উপন্যাস

সোনার বাড়ি জমি (প্রথম পর্ব)

সরোজ দরবার Aug 5, 2021 at 6:47 pm উপন্যাস

ধারাবাহিক উপন্যাস

প্রথম পর্ব 

...............

[এক]

এই কাহিনিটা এক জাদুকর বুড়োর। কিংবা যুবক-যুবতির। অথবা দুটো ফুলের। ব্যাপারটা নিয়ে আমি নিজেই বেশ সন্দিহান।

অবশ্য যদি একে কাহিনি বলা যায়, তবেই এত কথা উঠবে। শেষ পর্যন্ত এটা একটা কাহিনি হয়ে উঠবে কি না তা এখুনি বলা যায় না। অন্তত বলা উচিত নয়। হ্যাঁ, আগামী বেশ কিছুক্ষণ আমি জড়িয়ে-মড়িয়ে কিছু-একটা বলব এবং বলতেই থাকব বলে, সেইটেই যে একটা কাহিনি এমন একতরফা সিদ্ধান্ত এই এখনই, গোড়াতেই টেনে ফেলা ঘোর অনৈতিক কাজ, অন্তত আমার মতে। সুধীবৃন্দ, আমি জ্যোতিষী তো নই। এমনকি আজকালকার পিআর ম্যানেজার বা ভোটকুশলীও নই যে, অঙ্ক কষে প্রায় অভ্রান্ত সবকিছু বলে দেব। শুনেছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জোরে লাখো লাখো তথ্য ঝেড়েঝুড়ে, নেড়েচেড়ে নাকি মানুষের মনের হালহদিশ সব ঠিক বলে দেওয়া যায়। সেইমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায় মনের গতিবিধি। তাতে নির্দিষ্ট পণ্যের বিক্রি বাড়ে, নির্দিষ্ট দলের ভোট বাড়ে। কিন্তু আমি মশাই সে রাস্তায় হাঁটব কেন! একটা কাহিনির হয়ে-ওঠা মানুষের মনে। আর, আমি আজও বিশ্বাস করি, মহাশয়গণ, যে, কাহিনির মন কোনও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বোঝা যায় না। তাকে ছেড়ে দিতে হয়। মনে মনে ঘুরতে দিতে হয়। কতরকম অনুমান, অভিজ্ঞতার জল-হাওয়া খেয়ে খেয়ে সে এক-একরকম কাহিনি হয়ে ওঠে। শুধু আমি নই, আমার মতো যারা কাহিনি বলে বেড়ায়, সত্যি করে, তারা বিশ্বাস করে, কাহিনির কোনও স্থির রূপ নেই; প্রতিদিন কাহিনি বদলে বদলে যায়। কাহিনির জলের স্বভাব। তাকে কোনও ফর্মুলায় ফেলা যায় না। এই যে বাজার বলে জিনিসটা নাকি আমাদের গোপনাঙ্গের উত্থান-পতন অবধি ছুঁয়ে ফেলেছে, কখন তাকে ঢেকে রাখা হবে, কখন কতটা খোলা হাট করে দেওয়া হবে, সে পর্যন্ত যে-বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, সে-ও কাহিনির কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারে না। যেই না কাহিনিকে বাজার ছুঁতে যায়, অমনি সে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে কোন অজানা ঝোপে ঝাড়ে জোনাকির আলো হয়ে জ্বলে, বাজার ব্যাটা তার হদিশই পায় না। বাজার ঝাড়বাতি বিক্রি করে, নাইট ল্যাম্পও তার স্টকে আছে; কিন্তু আপনি কখনও দেখেছেন বাজারে জোনাকির আলো কিংবা জ্যোৎস্না বিক্রি হচ্ছে! এইখানটায় সে বোকা বনে যায়। অবশ্য উপরচালাক তো। তাই কাহিনির নাম করে সে কিছু মরা চিংড়ির শক্ত খোলা তুলে দেয় আপনাদের হাতে। দেখতে সেই গলদা চিংড়িই লাগে, ভিতরটা ফাঁকা। এইসব বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনাদের হাতে। আমি শুধু আমার কথাটি বলে রাখলাম, এই যা। 

