গল্প

সুকুমারের শখ

সায়নদীপ গুপ্ত May 16, 2021 at 10:50 am গল্প

“কী মিঃ সাহা? কেমন বোধ করছেন?”
প্রশ্নটা মনে হল যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল। ঘোলাটে দৃষ্টিটা একটু পরিষ্কার হতে সুকুমারবাবু দেখলেন মুখের সামনে একটা ফ্লুরোসেন্ট সবুজ রঙের ব্যাং। সভয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নিলেন।

“বাঃ বাঃ, আপনার ভাইটালগুলো তো সব পারফেক্ট দেখছি। এবার কয়েকটা রুটিন টেস্ট একটু করে নিতে হবে যে।” 

অনেকটা ধাতস্থ হয়ে এবার চোখ খুললেন সুকুমার। ব্যাংটা আসলে ব্যাং নয়, মানুষ। আরও ভালোভাবে বললে, সবুজ পোশাক আর ব্যাঙের মতো মুখোশ পরা একটা মানুষ। একজন নয়, বেশ কয়েকজন। সবাই চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে একটা উজ্জ্বল ঘরের মধ্যে। মাথার ধরা ধরা ভাবটা এবার আস্তে আস্তে ছাড়ছে, হাতেপায়ে সাড়ের সঙ্গে সঙ্গে মনে একটু সাহসও ফিরে আসছে যেন। গলাখাঁকারি দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আজ্ঞে আমি বেঁচে আছি তো?” 

“আলবাত আছেন! সবাইকে টপকে এক নম্বরে আছেন, হাহাহাহাহা!”

“এক নম্বরে? ঠিক বুঝলাম না...”  

“এই বছর যাদের ক্রায়োস্লিপ শেষ হওয়ার কথা, তাদের মধ্যে আপনিই প্রথম। কংগ্রাচুলেশনস!” 

ব্যাপারটায় গর্বের কী আছে, ঠিক বুঝলেন না সুকুমার। তবে সেটার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 

“আমি... মানে এটা কোন সাল বলতে পারেন?” 

“যেরকম কথা ছিল মিঃ সাহা, ২১২১। নিয়মে নড়চড় হওয়ার জো নেই।” 

আশ্বস্ত হলেন সুকুমার। হিসেব অনুযায়ী ঠিক একশো বছর পরেই তাঁর ওঠার কথা বটে। সেইমতো একটা চুক্তিপত্রেও সই করতে হয়েছিল, একশো বছর পরে জেগে উঠলে তাঁর উপর বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হবে। তাই চারপাশের লোকগুলো যখন তাঁর গায়ে নানারকম টিউব আর সুচ ফোটাতে ব্যস্ত, তিনি খুব একটা আপত্তি জানালেন না। চুক্তিতে এমনটা ছিল, আরও অনেক কিছুই ছিল। মনে পড়তেই স্লিপিং ক্যাপসুলের মধ্যে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। 

“ইয়ে, একটা আয়না হবে নাকি?”

“আয়না?” সামনে দাঁড়ানো ব্যাং, থুড়ি মানুষটা বেশ অবাক হল। 

“হ্যাঁ, এই নিজেকে একটু দেখতাম ভাই। একশো বছর ধরে তো কিছুই দেখলাম না।”  

মাথা নেড়ে চলে গেল ব্যাংটা। আয়না কি দেবে না এরা? চুক্তিতে স্পষ্ট বলা ছিল, ঘুমিয়ে থাকাকালীন তাঁর বয়স এতটুকুও বাড়বে না। নিজের চোখে সেটা না দেখা অবধি স্বস্তি হচ্ছে না। আচ্ছা, একশো বছর ঘুমোনোর পর আর কি ঘুম আসতে পারে? নাকি খিদে-তেষ্টার মতো ঘুমটাও একটা নির্দিষ্ট চক্র ধরে আসবেই? কথাগুলো ভাবতে গিয়েই সুকুমারবাবু টের পেলেন, পেটের ভিতর একটা হালকা খাই-খাই ভাব ঘাই মেরে যাচ্ছে। 

