স্মৃতির রিজার্ভ বেঞ্চ (চতুর্থ কিস্তি) - পরেশলাল রায়
আধুনিক দুনিয়ায় খেলা বরাবরই সবচেয়ে গ্ল্যামারাস জিনিসগুলোর একটা। সব খেলা নয় অবশ্যই। এ দুনিয়ায় কোনও কোনও খেলা ধর্মের সমার্থক হয়ে যায়, আর কোনও কোনও খেলার কুশীলবেরা স্বীকৃতি না পেয়েই চলে যান - চুপিচুপি, একা একা। তবে স্মৃতি জিনিসটা বড় প্রতারক। আজকের গ্ল্যামার নিমেষে ফিকে হয়ে যায় আগামীর ধুলো পড়ে। একটু পুরোনো হয়ে গেলেই প্রায় সব স্মৃতি এক পংক্তিতে বসে যায়। ভুস করে তাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে যায় আমাদের বাস। স্মৃতি খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে রিনিউ করতে করতে ডিলিট করতে থাকে পুরোনো জিনিসপত্র। এই তথ্যবিপ্লবের যুগে কিছুদিন আগের ঘটনাই যেন মনে হয় কত শতাব্দী পিছনে ফেলে আসা - সেপিয়া টোনে ছোপানো মনকেমন। বেহালার আগেও তো অনেক গর্ব করার মতো গল্প ছিল বাঙালির খেলায়। পঙ্কজ রায়েরও আগে ছিল কিছু গল্প। এমনকী কিছু গল্প ছিল সেই সাদা- কালো যুগের গোবরবাবুরও আগে। আমরা খবর রাখি না। কেমন হয় যদি ধুলো- টুলো ঝেড়ে তুলে আনা যায় পুরোনো দিনের এমন কয়েকজন বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াব্যক্তিত্বের গল্প? সিলি পয়েন্টের এই নতুন সিরিজে সেই চেষ্টাই ধরা থাকল, খেলা-প্রেমীদের জন্য। আজ চতুর্থ কিস্তিতে বক্সার পরেশলাল রায়।
পরেশলাল রায় ছিলেন একজন অ্যামেচার বক্সার যিনি ভারতীয়দের মধ্যে এই খেলাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তাঁকে ‘ভারতীয় বক্সিংয়ের জনক’ বলা হয়। বরিশালের এক উচ্চ পরিবারের সন্তান পরেশলাল ইংল্যান্ডে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন। দশ বছর বয়সে তাঁর বক্সিং শিক্ষার শুরু হয় তৎকালীন কেমব্রিজের বক্সিং প্রশিক্ষক বিলি চাইল্ডসের তত্ত্বাবধানে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ফেদারওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন জেমস্ ড্রিস্কোল স্বয়ং পরেশলালের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাঁর প্রশিক্ষণে পরেশ বক্সিঙে স্কুল চ্যাম্পিয়ন হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পাশাপাশি তিনি অক্সব্রিজ দ্বৈরথে বক্সিং চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম এশিয়ান যিনি ‘কেমব্রিজ ব্লু’-এর সম্মান পেয়েছিলেন।
পরেশলাল ১৯১৪ সালে বান্টামওয়েট বিভাগে ইংল্যান্ডচ্যাম্পিয়ন হন। বক্সিংয়ের পাশাপাশি তিনি শুটিং ও অশ্বারোহণেও পারদর্শী ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে পরেশলাল রয়্যাল আর্টিলারিতে প্রাইভেট পদে যোগ দেন । পরে তিনি লেফটেন্যান্টও হয়েছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতে ফিরে এসে তিনি বেঙ্গল রেলওয়েতে যোগ দেন। ইঙ্গ-ভারতীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় বক্সিং খেলাকে ভারতীয়দের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বালিগঞ্জে একটি বক্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় তাঁর উদ্যোগে প্রথম আন্তঃরেল বক্সিং প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। ঐ বছরেই তিনি বেঙ্গল বক্সিং ফেডারেশন স্থাপন করেন ও তার সম্পাদক হন। প্রমথ চৌধুরী, ফণীন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, নগেন চ্যাটার্জী, জনি নাতাল, আর. অস্টিন, কার্তিক দত্ত প্রমুখ ছিলেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম।
অ্যামেচার বক্সার হলেও পরেশলাল রায় তৎকালীন ভারতীয় বান্টামওয়েট চ্যাম্পিয়ন এডগার ব্রাইটকে ও ফিলিপাইন বক্সার ইয়াং টার্লিকে পরাস্ত করেছিলেন। শিয়ালদহে অবস্থিত পি. এল. রায় ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁরই নামে নামাঙ্কিত।
[কভার পোস্টার ডিজাইন : অর্পণ দাস]
#খেলা #স্মৃতির রিজার্ভ বেঞ্চ #নিবন্ধ সিরিজ #পরেশলাল রায়