তাই বলছি, যা আমি বলব, সেইটেই যে একটা কাহিনি, এমনটা দাবি আমি করছি না। হয়তো যা আমি বলছি না, মানে, বলে উঠতে পারছি না, আমারই অক্ষমতাবশে, সেইসবই হয়তো কাহিনি। তা ছাড়া বললামই তো কাহিনির হয়ে-ওঠা আপনাদের মনে। 

তবু আপাতত একে তো কিছু-একটা নামে ডাকতে হবে, সেই হিসেবে, ডাকনামের মতো করে একে কাহিনিই বলা যাক। এবং, আমি নিশ্চিত, কাহিনি যত এগোবে, কাহিনিটা যে ঠিক কী নিয়ে, সে ব্যাপারে খানিক খানিক এবং সংগত সন্দেহ আপনাদের মনেও জন্মাবে। তা নিয়ে প্রশ্নও করতে পারেন। কিন্তু কথা হল, প্রশ্নটা কাকে করবেন? আমাকে? আমি যে আগেই বললাম, আমি কেউ নই, কাহিনি আপনাদের মনে। সুতরাং, প্রশ্ন নিজেকেই করবেন। তবে কী প্রশ্ন করবেন, সেটা খুব জরুরি। গাছগাছড়ায় রোগ সারে, এ কথা কে না জানে! কিন্তু কোন রোগ কোন গাছে সারে, সেটা না-জানলে সমস্তটাই বৃথা। প্রশ্নের ধরনটাও এরকমই। সব প্রশ্নেরই একটা করে উত্তর আছে। কিন্তু ঠিক কোন প্রশ্নের কোন উত্তরটা মিললে আপনার কাহিনিটা তাৎপর্য পায়, সেটা আপনাকেই বুঝতে হবে, এবং সেইমতো প্রশ্নখানা করতে হবে। আমি একটা ধরতাই দিতে পারি বড়োজোর। যেমন, এ-কাহিনি আদৌ কাহিনি কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলবেন বইকি। আমি বলছি বলেই এ-কাহিনি আপনারা বিশ্বাস করবেন, ধ্রুব বলে এর সবকিছু মেনে নেবেন, এমনটা হবেই বা কেন? আপনাদের চোখ-কান খোলা। আপনাদের দরজা-জানলা খোলা। আপনারা স্বাধীন সর্বার্থে। অন্তত আপনারা যদি নিজেদের স্বাধীন ভাবেন, ভাবতে পছন্দ করেন, তবে এই কাহিনির সঙ্গে আপনারা কথোপকথন করতে করতেই এগিয়ে যাবেন। প্রয়োজনে কিছু জুড়বেন, খানিক বাতিল করবেন, রাখবেন, ফেলবেন, আপনাদের মর্জি। তাতে এই কাহিনির মঙ্গল। কেন-না কাহিনিটা আদৌ জাদুবুড়োর, যুবক-যুবতির নাকি ফুলের, সে নিয়ে ধন্দ আছে। 

মাঝেমধ্যে মনে হয়, কাহিনিটা আপনাদেরই মনগড়া এবং আপনাদের জন্যই। অর্থাৎ, এ কাহিনির উৎপাদক ও ভোক্তা– ওই বাজারের মতো করে বললে যা দাঁড়ায় আর কি– দুই-ই আপনারা। কী, এই শুনে একরকমের ঈশ্বর ঈশ্বর অনুভূতি হচ্ছে না? নিজেরই সৃষ্টি নিজেই উপভোগ করতে চলেছেন। একটা কথা বলি, আমি কোথাও যেন শুনেছিলাম, প্রত্যেক মানুষই একবার করে নাকি ঈশ্বর হওয়ার সুযোগ পায়। দেখুন খেয়াল করে, এই কাহিনির ভিতর আপনার সেই অবসর লুকিয়ে আছে কি না। মোদ্দা কথা হল, এই কাহিনির নিয়ন্তা আপনিই। সুতরাং তার ভিতর থেকে গ্রহণ-বর্জনের স্বাধীনতা আপনাদের হাতেই। আমার কথা ভাববেন না। আমি এই কাহিনিটুকু বলে দেওয়া ছাড়া আর কখনও কিছু বলতেও আসব না। 