দুটো লোক ফিরে এসে তাঁর হাত থেকে সব নল পটাপট খুলে নিতে থাকল। তারপর কফ তোলার মতো শব্দ করে স্লিপিং ক্যাপসুলের উপরে আধখোলা ঢাকনাটা পুরোটা খুলে গেল। ক্যাপসুলটার মধ্যে নড়াচড়ার জায়গা থাকলেও ভিতরটা কেমন যেন পিছল, কিছুতেই উঠে বসে থাকা যায় না। তাই এতক্ষণ ইচ্ছে থাকলেও বাইরেটা ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। এবার চারপাশটা দেখে সুকুমার অপারেশন থিয়েটারের থেকে খুব একটা তফাত বুঝলেন না। লোকগুলো অবশ্য এদিকে নজরও দিল না, যে যার মতো কাজ করে যাচ্ছে। ঘটাং ঘটাং শব্দ করে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে ক্যাপসুলটা একটু নিচের দিকে কাত হল, সুকুমার দিব্যি বুঝলেন এবার বেরোতে হবে। 

“আসুন মিঃ সাহা। আমার হাতটা ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসুন দেখি” – প্রথমের সেই মানুষটা এসে দাঁড়াল সামনে। “বেরিয়ে এই নার্সের সঙ্গে সোজা চলে যান আপনার ঘরে। বাথরুমে আয়না পাবেন, আপনার পোশাকও রাখা আছে। খাওয়াদাওয়া সেরে বিশ্রাম নিন, তারপর আমাদের প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।”

(২)

স্নান-টান সেরে যখন ঘরের মাঝের সোফায় এসে বসলেন সুকুমারবাবু, ততক্ষণে তাঁর খিদে ও মেজাজ দুই-ই সপ্তমে চড়ে গেছে। একশো বছর পরে দুনিয়া অনেকটাই পাল্টাবে, এটুকু তিনি এমনিও বুঝেছিলেন। তাই বলে জলের বদলে বাষ্প দিয়ে স্নান করতে হবে এটা তাঁর হিসেবে ছিল না! সঙ্গে থাকা লোকটা অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে বাষ্প দিয়ে স্নান করলে নাকি বেশি পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যায়, এখন নাকি সাবান কেউ ব্যবহারই করে না, কিন্তু তাতে তাঁর মেজাজের বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। গায়ে জল না পড়লে স্নান করে আদৌ আরাম নেই, এই সারসত্যটা যে কোনও মাথামোটাকে বোঝানো যাবে না সে কথা সুকুমার দিব্যি জানেন। তাঁর মেসের অনাদি ছিল ঠিক এইরকম, স্নান করতে মনে হয় হিসি করার থেকেও কম সময় নিত। ঠাট্টা করলে, গলাটাকে অনাবশ্যক গম্ভীর করে বলত, “সময়ের দাম আছে ভায়া, তোমরা অবিশ্যি বুঝবে না। জলের নিচে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথায় শ্যাওলা পড়ে যায় কি না” – শুনলেই গায়ে জ্বালা ধরে যেত! সুকুমারের বরাবর একটু আয়েশ করে স্নান করা অভ্যেস, শীতগ্রীষ্ম যাই হোক। বেশ খানিকটা সময় ধরে বগলে সাবান না কচলালে, একমগ জল আলগা করে ঢেলে সেই রেশটুকু সারা গায়ে জড়িয়ে নিতে না পারলে যে অফিসে ফাইল দেখতে বাজেরকম একটা ভুল হবেই, এটা তিনি বহুবার প্রত্যক্ষ করেছেন। একশো বছর পরের জীবনের শুরুটা এভাবে হোক, এমনটা তাঁর মোটেই ইচ্ছে ছিল না। সুকুমার মনে মনে ঠিক করলেন, এখানকার কাস্টমার কেয়ারটা খুঁজে বের করে গুছিয়ে একটা নালিশ ঠুকে যাবেন।

চিন্তায় ছেদ পড়ল দরজা খোলার আওয়াজে। একটি মেয়ে ঢুকে তাঁর সামনে একটা প্লেট আর একটা জলের গ্লাস নামিয়ে একমুখ হেসে তাকাল। প্লেটের উপর হলুদ আর কমলা রঙের বেশ বড় বড় চারটে লজেন্স। মাথাটা আরও গরম হয়ে গেল। 

“এটা কি লজেন্স খাওয়ার সময়?” 

