পরিবেশ ও প্রাণচক্র

অবাক জলপান

অনিন্দ্য পাল Aug 5, 2020 at 6:25 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

জল আমাদের জীবন। আমাদের, মানে মানুষদের তো বটেই, তবে শুধু মানুষদের নয় - অনেক মনুষ্যেতর প্রাণীদেরও বাঁচার জন্য জরুরী জল। যেমন, প্রথমেই যে প্রাণীদের কথা বলতে হয়, তারা হল মাছ। মাছ তো জলেই থাকে, তাহলেও তাদের জল পান করতে হয়? এ প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। উত্তর হল, হ্যাঁ। মাছকেও জল পান করতে হয়। বিশেষত, সমুদ্রের বা লোনা জলের মাছদের সারাক্ষণ জল খেয়ে যেতে হয়। আসলে লোনা জলের মাছদের কোশ আর কলার ভিতরের রসের লবণ আর আয়নের ঘনত্বের চেয়ে বাইরের জলের ঘনত্ব বেশি হয়, তাই এদের শরীরের কলাকোশের মধ্যেকার দ্রাবক, প্রধানত জল অভিস্রবণ পদ্ধতিতে সব সময় দেহের বাইরে এসে সমুদ্রের জলে মিশে যেতে চায়। আর সেটা যদি ঘটতে পারে বা ঘটতে থাকে তাহলে তো সমুদ্রের মাছদের খুব কম সময়ের মধ্যেই শুকিয়ে আমসি বা কিসমিস হয়ে যাওয়ার কথা। কী অদ্ভুত না! সমুদ্রের জলে ডুবে থেকেও এদের দেহ জলশূন্য হয়ে শুকিয়ে যেতে পারে, যে কোন সময়। তবে সেটা ঘটতে পারে না, কারণ, সমুদ্রের মাছেরা ক্রমাগত জল খেয়ে এই লবণ আর আয়নের ঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ সামুদ্রিক মাছেদের বেঁচে থাকার জন্য জলপান অত্যন্ত আবশ্যক।

আবার মিঠে জলের মাছদের এই বালাই নেই। এদের দেহের ভিতরের কলারসের ঘনত্ব আবার দেহের বাইরের মিঠে জলের ঘনত্বের চেয়ে বেশি হয়, তাই সমুদ্রের মাছের ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে এখানে। অর্থাৎ, মিঠে জলের মাছদের ক্ষেত্রে, দেহের বাইরের জল অনবরত দেহের মধ্যে প্রবেশ করে এবং দেহের ভিতরের কলারসের ঘনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করে। এই জন্যই এদের আলাদা করে আর জল পান করতে হয় না।

এবার যাদের কথা বলা দরকার, তারা হল দক্ষিণ পশ্চিম আমেরিকার বাসিন্দা ক্যাঙারু ইঁদুর; এদের তিন থেকে পাঁচ বছরের জীবনকালে এরা একেবারেই জল খায় না, আর যখনই জল খায় ঠিক তখনই এরা মারা যায়। এদের কি তবে জল লাগেই না বাঁচতে? না, সেটা নয়। এরা মূলত বীজ বা শস্য খেয়ে বেঁচে থাকে, সেই শস্যের মধ্যে থাকা জলেই এদের চলে যায়।

টিকটিকিরা কি জল খায়? আমাদের বাড়ির টিকটিকিরা দু-এক ফোঁটা জল খায়, কিন্তু মরুভূমির টিকটিকিরা একেবারে জল না খেয়েও বাঁচতে পারে। আসলে এদের ত্বকের সাহায্যে এরা বাতাসের জল শুষে নেয়, আর সেটাই এদের জলের প্রয়োজন মেটায়। আবার অস্ট্রেলিয়ার কোয়ালারা আলাদা করে জল পান করে না, এরা ইউক্যালিপটাস এর পাতা খায়। তার মধ্যে থাকা জল এদের শরীরে জলের যোগান দেয়। তবে শুধু তাই নয়, এই কোয়ালারা সারা দিনে প্রায় আঠারো ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটায়, তাই এদের শরীরে জলের প্রয়োজনও কম।