সবথেকে বড়ো কথা, আমি কে? যে, আপনারা আমার কথা মেনে নেবেন? সুধীমণ্ডলী, আমার হাতে কোনও বিশেষ ক্ষমতা নেই। আমি কেউকেটা নই। কাহিনি তৈরি করার মতো ক্ষমতা আমার নেই, আমি সর্বশক্তিমান অদ্বিতীয় কেউ নই। আমি কাহিনি বলছি মাত্র। আমার কথা একবাক্যে মেনে নেওয়ার কোনও দায় তাই আপনাদের নেই। হ্যাঁ, আমার পূর্বজন কেউ ছিলেন গল্পবলিয়ে মানুষ। তাঁদের কাজটা ছিল গল্প বলা, তবে সেই কাজের ভিতর একখানা গভীর উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল। হয়েছে কী, স্ত্রী-লোক আর শূদ্রদের তো শাস্ত্রপাঠে মানা করেছেন পণ্ডিতরা। কিন্তু শাস্ত্রের ভিতর যে নিয়মকানুনগুলো গুঁজে দেওয়া আছে, সেগুলো আমজনতা জানবে কী করে? আর না জানলে সমাজটা এক সুতোর টানে বাঁধাই বা পড়বে কী করে! ইঞ্জিন আর চাকার মধ্যে যোগ না-থাকলে গাড়ি গড়াবে কেমন করে! তখন একটা মতলব আঁটা হল, গল্পের ভিতর গল্প গুঁজে সেগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া হল। মহাকাব্য, পুরাণ– কত না গল্প আমাদের। আর সেইসব গল্প বলে বলে লোকের মাথায় নিয়মকানুন ঢুকিয়ে দিতেন আমাদের পূর্বপুরুষগণ। অর্থাৎ, গল্পবলিয়েরা। সেই গল্প কিন্তু তাঁরা সৃষ্টি করেননি। পরে, এই এখন, আজকালকার যুগে, সেইসব গল্প হাতে নিয়ে তো আমরা বুঝতেই পারছি কার ভিতর কী ঠেসে দেওয়া ছিল। তাতে কাদের কোন উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে, সেসব এখন পণ্ডিতেরা বলছেন। তো আপনারা যদি প্রশ্ন করেন, যে, সেইসব গল্প বলে আমার পূর্বপুরুষগণ কি ভালো কাজ করেছেন, নাকি এসব করা থেকে বিরত থাকলেই পারতেন? এ-প্রশ্ন করলে আমি খুশিই হব। কিন্তু এর উত্তর কিছু আমার দেওয়ার নেই। সব কিছুর উত্তর হয় নাকি বলুন! মহাকাল নিজেও তো কিছু এক্কাদোক্কা খেলে। 

যাই হোক, অত ঘুরপ্যাঁচ কথায় কাজ নেই। মোদ্দা কথা হল, আমার ক্ষেত্রেও একই জিনিস মাথায় রাখবেন। এই কাহিনি সৃজনের ক্ষমতা আমার নেই। আমি যা জেনেছি, যা দেখেছি, তাই-ই বলছি মাত্র। আপনারাও বলুন। আমার সঙ্গে মতভেদ, মতপার্থক্য যা হয় সোচ্চারে বলুন। গল্প বলার বিষয়ে আমার পূর্বপুরুষের সঙ্গে এই একটা জায়গায় আমি ফারাক আনতে চাইছি। কেন-না আমি জানি, আমার অছিলায় এই কাহিনির সঙ্গে যত আপনি আলাপে মাতবেন, তত আপনাদের ভালো হবে। কেন ভালো হবে? সে-কথা নাহয় পরে বলছি। 