মুখে যত দাঁত আছে প্রায় সবটুকু বের করে হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। সুকুমারের একগাল মাছি! একদৃষ্টে লজেন্সগুলোর দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। একশো বছর আগে ঘুমোতে যাওয়ার সময় অন্য ভাবনার থেকে ভয়টাই ছিল বেশি; আর ঘুম না ভাঙার ভয়, কিছুই চিনতে না পারার ভয়, বুড়িয়ে যাওয়ার ভয়। বাথরুমে থাকা আয়নাটার সৌজন্যে শেষের ভয়টা আর নেই, যেমন বাহান্নতে ঘুমোতে গেছিলেন তেমনই আছেন। দু-চার বছর এদিক-ওদিক হয়ে থাকলেও বোঝার জো নেই। কিন্তু এখন টের পাচ্ছেন, কোনও কিছুই তিনি চিনে উঠতে পারছেন না। 

দরজাটা আবার খুলল। এবার যে ভদ্রলোক ঢুকলেন, তাঁর মুখে মুচকি হাসি, অনেকটা স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাজিশিয়ানের মতো। ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোনও অসুবিধা হচ্ছে না নিশ্চয়ই, মিঃ সাহা?” 

প্রশ্নের ধরন দেখে গা চিড়বিড় করে উঠল সুকুমারের। “এক্কেরে না! চান করতে গিয়ে জলের বদলে হাওয়া পাচ্ছি, খিদে পেয়েছে বললে খাবারের বদলে লজেন্স পাচ্ছি। অসুবিধা আর কোথায়!”

“আপনি এগুলো খাননি এখনও?”

“একশো বছর আগে শেষবার খেয়েছে যে মানুষটা, তাকে কি আপনারা প্রথমে লজেন্স খেতে দেন?” 

“লজেন্স নয় মিঃ সাহা। এগুলোই খাবার। দেরি না করে খেয়ে ফেলুন, পেট খালি থাকলে কোনও কাজ করা যায় না।”

হাঁ করে চেয়ে রইলেন সুকুমার। লোকটা এখনও মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, দেখে আদৌ মনে হচ্ছে না ইয়ার্কি মারছে বলে, অথচ কথাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেও নেওয়া যাচ্ছে না। উপায়ন্তর না দেখে একটা হলুদ লজেন্স তুলে মুখে পুরে দিলেন। প্রথম কামড়ে খুব একটা কিছু বোঝা না গেলেও দ্বিতীয় কামড়েই কোনও একটা তরকারির স্বাদ তাঁর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ চিবোতে ভুলে গেলেন সুকুমার। সামনে বসা ম্যাজিশিয়ানটা একটু ঝুঁকে এল।

“কেমন বুঝছেন? ভালো না?” 

“ইয়ে, তরকারির মতো, কিন্তু ঠিক কী...”

“সেইটা বোঝা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভ্যারাইটি হয়, আপনি ভারতীয় বলে একটা বেসিক তরকারি ফ্লেভার দিয়েছে। এতে প্রয়োজনীয় সমস্ত পুষ্টিগুণ আছে। ইন ফ্যাক্ট, তিনটে খেলেই আপনার পেট ভরে যাওয়ার কথা।”

“কিন্তু আমি তো...”

“কিছুই বুঝছেন না। স্বাভাবিক। আচ্ছা মিঃ সাহা, যখন এই প্রোজেক্টে আপনি ভলান্টিয়ার হয়ে এলেন, তখন আপনার শহরে কী অবস্থা?”