পাখিরা জল খায়। এ আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু পাখিদের জল খাওয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার অনেকেই লক্ষ্য করি না। পাখিরা জল পান করার সময় ঠোঁটটা ডুবিয়ে তুলে নিয়ে মাথাটা উঁচু করে একটু পিছনের দিকে হেলিয়ে ঠোঁটে থাকা জলটুকু খেতে পারে। আসলে এরা একেবারে ঠোঁট ডুবিয়ে ঢকঢক করে জল খেতে পারে না। কিন্তু প্রকৃতি বৈচিত্রময়। পায়রা আর ঘুঘু কিন্তু অন্য সব পাখিদের মত ঠোঁট উঁচু করে জল খায় না, ঠোঁট ডুবিয়ে ঢকঢক করেই জল খেতে পারে। আবার হামিং বার্ড জল খায়ই না। আসলে হামিং বার্ড সরাসরি ফুলের মধু খায়, আর সেই মধুর মধ্যে থাকা জল তাদের শরীরের জলের চাহিদা পূরণ করে।

সমুদ্র-ভোঁদড় আবার সমুদ্রের নোনা জল খেয়েই বেঁচে থাকে। বালিহাঁস বা স্যান্ড গাউসরা মরুভূমির ছোট খাটো গর্তে জমা জল খেয়ে বেঁচে থাকে কিন্তু সমস্যা হয় এদের বাচ্চাদের। বাচ্চাগুলো জল পান করার জন্য উড়ে গর্তের কাছে যেতে পারে না, তাই তাদের বাবা হাঁস জল পান করার সময় নিজেরা বুকের পালকগুলো জলে ভিজিয়ে নেয়, আর সেই ভেজা পালক চুষে জল খায় বাচ্চা হাঁসেরা।

সাপ কি জল পান করে ? হ্যাঁ করে। এদের নিচের চোয়ালের ত্বক সাধারণ অবস্থায় গুটিয়ে থাকে। বড় শিকারকে গিলে খাবার সময় এই ত্বকটা প্রসারিত হয় আর শিকারটাকে গিলে ফেলতে সাহায্য করে। আবার এই গোটানো ত্বকটাই সাপের জল পান করার সময় কাজে লাগে। সাপ জল পান করার জন্য জলের মধ্যে মাথাটা যখন ডোবায়, তখন ওই গোটানো ত্বকটাই স্পঞ্জের মত জল শুষে নেয়। এই ত্বকের মধ্যে থাকে তোয়ালের সুতোর মত খুব সরু কিন্তু ফাঁপা অংশ যারা জলটাকে টেনে ভিতরে নিতে সাহায্য করে। এই ভাবে ভিতরে যাওয়া জলটাকে পেশির চাপে শরীরের ভিতরে ঢুকিয়ে নেয় সাপ। আবার নামিবিয়ার মরু বিট্ল, মরুভূমির ভোরে যখন শিশির পড়ে তখন তাদের পিছনটা উঁচু করে সেই শিশিরের ফোঁটাগুলো ধরে এবং একটা ফানেল আকারের দেহাকৃতি বানিয়ে সেই কয়েক ফোঁটা জল নিয়ে আসে মুখে; এভাবেই চলে এদের জল পান।

শেষ করা যাক লেডিবাগ বা লেডিবিট্‌লদের দিয়ে। এরা গাছের রস খেয়ে বেঁচে থাকা একধরনের পতঙ্গদের শরীর থেকে সমস্ত রস শুষে নেয়। এটাই ওই লেডিবাগদের শরীরের জলের চাহিদা পূরণ করে।

সত্যিই অবাক করে প্রকৃতির এইসব ব্যাপার-স্যাপার।

#পরিবেশ #জল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

31

Unique Visitors

184870