আপাতত, আমার সঙ্গে একটা গ্রামে চলুন। গ্রামটার নাম আমি দিচ্ছি সোনাপুর। আপনি বলবেন, সোনামুখী জানি, সোনারপুর জানি, ওপার বাংলায় সোনারগাঁ বলেও একটা জায়গা আছে, কিন্তু সোনাপুর বলে কোনও গ্রাম আছে নাকি? কোথায় সেই গ্রাম? কোন জেলা? আমি এর উত্তর জানি, জানেন। বলেই দিতে পারতাম। কিন্তু এইখানটায় আমি খানিক হেঁয়ালি করছি। বলছি, কল্পনা করুন না কেন, আপনার পাশেই আছে এমন কোনও গ্রাম। মানচিত্রটা মনে করুন এইরকম, দক্ষিণে ধানি জমি। সারা গ্রামের মানুষের জমি এই দিকটায়। উত্তর দিকটায় বামুনপাড়া। বেশ কয়েকঘর ব্রাহ্মণের বাস। পশ্চিম দিক থেকে গ্রামের মাঝবরাবর গ্রামের সাধারণ মানুষ থাকে। তাদের একসঙ্গে অব্রাহ্মণ পাড়া বলা যায়। এরকম করে বলছি বলে রুষ্ট হবেন না। এইসব থাক পেরোতেই চাই জানেন, কিন্তু বিধি বাম। যদি এমন করে পাড়ার নাম ধরে ধরে না বলি, তবে আমি গ্রামটাকে চেনাতে পারব না। মানে, ধরুন বললাম, শ্রমজীবী মানুষের গ্রাম, আপনারা পালটা প্রশ্ন করবেন, সে নয় বুঝলাম, কিন্তু এটুকু বললে কই আর পষ্ট বোঝা যায়? আপনাদের দোষ নেই, আমরা এখনও এভাবে ঠিক বুঝতে পারি না। খানিকটা চাইও না বোধহয়। যাই হোক, আবার মানচিত্রে ফিরি। সোনাপুরের পুবে যেখানে কাঠের সাঁকো শেষ হয়ে পাশের গ্রাম আলাপুরে মিশছে, সেখানে কয়েকঘর মুসলমানের বাস। গ্রামটা যে বৈচিত্র্যময়, সে আপনারা টেরই পাচ্ছেন। 

গ্রামটাকে যাতে আপনারা আরও স্পষ্ট দেখতে পান, সেইহেতু আরও দু-একটা কথা বলি। দেখুন তো কল্পনা করতে পারেন কি না, এমন একটা গ্রাম, যেখানে এখনও মাটির বাড়ি খড়ের ছাউনি দেখা যায়। দেখা যায় পানাপুকুর, সরু ধুলোপথ। আবার তার ভিতরে ভিতরেই গজিয়ে উঠেছে খান কয়েক পাকা বাড়ি। কিছু মানুষ টাকা করেছে। তার জেরে এইরকম বাড়ি উঠেছে। কিছু সরকারের দান-খয়রাতির ফল। সকলে তো আবার সে সুবিধা পায় না। অনেক কালের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ঘটনা। সরকার সকলের জন্যই ব্যবস্থা করে। তারপর হাত ঘুরে ঘুরে জনাকয়ের কাছেই মাত্র সুবিধা পৌঁছায়। এই গ্রামেও তেমনটা হয়েছে। খানিক রাস্তা পাকা, খানিক রাস্তা কাঁচা। কিছু ঘরে কালার টিভি, কিছু ঘরে নেই। কয়েক ঘরে বাহারি আলো, কিছু ঘরে এখনও শুধু হলুদ বালব জ্বলছে। এমন একটা গ্রামের কথা কি আপনি কল্পনা করতে পারেন না? নিশ্চয়ই পারেন। আপনি যে পারেন, সে আমি জানি, আমার সেই পূর্বজের অভিজ্ঞতায়। কত কুরুক্ষেত্র, অযোধ্যা, লঙ্কার গল্প শোনালেন তাঁরা। কত পুরাণপুরুষের কাহিনি। যাঁরা শ্রোতা তাঁরা কি জানতেন, সেইসব জায়গা কোথায়! কিন্তু তাতে গল্পের কোনও ক্ষতি হয়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি সোনাপুরের দাগ-খতিয়ান নম্বর জানা সত্ত্বেও বললাম না। 