“খুবই খারাপ। মহামারির জন্য বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ, লোকজন খেতে পাচ্চে না, চাকরি থাকচে না। সাধে কি রাজি হলুম! ওই নরকে থাকার চেয়ে ঘুমিয়ে থাকাই ভালো মনে হয়েছিল।”

“কারেক্ট! বুঝতেই পারছেন, শুধুমাত্র ভালো খাওয়ার লোভে, বারবার বাজার যাওয়ার তাগিদে একটা শহর কীভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছিল? আপনার ঘুমোনোর কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হয় অতিবৃষ্টি আর অনাবৃষ্টির হামলা; পৃথিবী জুড়ে ফসলের আকাল। এখন তার সমাধান আপনার প্লেটে।” 

লোকটার কথা শুনতে শুনতে সুকুমার খেয়াল করলেন তাঁর পেট সত্যিই ভরে গেছে। মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলেন তিনি, এতটা বদল একেবারেই আশা করেননি। মুখটা হঠাৎ বিস্বাদ ঠেকল। বুঝতে পারছেন মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, তবু সাংঘাতিক অস্বস্তি হচ্ছে। 

ম্যাজিশিয়ান সোজা হয়ে বসল। এতক্ষণ একটা লোক কীভাবে ঝুঁকে থাকতে পারে সেটাই আশ্চর্যের। পকেট থেকে একটা লম্বাটে মোবাইল বের করে টেপাটেপি শুরু করল লোকটা। 

“আপনার খাওয়া হয়ে গেলে আমরা প্রোজেক্টের পরের ধাপে যাব মিঃ সাহা। চুক্তি অনুযায়ী আপনাকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাব, একশো বছর আগের আপনি আজকের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন সেটা দেখার জন্য। পুরো সময়টা আপনার সঙ্গে তিনজনের একটা মেডিক্যাল টিম থাকবে, ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং চলবে। আপাতত কমলার সঙ্গে আপনি চলে আসুন নিচে। আপনার প্রস্তুতির কাজটুকু অন্য জায়গায়।” 

দরজা খুলে আবার একমুখ হাসি ভিতরে ঢুকল। মুচকি হাসি উঠে দাঁড়াল। সুকুমারবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, “মেজোমামার অপারেশনের সময় দেখছিলুম হসপিটাল ভর্তি সাউথ ইন্ডিয়ান নার্স। আপনারাও তাই রেখেচেন দেখচি। কথা বললে বোঝে না।” 

দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। “কমলা নার্স নয় মিঃ সাহা। অটোমেটেড হাউস হেল্প। ফুললি রোবোটিক, বেসিক কম্যান্ড ছাড়া কিছু বোঝে না, কথা বলে না। কাজের লোকের সঙ্গে তো কথা বলার দরকারও নেই, তাই না?” 

(৩)

মেসবাড়ির গলির সামনেটায় এসে সুকুমার একটু হকচকিয়ে গেলেন। গলির মুখ অবধি দিব্যি চিনে চলে আসতে পেরেছেন, এরপর সোজা ঢুকে ডাইনে গিয়ে বাঁদিকের তিন নম্বর বাড়িটাই ওঁর থাকার জায়গা। থাকার জায়গা ছিল। কিন্তু সমস্যা হল গলির মুখ থেকে ভিতরের দিকের নকশা একটুও চেনা ঠেকছে না। 

মেডিক্যাল টিমের সেতুপতি পাশে এসে দাঁড়াল। এই কদিনে তিন ছোকরাকেই ভালো চিনে গেছেন তিনি। সবকটিই ভদ্র, তবে কারও সঙ্গে কথা বলে আরাম নেই। কাজের বাইরে এদের কথাবার্তা সীমিত। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার পর সুকুমার সন্দেহ করেছিলেন, এগুলোও রোবট; সে ভুল পরে ভেঙেছে। তাও এদের মধ্যে সেতুপতি নিজে থেকে কথা বলে, বাকিদের সে বালাই নেই।

“ভিতরে যাবেন না স্যার?”

“ভিতরটা চেনা ঠেকছে না হে।”

“একশো বছরে সবই কি এক থাকবে স্যার? গলিটা চিনতে পারছেন তো?”

“গলির মুখে একটা পেঁয়াজির দোকান ছিল। সকালে চা বিক্রি করত, বিকেল গড়ালেই পেঁয়াজি। আহা! কালুর পেঁয়াজি যারা খেয়েছে, তারা অন্য কোনও দোকানের পেঁয়াজি আর মুখে তুলতে চাইবে না। বুঝলে?”

