সোশাল মিডিয়া, নিউ নর্মাল ইত্যাদি এবং নতুন প্রজন্মের ভালো থাকা
করোনা-আবহে বদলে যাচ্ছে জীবন। বদলে যাচ্ছে বেঁচে থাকার ছক। ফলে ভালো থাকতে গেলে তো তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতেই হবে আমাদের যাপনকে। শুধু তো করোনা নয়, সোশাল মিডিয়াও গত কয়েক বছর ধরে প্রবলভাবে বদলে দিচ্ছে সময়ের চরিত্রকে। এই সব মিলিয়েই তো নিউ নর্মাল। অতিমারি-বিদ্ধ এক আশ্চর্য ছায়াসময়। কীভাবে তার সঙ্গে মানিয়ে নেব আমরা?
বহু দিন ধরেই ভাবি সোশাল মিডিয়া নিয়ে কিছু লিখব। তারপর মনে হয়, কে কীভাবে নেবে| ফেসবুক থেকে নি:স্বার্থ ভালোবাসা যেমন পাই, বিরক্তিকর অভিজ্ঞতাও কিছু কম নয়। সোশাল মিডিয়া তো বাস্তব জীবনেরই এক ডিজিটাল রূপ। হিংসা-ভালোবাসা সবই আছে এখানে। তাই খুব আলাদা বলে কিছু বোধ হয় না। কত ঘটনার তো আগা-পিছু কিছু বুঝেই উঠতে পারি না। গীতায় বলা আছে, সব কিছুর ব্যাখ্যা চেয়ো না। তাই চাইও না। বিশ্লেষণ কম করে, অগত্যা কাজে মন দিই।
গেল লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক মনোনয়নপত্র পেশ করবার সময়, চোখে পড়েছিল কিছু জনপ্রতিনিধির শিক্ষাগত যোগ্যতার খতিয়ান। গ্র্যাজুয়েট প্রার্থী মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজে বের করতে হচ্ছে। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় যেটা খেয়াল করেছিলাম সেটা হচ্ছে, তাঁদের অশিক্ষার কারণ অভাব নয়। অতিরিক্ত পয়সাও কখনও কখনও শিক্ষার অন্তরায়। গরীব ছেলেমেয়েদের না হয়, ডিম-ভাত, মিড ডে মিল্ দেখিয়ে স্কুলে আনা সম্ভব। বেশ কিছু পেপারও আছে এই বিষয়ে। কিন্তু বড়োলোকের ছেলে-মেয়েরা কিসের লোভে আসবে? কেন পড়বে তারা, হাঁচলে কাশলেও যেখানে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যায়? সৌরভ গাঙ্গুলি বা অভিনব বিন্দ্রা ব্যতিক্রম। তাঁরা পড়াশোনাও করেছেন, আবার কাঠ ফাটা রোদ্দুরে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে পিচেও থেকেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা।
একটি গরীব ছেলে বা মেয়ের, নিজের পায়ে দাঁড়ানো যতটা কষ্টের, একটি বড়লোক বাড়ির সন্তানের সমস্ত প্রলোভন কাটিয়ে, সাধক হয়ে ওঠাও ঠিক ততটাই কঠিন। মহিলাদের ক্ষেত্রে পড়াশোনার অন্তরায়গুলো আরও গণ্ডগোলের। একটি মেয়ে জন্মানোর পরে-পরেই সমাজ তাকে বিভিন্ন আকারে-ইঙ্গিতে, হাবে-ভাবে বুঝিয়ে দেয়, "তুমি রাজরানি হবে।" এখন সমস্যা হল, মানুষ ভীষণ বুদ্ধিমান। এ-ও এক সমস্যা বৈকি। ঈশ্বরের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠতম জীব সে। তার অবচেতন মন ধরেই নেয় রূপ-যৌবন-পয়সা যখন আছে, আমি পড়ব কেন? মগজ দিয়ে আমার কী হবে? ফলে যা হবার তাই হয়। তারকাদের রোগা হবার রহস্য, ডায়েট চার্ট, কার গর্ভে কার সন্তান, কে চতুর্থ বিয়েটি করে রেস্ট নিচ্ছেন, সংবিধানের কোন ধারায় কীভাবে মামলা করা যায়, এই নিয়ে সন্ধ্যেবেলা আলোচনাচক্র বসছে ।
করোনো-আবহে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক বন্ধ। কলেজে আজ কতগুলো সেমিস্টার হয়ে গেল, অনলাইন ইভ্যালুয়েশন করছি। সারাদিন বাচ্চা-বুড়ো সকলে বাড়িতে। এর মধ্যে চ্যানেলগুলোয় ক্রমাগত এই আলোচনা। না চাইলেও নিউজফিডে জন্নাত-লাবন্তীর গল্প। ওয়েব সিরিজগুলোর নব্বই শতাংশেই বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কিসসা। নিতান্তই অপ্রয়োজনে, টি. আর.পি বাড়াতে, অশ্লীলতার পসরা। কী বিশ্রী পরিবেশ ! এর থেকে কীভাবে বাঁচবে নতুন প্রজন্ম ?
