এক অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চারের গল্প বলে দ্য ক্রুডস
ছবি: দ্য ক্রুডস মুক্তি: ২০১৩ পরিচালনা: ক্রিস স্যান্ডার্স, কার্ক ডি’মার্কো প্রযোজনা: ড্রিমওয়ার্কস অ্যানিমেশন কণ্ঠ: নিকোলাস কেজ, এম্মা স্টোন, রায়ান রেনল্ডস, ক্যাথরিন কীনার প্রমুখ
‘অন অ্যাডভেঞ্চার’ প্রবন্ধে সলমান রুশদি জয়গান গেয়েছেন মানুষের হার না মানা মনোভাবের। প্রাচীনকালের সিমুর্গ বিষয়ক উপকথা সম্বন্ধে আলোচনা করে তিনি বলেছেন, অভিযানে গন্তব্য শেষ অবধি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়, আসল প্রাপ্তি হয়ে থেকে যায় যাত্রাপথের বিবিধ অভিজ্ঞতাগুলি। সেই সঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দিতে ভোলেন নি অভিযানের ক্ষতিকারক দিকটির কথাও। তাঁর কথায়, বণিক, দেশনায়ক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যখন অভিযানে বেরোন, তার পরিণাম হয় ভয়াবহ, বিধ্বংসী।
দ্য ক্রুডস ছবিতে আমরা পাই এমন এক গুহাবাসী পরিবারকে, পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির চরম প্রতিকূলতা যাদের বাধ্য করেছে কূপমণ্ডুকের জীবন বেছে নিতে। পরিবারের কর্তা গ্রাগ সন্ধে নামার আগেই তড়িঘড়ি গুহায় ঢুকিয়ে দেয় স্ত্রী আগ্গা, ঠাকুমা, দুই মেয়ে ঈপ ও বেবি এবং ছেলে ফাঙ্ককে। সূর্যোদয়ের আগে অবধি ছোট্ট গুহায় কুকুর কুণ্ডলী হয়ে সময় কাটে তাদের। মানব সভ্যতা এখানে রয়েছে একেবারেই প্রাথমিক স্তরে, মানুষ এখনও শিকার ব্যতীত কিছুই শেখে নি। বৈচিত্র্যহীন এই জীবনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করে বড় মেয়ে ঈপ, বাবার অলক্ষ্যে গুহা থেকে রাতে পালিয়ে যায় সে। আকস্মিকভাবে তার সঙ্গে দেখা হয় গাই বলে এক যুবকের, আপন উদ্ভাবনী প্রতিভাবলে যে ইতিমধ্যেই উন্নীত হয়েছে মানবসভ্যতার পরবর্তী স্তরে। গাই আগুন জ্বালাতে জানে, শাঁখে ফু দিয়ে যোগাযোগ করতে পারে, আস্ত একটি শ্লথ ভল্লুককে পোষ মানিয়ে কোমরবন্ধনী হিসেবে ব্যবহার করে সে। গাই হল সেই ব্যতিক্রমী গুহামানবের প্রতীক, যার অনুসন্ধিৎসায় ভর করে ক্রমশ অগ্রসর হয়েছে সভ্যতার চাকা। ঈপকে সে জানায়, টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে খুব শিগগিরই লাভাস্রোতে তলিয়ে যাবে এই এলাকা, প্রাণে বাঁচতে হলে তাদের পাড়ি জমাতে হবে দূর দেশের উদ্দেশে। প্রথমে তার কথা বিশ্বাস না করলেও নিজের চোখে সেই ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করবার পর পরিবার নিয়ে গাইয়ের সঙ্গে যাত্রা করতে বাধ্য হয় গ্রাগ। নতুন পথে চলতে চলতে গ্রাগ বুঝতে পারে, প্রাণিজগতের সঙ্গে সবসময় যুদ্ধ করতে চাইলে সমস্যার সমাধান হয়না, বরং তাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করতে জানলে একসঙ্গে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যায়। প্রথমে গাইয়ের উদ্ভাবনী শক্তি তার মনে ঈর্ষার সৃষ্টি করলেও ক্রমশ তার প্রতিভা বুঝতে পারে গ্রাগ, বদল আনে নিজের ভাবনাতেও। দশাসই বেড়াল চাঙ্কির সঙ্গে লড়াই করবার পরিবর্তে তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে একসঙ্গে গুহার অন্ধকার থেকে কৌশলে বেরিয়ে আসে গ্রাগ, সঙ্গে নিয়ে আসে কুকুর ইঁদুর প্রভৃতি বিপন্ন প্রাণীদের। পারিপার্শ্বিক জীবজগতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন স্থানে এক নতুন সম্ভাবনাময় জীবন আরম্ভ করে তারা। গুহার দমবন্ধ আঁধার নয়, এই জীবনে তাদের সঙ্গী হয় রৌদ্রজ্বল উন্মুক্ত আকাশ। প্রকৃতি ও প্রাণিজগতকে হারিয়ে, হটিয়ে নয়, বরং পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সন্ধিস্থাপনের বার্তা পাই এই ছবির অভিযানে। এখানে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী থাকলেও নেই তাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হাতে যুযুধান মানুষ। ঝকঝকে অ্যানিমেশন, সুন্দর আবহসঙ্গীত ও কণ্ঠশিল্পীদের দুর্দান্ত কাজ এ ছবির সম্পদ। যেখানে সেখানে গান গুঁজে না দেওয়ার ফলে গতি পেয়েছে চিত্রনাট্য। বর্তমান পৃথিবীতে প্রকৃতির প্রতি মানুষের অত্যাচার যখন সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ছবির বক্তব্য অবশ্যই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।