যাকগে, অনেক কথা বলা হয়ে গেল। কথায় কথা বাড়ে। আর এ অভ্যাস তো আমার সেই যাকে বলে একেবারে জিনবাহিত। সোনাপুরের ওই যে জাদুবুড়ো, ওর কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত আপনি যাতে বিরক্ত না হয়ে ওঠেন, সেইজন্য আমার খানিক বকবক করার দরকার ছিল। আমি তা করলাম। এবার আমার অবলোপ। আপনারা এবার কাহিনির ভিতর ঢুকে পড়ুন। আমিও আমার পূর্বজকে এই ফাঁকে একবার স্মরণ করি। কাহিনি একবার শুরু হয়ে গেলে তাঁরা কীভাবে নিজেদের সরিয়ে কাহিনিকে জ্যান্ত করে সামনে ভাসিয়ে রাখতেন, সেই কায়দাটার কথা মনে করি। কেন-না এখন আমাকেও সেই ভেলকিটাই তো দেখাতে হবে। আপনারা আমার দিক থেকে মন ফেরান, তাকিয়ে দেখুন জাদুকর বুড়োর দিকে।  




[দুই]


তারা ধরার খেলা জানে এই জাদুকর বুড়ো। সেইসব তারা, যারা খসে পড়ে, একদিন অকস্মাৎ। নিজেদের সংসারে থাকতে থাকতে টুপ করে ঝরে পড়া নিয়তি। তারও কতদিন আগে যে তাদের আয়ু ফুরিয়ে আসে। আলো তবু মিটমিট। জাদুকর বুড়ো আকাশের দিকে তাকিয়ে, কী এক গভীর শিক্ষায় নাকি মন্ত্রগুপ্তিতে ঠিক পড়ে ফ্যালে তারার মন। কোন আলো টাটকা, আর কোন আলো পান্তা– নিভে-যাওয়া-তারার বুক থেকে বেরোচ্ছে, তার থেকে ভালো আর কেউ জানে না।

যদি সে দ্যাখে আয়ুশেষ কোনও তারা ধুকপুক করছে তার দিকে চেয়ে, সে তখন তার লম্বাটে হাতখানা আকাশের দিকে তুলে হাতছানি দেয়; বলে– আয়, নিচে নেমে আয়। আমার কাছে আয়। সেই মরে-যাওয়া তারা তখন অবিশ্বাস্যভাবে গতিশীল হয়ে ওঠে। আকাশের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, তারপর বুড়োর চোখের দিকে চেয়ে চলতে থাকে। সোনার চাঁদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে আলোসাগরের রুপোর জল যেসব রাতে পৃথিবীকে স্নান করায়, তখন ধান উঠে গেছে, মাঠ ফাঁকা, শীত আসেনি তখনও, অঘ্রানের বাতাসে এক আশ্চর্য নম্রতা, সেইসব রাতে বুড়ো একা একা হেঁটে যায় মাঠের উপর দিয়ে। 

বুড়োর হাঁটার মধ্যে একরকমের ছন্দ আছে। দূর থেকে মনে হয়, সে যেন নাচতে নাচতে চলেছে। ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে যখন কোনও কৃষক চলে, তখন তার পায়ে থাকে এই ছন্দ। মাথায় বোঝার চাপে পা পড়ছে দ্রুত; যেন একটা পা ভালো করে পড়ার আগেই আর একটা পা মাটিতে পড়ছে। সে ঠিক হাঁটাও নয় ছোটাও নয়। একবার এই পায়ের শিরা ফুলছে, তো পরেরবার ওই পায়ের। সবল মানুষের শিরা দপ্‌ দপ্‌, তুলনায় রোগাদের পায়ের শিরা দিপ্‌ দিপ্‌। সবটা মিলিয়েই একটা ছন্দ। জাদুবুড়োও চলনে আছে এই ছন্দ। যেন, তার মাথায় কেউ জন্মের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। সে নিজে অবশ্য বলেও তাই। মাথার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, গল্প, দুনিয়ার গল্প জমা হয়ে আছে।  

