ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

দ্য ওয়াকিং ডেড : মানুষ আর মানবতার আরও দুই মুহূর্ত বেঁচে থাকার লড়াই

মৃণালিনী ঘোষাল Nov 4, 2020 at 3:25 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সিরিজ : দ্য ওয়াকিং ডেড
সিজন সংখ্যা : ১০ (১১ নম্বর সিজনে সমাপ্য)
কাহিনি : রবার্ট কির্কম্যান
পরিচালক : ফ্রাঙ্ক ডারাবন্ট
অভিনয় : অ্যান্ড্রু লিঙ্কন, জন বার্নথাল, লরি হোল্ডেন, সারা ওয়েন কলিস, জেফ্রি ডে মুন, স্টিভ ইউন, নরম্যান রিডাস, লরেন কোহান প্রমুখ
মিউজিক : বিয়ার ম্যাক্রারি
সিনেমাটোগ্রাফি : রন স্কিমিড, ড্যানি বয়েড
প্রথম সিজনের মুক্তি : ২০১০
মুখ্য পরিবেশক : এ.এম.সি. (আমেরিকান টিভি চ্যানেল)
বর্তমান পরিবেশক : নেটফ্লিক্স

‘জম্বি’ বিষয়টাকে সবচেয়ে বিখ্যাত করেছিল এই আমেরিকান টিভি সিরিজ। আজ নানা অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম এসে সিরিজে সিরিজে ছয়লাপ করে দিয়েছে আমাদের দৈনন্দিন। জম্বি বা অন্যান্য অ্যাপোক্যালিপটিক কনসেপ্টও আজ বহু ব্যবহারে জীর্ণ। এর পঁচানব্বই শতাংশই সাময়িক আলোড়ন তুলে হারিয়ে গেছে বা যাবে। আর কোনও প্রজেক্ট পারেনি দীর্ঘ দশ বছর ধরে দর্শককে কমবেশি একইরকম বুঁদ রাখতে। ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ সে অর্থে ইতিমধ্যেই একটা আস্ত ইতিহাস, যা এখনও রচনা হয়ে চলেছে।  

জম্বি নিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক ছবির স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৩২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভিক্টর হালপেরিনের ‘হোয়াইট জম্বি’ ছবিকে, কিন্তু জনপ্রিয়তা পেতে পেতে জম্বিদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৬৮ সালে জর্জ রোমেরোর জম্বি-হেক্সালজির(ছ’টি ফিল্ম) প্রথম ফিল্ম ‘নাইট অব দ্য লিভিং ডেড’-এর মুক্তি পর্যন্ত। তারপর থেকে সারা বিশ্ব জুড়ে জম্বি নিয়ে ছবির সংখ্যা নেহাত কম না। তাই এই সিরিজ বিষয়বস্তুর দিক থেকে একেবারে নতুন কিছু দিয়েছে, তা বলা যাবে না। তবু আজ থেকে এক দশক আগে ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’-এর প্রথম সিজন বাজার মাত করে দিয়েছিল, কারণ এর আগে জম্বি নিয়ে এত বিরাট ব্যাপ্ত চালচিত্রে এমন অসাধারণ টানটান ডিসটোপিয়ান কাহিনি এবং উপস্থাপনা মানুষ দেখেনি। দশ বছর পেরিয়ে এসেও তার জনপ্রিয়তায় সামান্যই ভাঁটা পড়েছে। 