“বুঝলাম স্যার।”

“ছাই বুঝলে! তুমি তো জন্মেও পেঁয়াজি খাওনি। খালি ক্যাপসুল খেয়েচ!” 

“আমরা তামিল স্যার। আমাদের বাড়িতে পেঁয়াজ ঢোকে না।”

“দ্যাখো বাপু, ন্যাকামো করো না। তুমি কোনোদিন ইডলি ধোসা খেয়েচ?” 

“না স্যার। তবে গ্রেনিজের ক্যাপসুলগুলো ওই চালবাটা ফ্লেভারের হত। সব ভিগান।” 

“অসহ্য! কোথায় ধোসা, কোথায় চালবাটা। নাহ্‌, আমি ফিরে যাব।”

“তাই ভালো। এমনিতেও স্যার, আমাদের প্রোটোকলে বলে ক্রায়োস্লিপের পর নিজের অতীতের জায়গা এড়িয়ে চলা উচিত।” 

“উফফ্‌, লাস্ট তিন হপ্তা ধরে সেই এক প্রোটোকল কপচে যাচ্ছে! ওই পিছনের বাজারটা ঘুরে যাব একবার।” 

“বাজার? বাজার তো নেই স্যার।” 

“নেই মানে? আলবাত আছে! আমি নিজে ওখানে বাজার করতুম।”

“কী যে বলেন স্যার! সবজি নেই, মাছ নেই, বাজার থাকবে কেন? মাল্টি নিউট্রিয়েন্ট পিল এসে ফুড কনসেপ্টটাই একেবারে রেভলিউশনাইজ করে দিয়েছে, বুঝলেন না!” 

সুকুমারবাবুর পা থেকে মাথা অবধি চিড়িক করে একটা বিদ্যুৎরেখা ছুটে গেল। 

“কোথাও কোনও খাবার বানানো হয় না?”

“কোথাও না।”

“পৃথিবী জুড়ে কোথাও লুচি নেই? পাঁঠার মাংস নেই?”

“রিসার্চ চলছে এক-একটা টিপিক্যাল স্বাদকে এক-একটা ক্যাপসুলে আনা যায় কি না। আপনি তো জানেন স্যার, তরকারি এসেছে, কিন্তু কুমড়ো না কচু আলাদা করা যাচ্ছে না। তবে মানুষ মোটামুটি এতেই অভ্যস্ত। ও কী! কী হল স্যার, শরীর খারাপ লাগছে? হেই টিম! ভাইটালিটি মনিটর হিয়ার, ক্যুইক!”

(৪) 

একদিকের দেওয়ালজোড়া বিশাল জানলা দিয়ে বিকেলশেষের কমলা আলোটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকছে। শুধু আলো। কোনও শব্দের এই ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। থাকলেও কি পাখির ডাক শোনা যেত? কিংবা খানকতক অটোর কর্কশ হর্ন? জানা নেই। বাইশতলা থেকে নিচে তাকালে গাড়িঘোড়া বিশেষ দেখা যায় না, এই রাস্তায় খুব একটা গাড়ি চলেও না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের তো প্রশ্নই নেই। 

শহর থেকে অনেকটা দূরে এই জায়গাটা, একশো বছর আগে এখানে চাষের খেত ছাড়া কিছুই ছিল না। এখন মাঝে মাঝে আখাম্বা দু-তিনটে ঝাঁ চকচকে টাওয়ার আর অনেকগুলো লঞ্চপ্যাড আছে। এত উঁচু থেকে তাকালে হলুদ ধুলো ওড়ানো পথের উপর লঞ্চপ্যাডের কালো কালো হ্যাঙ্গারগুলো এত ছোট দেখায়, যেন পাঁপড়ের গায়ে সেঁটে থাকা কালোজিরে। একদলা মনখারাপ নিয়ে সরে এলেন সুকুমার সাহা। পাঁপড় অবধি পৌঁছোনো গেল না, তার আগেই সবাই জেনে গেল। জানলার কাচে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে সেকেন্ডের টাইমারটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে। আর ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই তাঁর ডাক পড়বে সতেরোতলায়। সেখানে যে কোনও কিছুই সুবিধার হবে না, সেকথা তিনি জানেন। তবু, ভয়ের থেকে মনখারাপটাই ফিরে ফিরে আসছে বেশি। আসার আগে ওরা বাগানটা একবার ঘুরে দেখতে দিল না। এতক্ষণে মনে হয় সেটা আর নেই। 