ছবি আঁকো। গান শোনো। গান গাও। বাড়িতে টেপ চালিয়ে নাচো। বই পড়ো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাটক করো। রং-বেরঙের ফেব্রিক দিয়ে টব, মাটির হাঁড়ি রং করো। মেকআপে যাদের ইন্টারেস্ট আছে, বাড়ির লোকেদের বিভিন্ন রকম লুক দাও। কাজের দিদির পাড়ার দু তিনটে বাচ্চাকে ডেকে নিয়ে, ছাদে বা উঠোনে বসে অঙ্ক করাও। বাবা মায়ের হাজার পয়সা থাকলেও, কোনো পার্ট টাইম জবে ঢুকে পড়ো। আঠারো বছর হলে, গাড়ি চালোনো শিখে নাও সম্ভব হলে। ওলা -উবের -ওলাবাইক- Zomato-Swiggy যা হোক। এগুলোয় চাইলে দিনে তিন ঘন্টার জন্যও কাজ করা যায়। এনরোল করে রাখো।
সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ফিরে এসে আমার এক দাদু জানিয়েছিলেন, ওখানকার বেস্ট ইউনিভার্সিটির রিসার্চ স্কলাররা, গেস্ট হাউজের ল্যাট্রিন পরিষ্কার করতে আসত প্রতিদিন সকালবেলা। সেখানে ফুড ডেলিভারি, গাড়ি চালানো কি অনেক সহজ নয়? "পৃথিবীর কোনো কাজ , সে যত ছোট বা যত বড়ই হোক, কখনও খেলো হয় না।"
পাশাপাশি, কম্বাইন্ড কম্পিটিটিভ এগজামের পড়াশুনো করো। ইকনমিক্সে আমরা পড়াই, রিসেশনের পর রিকভারি ও তারপর বুম। এটা পরীক্ষিত সত্য। করোনা-আবহে বহু দিন সেক্টরগুলোয় লোক নিচ্ছে না। ঠিক সেই কারণেই যখন ওরা নেবে, বেশ কিছু রিক্রুটমেন্ট হবে আশা করি। এই মুহূর্তে কোনো প্রাইভেট ফার্ম, কম পয়সা দিলেও ঢুকে পড়ো। কাজ তো শিখবে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই হয়তো একদিন তুমি নিজের স্টার্ট-আপ বিজনেস খুলতে পারবে।
আরও পড়ুন : লকডাউন ও মানসিক স্বাস্থ্য / সেঁজুতি গুপ্ত
যারা ম্যুভি দেখতে ভালোবাসো, পুরোনো ক্লাসিকগুলো আগে দ্যাখো। তা না হলে তুলনা করতে পারবে না । শুধু মডার্ন অ্যাপ্রোচই কেন দেখবে।যে কোনও রকম ম্যুভি দিয়ে রিভিউ লেখা অভ্যেস করো। কভি খুশি কভি গম, সপ্তপদী, হেমলক সোসাইটি থেকে পথের পাঁচালি বা যা তোমার মন চায়। গদার নিয়ে যে লিখবে লিখুক। স্বপন সাহাকে নিয়েও যদি হয়, কিছু অন্তত লেখো। ইংরাজি, বাংলা দুটোতেই লেখা অভ্যেস করো। অনেক স্যাম্পল পাবে গুগলে, ইউটিউবে।
অডিও বা ভিডিও এডিটিং-এর কোর্স, স্পোকেন ইংলিশ, স্টোরি টেলিং ওয়ার্কশপ - যাতে ইন্টারেস্ট পাও এনরোল করাও। একটা সাদা খাতা আর কয়েকটা অগ্নি জেল নাও। দ্যাখো কত কত সম্ভাবনা নিয়ে পাতাটা তোমার দিকে চেয়ে আছে। আজই বসে আগামি এক মাসের রুটিন তৈরী করে ফ্যালো।
আরও পড়ুন : জোহারির জানলা : মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যার এক চমকপ্রদ প্রয়াস / ইমানুর রাহমান
আর হ্যাঁ, বিয়ে বা লিভ্ ইন্ প্রসঙ্গেও দু-এক কথা বলে রাখি। এমন ওভার হাইপড্ বিষয় পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পার্টনার যদি কেউ থেকেই থাকে, তার বন্ধু হয়ে ওঠো আগে। প্রেমিক - প্রেমিকা সত্তা বেশিদিন থাকে না। মোহ ভেঙে যায়। যে থাকার সে ঠিক খারাপগুলো নিয়েও থেকে যাবে। পায়ে সেধে, সিন ক্রিয়েট করে, আলোচনাচক্র বসিয়ে কাউকে বেঁধে রাখতে হবে না। রাখা যায় না ওভাবে। সবার আগে নিজে যোগ্য হও। ভালোবাসার বিষয়গুলোয় মন দাও বেশি, ব্যক্তিবিশেষে কম।
দিনের শেষে, নিজেকেই নিজে ভালো রাখতে হয়। সেই দায়িত্ব কাউকে দিয়েছ কি মরেছ। আর অবশ্যই, সিঙ্গল হও বা ডাবল, ছোটবেলার নিষ্পাপ বন্ধুত্ব কখনও ভুলো না। প্রেম মানুষকে কখনও সখনও, বড্ড একলসেরে করে দেয়। সেটা হতে দিও না। হৈ হৈ করে বাঁচো।
Dr. Senjuti Gupta
W.B.E.S
Assistant Professor of Economics at Govt. College
....................................
[ছবি : ইন্টারনেট]
#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #মন #Mental Health #Social Media #New Normal #সেঁজুতি গুপ্ত