জাদুবুড়ো যখন এমনি ছন্দে মাঠের গহিনে ছুটে যায় তখন নজরে আসে, আকাশের বুক চিরে দ্রুত ছুটে চলেছে কোনও এক তারা। একটু গিয়েই সে টুপ করে খসে পড়ে। অমনি খলখল হাসি শোনা যায় জাদুকর বুড়োর। সকলেই জানে, খসে যাওয়া তারাখানাকে সে এইবার তুলে রেখে দেবে তার কাছে। এমনি করে কত মরে-যাওয়া তারার যে সে মালিক হয়েছে, তার ঠিক নেই। সেইসবই তার সম্পদ। বুড়োর যদিও বড়াই নেই তা নিয়ে। 

সোনাপুর গ্রামের লোকে তাকে জাদুবুড়ো বলে ডাকে। যেহেতু জাদুকর বুড়ো– এই নামে ক্রমাগত ডাকা খানিকটা খটমট, তা ছাড়া, ডাকনামে একটা ছন্দ থাকলে বেশ খানিক অন্তরঙ্গতা। বুড়ো এমনিতে কথা বলে কম। লোকে খোঁচালে দু-চারটে, কখনও-সখনও। যেমন, লোকে বলে, জাদুবুড়ো, তুমি এই তারা-ধরা খেলা শিখলে কোত্থেকে? বুড়ো মিচকি হেসে বলে, কেন, আমার কাছে আছে না রাউ চণ্ডালের হাড়! লোকে বলে, দেখাও তবে। অমনি বুড়োর খলখল হাসি। সে দেখাবে না। কিছুতেই সে তার হাতের তাস দেখাবে না। অথচ সমস্ত মৃত নক্ষত্রের ইতিহাস সে সংগ্রহ করে ঝুলি ভরাচ্ছে। কী হবে বুড়ো, এইসব করে কী হবে? লোকে প্রশ্ন করে। বুড়ো উত্তর দেয় না। খানিক উদাসীন হয়ে বসে থাকে। তারপর একটু থেমে থমকে বলে, নইলে যে সব হারিয়ে যাবে। 

এরপর লোকে আর কেউ কিছু প্রশ্ন করে না। এ পৃথিবীতে সবই তো হারিয়ে যায়। মানুষ। মানুষের স্মৃতি। বেঁচে-থাকার এই এতবড়ো আয়োজন এক নিমেষেই হারিয়ে যায়। সে-কথা ভাবলেই বড়ো বুক-ধরে-আসা কষ্ট। মনে হয়, সবকিছু অর্থহীন। কেনই বা এত ঘাম! এত জল! এত প্রাণ! যদি তা হারিয়েই যাবে! তবু উঠে দাঁড়াতে হয়। হারিয়ে যাওয়া গন্তব্য জেনেও এক আঁজলা জল খুব সন্তর্পণে ধরে থাকতে হয়। যেন আঙুলের ফাঁক গলে দ্রুত না পড়ে যায়। এই ফাঁকে জাদুবুড়ো যদি কিছু হারিয়ে যাওয়া আটকাতে পারে, তবে মন্দ কী!

