পট্যাটো বিট্লকে এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একটা ডানাও নাড়াতে হয় না।
তবে কি বিট্ল পরিবারের সব সদস্যের এমন সুপারপাওয়ার কমবেশি আছে? ঠিক কীভাবে ইচ্ছেমতো বদলে নেওয়া যায় কোশের মাইটোকন্ড্রিয়ার মানচিত্র? উত্তর এখনও খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। সফল হলে, শরীরের ক্ষয়জনিত দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময়ের পথে হয়ত আরও খানিকটা এগোব আমরা। ততদিন অবধি গুবরেদের চরণে পেন্নাম ঠুকে চলা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই।
..................
#Colorado beetle #Popular Science #silly পয়েন্ট #বিজ্ঞান #গুবরেপোকা