রবার্ট কির্কম্যান ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ নামে একটি দীর্ঘ কমিক বুক সিরিজ লিখেছেন, যার প্রথম ইস্যু প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। সঙ্গে ছবি এঁকেছেন শিল্পী টনি মুর। ২০১৯ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে প্রকাশ হয়েছে এই কমিকস। সাড়া জাগানো এই গ্রাফিক কাহিনি নিয়েই শওশ্যাঙ্ক রিডেম্পশন-খ্যাত পরিচালক ফ্রাঙ্ক ডারাবন্ট ২০১০ সালে এই টিভি সিরিজের পরিকল্পনা করেন। প্রধান চরিত্র ডেপুটি শেরিফ (পুলিশ অফিসার) রিক গ্রিমস। দুষ্কৃতির গুলিতে আহত হয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জ্ঞান ফিরে রিক দেখে দুনিয়াটা পাল্টে গেছে। শহর চলে গেছে ‘ওয়াকার’-দের দখলে। গলি থেকে রাজপথ সর্বত্র জান্তব খিদে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বীভৎসদর্শন চলমান মৃতেরা। রিক নিজের বাড়ি গিয়ে স্ত্রী বা ছেলে কাউকে খুঁজে পায় না। সমস্ত শহর যেন মৃত্যুপুরী। অনেক কষ্টে প্রাণ বাঁচিয়ে রিক একটি দলের সঙ্গে মিলিত হয়, যারা ওয়াকারদের থেকে বাঁচতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আশ্রয় নিয়েছে। পরে সেখান থেকে বের হয়ে তারা মিলিত হয় বৃহত্তর একটি দলের সঙ্গে, যেখানে রিক খুঁজে পায় নিজের স্ত্রী লরি আর ছেলে কার্লকে। এরপর রিকের নেতৃত্বে শুরু হয় দলটির অস্তিত্বের সংগ্রাম। পদে পদে ওঁত পেতে থাকে মৃত্যু। চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা পরীক্ষা নিতে থাকে সকলের। অনিঃশেষ পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কত প্রাণ খসে যায়, জুটেও যায় কত নতুন হাত। দেখা যায় দেশের প্রায় কোনও অংশই বাকি নেই জম্বি-মহামারী থেকে। প্লট বলতে নিরাপদ জায়গার খোঁজে স্থান থেকে স্থানান্তরে ছুটে বেড়ানো। তারই মধ্যে পরিচালক বুনে দিয়েছেন অগাধ জীবনের আখ্যান। গ্লেন, ডেল, ডারিল, শেন, আন্দ্রেয়া, ক্যারল, সোফিয়া, হার্সেল, ম্যাগি, গভর্নর (ফিলিপ) বা মিহোনের মতো একেকটা চরিত্রকে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা চরিত্র একইসঙ্গে, কিন্তু নিজের নিজের মতো করে আরও আরও পরিণত হয়ে ওঠে প্রতিদিন - সে বালক ক্যারল হোক, অথবা বৃদ্ধ ডেল বা হার্সেল। সমান্তরাল পথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে বাইরের ও ভিতরের লড়াই। গল্পের পরতে পরতে মানব-মনস্তত্ত্বের নিপুণ ব্যবচ্ছেদ লক্ষ করি আমরা। ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ দেখায়, স্থির সত্য বলে কিছুই নেই এ দুনিয়ায়। দেখায়, এক মুহূর্তের মুখ পরের মুহূর্তে সত্যি নয়। চরম সংকটের মুহূর্তে একেবারে ডিগবাজি খেয়ে যেতে পারে বন্ধুতা বা শত্রুতার সমীকরণ। দেওয়ালে পিঠ থেকে গেলেই তো বেরিয়ে আসে মানুষের আসল মুখ। এ আসলে খাদের মুখে দাঁড়ানো সভ্যতার মুখোশ খসে পড়ার গল্প। নিজেকে হারিয়ে ফেলা এবং পুনরুদ্ধারের গল্প। অবশ্য অজস্র কুটিলতা, স্বার্থের দাঁত-নখ পেরিয়ে অবিনাশী মানবতাই মাথা তুলে দাঁড়ায় বারবার। জম্বি-অ্যাপোক্যালিপ্সের গল্পের মধ্যে দিয়ে রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে প্রাণপণে প্রস্ফুটিত সকাল ছিনিয়ে আনার গল্পই বলতে চান সিরিজকার। এই কারণেই বোধহয় ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা আর অভিনন্দন পেয়েছে। মস্তিষ্কহীন উত্তেজনাসর্বস্ব হরর থ্রিলার বানাতে চাইলে সেটা হত না। উইকিপিডিয়া খুললেই দেখা যাবে যে এই সিরিজের পাওয়া পুরস্কারের তালিকা কাহিনির নায়ক রিক গ্রিমসের চেয়ে কম লম্বা হবে না। লম্বা সিরিজে প্রায় প্রতিটি মুখ্য চরিত্রই বহুস্তরযুক্ত। বেশিরভাগ অভিনেতাই নিজের চরিত্রে যথাযথ। আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে রিক (অ্যান্ড্রু লিঙ্কন), শেন (জন বার্নথাল) বা লরি(সারা ওয়েন কলিস)-র অসামান্য অভিনয়ের কথা। রন স্কিমিড ও  ড্যানি বয়েডের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এই সিরিজের প্রাণ। আরেক প্রাপ্তি গ্রেগ নিকোটেরোর দুর্দান্ত মেক-আপ। ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ পরবর্তী সমস্ত জম্বি-বিষয়ক ফিল্ম বা সিরিজে কমবেশি এই স্টাইলই অনুসরণ করা হয়েছে। 

 এই সিরিজের দশটি সিজন আপাতত মুক্তি পেয়েছে। নেটফ্লিক্সে সেগুলি দেখা যাচ্ছে। এগারো নম্বর সিজনে গিয়ে সিরিজে ইতি টানা হবে, এমনই জানিয়েছেন নির্মাতারা। এই শেষ সিজনে থাকবে মোট ২৪ টা এপিসোড, যাদের দুভাগে ভাগ করে যথাক্রমে ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রকাশ করা হবে। শেষ সিজন নিয়ে চর্চা বা উত্তেজনা তো রয়েইছে। তবে কাহিনিকে বেশি টানা হচ্ছে, এমন অভিযোগও অনুরাগীদের থেকে ইতিউতি পাওয়া গেছে। প্রবল জনপ্রিয় এই মহা-সিরিজের জন্য সেই মাপের উপসংহার প্রয়োজন। তবেই কালজয়ী সৃষ্টির তালিকায় জায়গা করে নেবে ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’। প্রজেক্টটা ডারাবন্টের মতো কুশলী পরিচালকের হাতে, এটাই ভরসার কথা।

#The Walking Dead #TV series #post-apocalyptic # horror television series # Robert Kirkman #Zombie apocalypse # Andrew Lincoln # Norman Reedus #Steven Yeun #Frank Darabont #টিভি সিরিজ #জম্বি #সিলি পয়েন্ট #মৃণালিনী ঘোষাল #Silly পয়েন্ট #AMC #Netflix

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

0

Unique Visitors

183120