কেউ অবশ্য জানে না, বুড়োর চলে কী করে! কেউ তো এ-ও জানে না যে সে কবে কোথা থেকে এখানে এসেছে। কৌতূহলী হলে বুড়ো বলে, রহস্য। এই এসে-পড়াও রহস্য। চলে-যাওয়াও রহস্য। লোকে আর–কিছু জিজ্ঞেস করে না তাই। বুড়ো খায় কী? না, সে-ও এক রহস্য। কেউ কেউ বলে বুড়ো নাকি গাছের মতো আলো খেয়ে, বাতাস খেয়েই বেঁচে আছে। এ অবিশ্যি ভাবের কথা। এইরকম চকোরের স্বভাব প্রণয়কাহিনিতে ভালোভাবে মিশে যায়। অধরের সুধাই সেখানে প্রণয়ীর জীবন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু হাড়সম্বল এই চিমসে বুড়োর সঙ্গে যেন এইসব কিছুতেই তা মেলে না। কেউ তার অমন প্রায় কোটরগত চোখের পানে তাকিয়ে কেমন করে বলবে যে, জোছনা খেয়ে এ বেঁচে থাকে! বড়ো বেমানান লাগে। 

সমঝদার দু-চার জনা লোকে তাই বলে তাই, ওই যে তারা ধরে বুড়ো, ধরেই মুখে পুরে দেয়, তারপর একসময় হজম করে ফ্যালে। সেই তারার গল্প তার পেটের ভিতর থেকে রক্তে-মাংসে মিশে যেতে থাকে। কত গল্প, কত কাহিনি বুড়োর শিরায় শিরায় বয়ে বেড়ায়। হৃৎস্পন্দনে ছলকে ওঠে। যদি তেমন করে জাদুবুড়োকে চেপে ধরা যায়, তাহলে সে গল্প আকুলি-বিকুলি করে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে মৃত নক্ষত্রের সব ইতিহাস। 

কিন্তু বুড়োর মুখে এমনিতে কুলুপ। কথা কইবে না তো, নাই-ই। অনেক সাধ্যসাধনাতেও তার মুখে বাক্যি সরে না। সে শুধু হাসে। খলখল হাসে। নিজের শরীরখানার দিকে আঙুল দেখিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, তোমরা পড়ে নাও না কেন! আমি তো সব তুলে রেখেছি। বলে, তার কুঁচকোনো চামড়ায় একটা টোকা দিয়ে, যেন ভিতরের গল্পের থাকে থাকে নাড়া দিয়ে, তাদের ঘুম ভাঙিয়ে, তাদের জেগে বেরিয়ে আসার আকুতি বাড়িয়ে দিয়ে, জাদুবুড়ো, আবার তার হাসিখানা হেসে সবকিছু রহস্যময় করে তোলে।    

এই জাদুবুড়োর কথাই আমাদের এখন শুনতে হবে। শোনা ছাড়া গতি নাই। কতকিছু যে আমাদের শুনে যেতে হয়! সোনাঝুরির মতো অজস্র শোনার জিনিস আমাদের শ্রবণ বেয়ে জড়িয়ে-জড়িয়ে আছে। ক্রমাগত আমাদের বহু অপ্রসঙ্গ শুনে যেতে হয়। সেসব বলার লোকও তৈরি হয় কালে কালে। আজ একজনা বলে, কাল পাঁচজনা, পরশু রক্তবীজের ঝাড়। ওরা বলবে, তোমাদের অতীত মিথ্যে। তোমাদের স্বপ্ন মিথ্যে। তোমাদের মাতৃপরিচয় মিথ্যে। মাটির শরীরে তোমাদের অতীত পুরুষের ঘাম-শ্রম মেশেনি কোনোকালে। মাতৃযোনিতে এসে পড়েনি পুরুষের সোহাগজল। বলবে, তোমাদের জন্ম এমন অকিঞ্চিৎ যে, আমরা স্বীকৃতি না দিলে তা জন্মই নয়। এই নাও জন্মের কাগজ। কবচ করে বেঁধে রাখো ঘুনসির সঙ্গে। যেদিন যেখানে প্রয়োজন হবে, সেদিন দেখিয়ে দেবে। এমনই সব কথা শুনে যেতে হয়। 