দরজা খুলে কমলা ঢুকল। এখন হয়তো এদের অন্য নাম দেয়, আপগ্রেডেশন তো কম হল না। তাও ওই একমুখ হাসি দেখলে এই নামটাই মনে পড়ে তাঁর। 

কমলার হাত ধরে ধীর পায়ে যখন তিনি ডিম্বাকৃতি ঘরটায় ঢুকলেন, তখন বাইরে নিকষ কালোর চাদর নেমেছে। সামনের টেবিলে চারজোড়া ভ্রূকুটি তাঁর অপেক্ষায়। 

“মিঃ সাহা, আপনার নিশ্চয়ই ধারণা আছে আপনি কী কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন?”

“আজ্ঞে।”

“কেন মিঃ সাহা? কেন?”

“এটা তো খারাপ কিছু নয়।”

“খারাপ নয়? গোটা দুনিয়া একটা নিয়মে চলছে, আপনি সেই নিয়ম মানবেন না? আপনি জানেন, সমস্ত মাল্টি নিউট্রিয়েন্ট পিলের ব্যবসা আপনার এই শখের চক্করে লাটে উঠতে পারে?” 

“মন্দ নয়।”

“ডোন্ট বি সো ক্যাজুয়াল, মিঃ সাহা। আপনার দুনিয়া আর এই দুনিয়ায় অনেক ফারাক। আপনার এই উদ্ভট শখ আইনত প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল, সে খেয়াল রাখেন?” 

“সে আর বুঝি না?” 

“সব জেনেশুনেও করেছেন!”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, সব জেনেশুনেই আমি এ কাজ করেচি। নিজের বাগানে সবজি ফলালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয় আমার জানা নেই মশাই।” 

“পৃথিবীতে এত শখ আহ্লাদ থাকতে ...”

“থামুন!” টেবিলের উপর সশব্দে চাপড় মারলেন সুকুমার। যেটুকু মেঘ ছিল তাঁর মনে, সেটুকুও কেটে গেছে।

“আমার শখ আহ্লাদের খোঁজ নিয়েছিলেন ঘুম পাড়ানোর আগে? ব্যাচেলর মানুষ, মেসবাড়িতে একা থাকতাম। সঙ্গী বলতে বাকি বোর্ডার, শখ বলতে একটু ভালো খাওয়াদাওয়া। আর নেশা বলতে একটিই – হপ্তায় দুদিন করে মেসের পিছনে গলসিপাড়ার বাজার। মেসের ঠাকুরটাও ছিল ফাস্‌ক্লাস! ও ব্যাটা যেদিন নারকেল দিয়ে কচুর লতি বানাত, আমার ঠাকুমার রান্না মনে পড়ে যেত। মড়ক লেগে যখন মাসের পর মাস বাজার যাওয়া লাটে উঠেচে, তখন হা-পিত্যেশ করে বসে থেকেচি হপ্তার ওই একটা দিনের জন্য, যেদিন বাজার করতে পারব! শেষটায় মাস গড়িয়ে বছর হল, বাজার যাওয়াও বন্ধ হল। চেনা সবজিওয়ালা, মাছওয়ালারা সব যে যার বাড়ি বসে গেল। একশো বছর পেরিয়ে সেই লোকগুলো থাকবে না জানতাম, বাজারটাও যে থাকবে না সে কী আগে বলেছিলেন? ব্যাগ দুলিয়ে সজনে ডাঁটা কিনতে পারব না, সে কথা জানিয়েছিলেন?” 