যারা এসব বলে বেড়ায়, তাদের বুকে মরুভূমি মুখে মরীচিকা। তবু শুনে যেতেই হবে। কেবলই শুনে যেতে হয় যে, যা তারা দেখাবে সেটাই স্বপ্ন। বলে, দু-মুঠো ভাতের স্বপ্ন দ্যাখো কি? তোমাদের চিন্তা কী! এই আমরা তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বেশ করে খেটেখুটে তোমরা চাল জোগাড় করে আনো দিকি। তোমাদের বউ-ঝিরা বাকি সবকিছু ফেলে ফোটাক সে চাল। কিন্তু বাড়তে হবে না। তোমাদের হাঁড়িভরা ভাত, এই দ্যাখো, টুক করে আমরা কেড়ে নিলাম। তারপর সেই ভাত থেকে দু-মুঠো বেড়ে দিলাম শালের পাতায়। তাহলে ভাত আমরাই দিলাম কি না! এমন গুছিয়ে কেই-বা ভাত দেয় তোমাদের! এমন যত্নআত্তি কে কবে করেছে কোন দেশে! আমরা গড়ে দেব এরকম সোনার দেশ! সোনার বাড়ি জমি আমরাই দেব তোমাদের। তোমাদের কিছু নেই। কিচ্ছু ছিল না কোনোদিন। আমরা ঈশ্বরের বরপুত্র হয়ে নেমে এসে উদ্ধার করছি তোমাদের। এমন দেশ গড়ে দেব যে সেখানে সবাই রাজার হালে থাকবে। ওদের মুখের মরীচিকা লকলক করে ওঠে। 

এবার মানুষের মন তো! আগেই বলেছি তার কোনও হাল-হদিশ মেলে না। কেউ কেউ এসব কথায় বিশ্বাস করে, আর কেউ কেউ এইসব শুনে মনে মনে বলে, সকলেই যদি রাজার হালে থাকলে, রাজা তবে কোন হালে থাকবে! নাকি রাজাই আর থাকবে না! অথবা, সকলের জন্য সকলের রাজত্ব হবে নাকি একখানা! বলি ঘোর কলি কি তবে কেটে গেল? 

এইসব কথা উঠলেই অবতারবরিষ্ঠ শেয়ালেরা দৌড়ে পালিয়ে যায়। ঝুপ করে অন্ধকারের পর্দা পড়ে যায়। তখন সকলের চোখ লেগে আসে। প্রতিদিন ঘুমের ভিতর খেটে-খাওয়া মানুষ স্বপ্ন দ্যাখে পৃথিবীটা আশ্চর্য নতুন হয়ে উঠছে। সকালে আবার নতুন করে শুনতে হয় পুরোনো সেই কথাই। সোনাঝুরির মতো সোনার বরন পরজীবী কথারা আবার জড়িয়ে ধরে, মন ভোলায়। 

এইসব কথা শুনে শুনে জন্মের অরুচি। সেই কতদিনের মানুষ। কতবার কতভাবে কান এঁটো হয়েই চলেছে। লোকে তাই জাদুবুড়োর কাছে যায়। বলে, বলো না বুড়ো, তোমার কিছু কিস্‌সা। আমাদের আর শেয়ালের ডাক শুনতে যে ভালো লাগে না ছাই। কিন্তু বুড়োর তো রহস্য করা স্বভাব। সে সহজে কিছু বলবেই না। আবদার পাশ কাটাতে বলে, ওরা আসুক, তবে তো বলব। লোকে বলে, ওরা কারা? ওই ওরা? জাদুবুড়ো বলে, না, সেই ওরা। তারা আবার কারা? লোকে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। জাদুবুড়ো ঠিক আয়ু ফুরোনো তারার মতোই দুবার চোখ মিটমিটিয়ে ওঠে। তারপর চুপ করে থাকে। অনন্ত নীরবতা। লোকজন খেপে যায় তাকে দেখে। বলে, ওই নাও, বক এবার ধ্যানে বসল! ঢং দ্যাখো বুড়োর! 

লোকে শুধু জানে, একদিন ওরা আসবে। 


[চলবে] 

.............................. 


অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র

সজ্জা : বিবস্বান দত্ত 


#সোনার বাড়ি জমি #সরোজ দরবার #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #ধারাবাহিক উপন্যাস

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

61

Unique Visitors

215846