“আঃ! আপনি বুঝছেন না মিঃ সাহা, বাজার একটা লাক্সারি। তা ছাড়া যেখানে একটি পিলেই ক্ষুধানিবৃত্তি ...” 

“আর আপনারাও বুঝছেন না যে মানুষের শখ-আহ্লাদ একটা নেসেসিটি। বাজারে ঢুকে নধর মোচার গায়ে হাত বোলাতে, পুঁইশাকের সঙ্গে কুমড়ো নেব কি না ভাবতে, কালোজিরে দিয়ে পার্শের ঝোল নাকি ট্যাংরার ঝাল– এই ডিলেমায় হাবুডুবু খেতে যে তৃপ্তি, তাকে আপনারা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দিয়ে রিপ্লেস করবেন ভেবেচেন? কম দেখলাম না মশাই এই সাতাশ বছরে, চোখে গাবদা চশমা এঁটে বাজার করার ফিল নিতে হবে! ফিল? বেগুনের গায়ে হাত দিলেও যা ফিল হচ্চে, ঢ্যাঁড়সের গায়ে হাত দিলেও তাই ফিল হচ্চে। হবে না কেন? যারা এসব বানিয়েচে, তারা বাপের জন্মে কোনোদিন বাজার গেছে? তাই আমি নিজের বাগানে সবজি চাষ করেছি, নিজে খাব বলে। বেশ করেছি!” 

“সুকুমারবাবু?” 

“বলুন।” 

“একশো সাতাশ বছর আগে আপনাকে বেছে নেওয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। তার একটা হল, আপনি একজন অতি সাধারণ মেধার মানুষ। সেই আপনি সাতাশ বছর ধরে অনুর্বর মাটিতে কীভাবে চাষ করে গেলেন বলুন তো?” 

“শুরু থেকে আর পারলাম কই? মাটির জাত, সারের ধরন এসব বুঝতে বুঝতেই কতগুলো বছর চলে গেল। আর তেমন বারোটা বাজিয়ে রেখেচেন গ্রহটার! চেনা গাছগাছালিগুলোর তো ঠিকুজি পাল্টে গেছে! না হলে এত চেষ্টা করে শেষটায় লাল বাঁধাকপি হয়? সায়েন্সটাও বুঝতাম না, চাষ-আবাদও জানি না; জানলে হয়তো বাঁধাকপিতে লালশাকের হালকা স্বাদ আসাটা আটকাতে পারতুম, কচি মুলো খেলেও গলা চুলকাত না!” 

“আপনি আমাদের অবাক করেছেন। কিন্তু সুকুমারবাবু, এই কমিটি অফিশিয়াল রিপোর্ট দিলে আপনার শাস্তি হবেই। বাজার অর্থনীতির কাছে আপনি এক নম্বর শত্রু।” 

“এখানেও এক নম্বর! তা আমায় মেরে ফেলবেন নাকি?”

“মৃত্যুদণ্ড এই সময়ে নিষিদ্ধ সুকুমারবাবু। আপনাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হবে। তার সময়সীমা নির্ধারণ করবে বিচারবিভাগ। কিন্তু এই বয়সে ক্রায়োস্লিপে গেলে আপনার জেগে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ।” 

“না উঠলেই বা ক্ষতি কী?”

“ক্ষতি নেই?”

“নেই তো। রবিবারের জলখাবারে লুচি-ছোলার ডাল নেই, অফিস থেকে ফিরে রানি রাসমণির সঙ্গে কালুর পেঁয়াজি নেই, মুসুর ডালের পাশে আলুচোখা নেই, সরষের তেলে তেজপাতা ফোড়ন নেই, এমনকি আরসালানের বিরিয়ানিও নেই। এতগুলো ‘নেই’-এর পাশে কোথাকার সুকুমার সাহার না থাকা কী এমন মানে রাখে বলুন তো? যদি বেঁচেও যাই, সেইদিন জাগাবেন যেদিন আবার মানুষ ক্যাপসুলের বদলে কাটোয়ার ডাঁটা খেতে শিখবে। আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিন মশাই!”  




[অলংকরণ: অভীক]  


#বাংলা #গল্প #সায়নদীপ গুপ্ত

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219123