ভবিষ্যতের স্মার্ট ফুড : পুষ্টির ঘাটতি মেটাবে ছত্রাকের প্রোটিন?
ছত্রাক বললেই আমাদের মনে পড়ে ব্যাঙের ছাতা, আর দোকানে গিয়ে ব্যাঙের ছাতা বললেই হাতে আসবে মাশরুম। তা বলে ছত্রাক বা ফাঙ্গাস বললে মোটেও শুধু কচকচিয়ে চেবানো মাশরুম বোঝায় না, আর সব মাশরুমও মোটেই ‘ব্যাঙের ছাতা’ নয়। ছত্রাক জগতের বাসিন্দাদের অধিকাংশই অখাদ্য-কুখাদ্য, কিন্তু তারা কোশের গঠনের দিক থেকে আমাদের অতি প্রাচীন আত্মীয়, তাই তাদের নিয়ে বিজ্ঞানীদের উৎসাহের অন্ত নেই। এমন উৎসাহের ফলেই আশির দশকের শেষ দিকে জানা গেছিল এক অদ্ভুত ব্যাপার – কিছু কিছু ছত্রাকের দেহজাত উপাদান মানবশরীরে প্রোটিনের ঘাটতি মেটাতে সক্ষম।
একটু খোলসা করে বলা যাক? আমরা মূলত তিন ধরনের খাবার খাই – শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট আর প্রোটিন। এদের মধ্যে শর্করাকে ভাঙ্গা সহজ, তাই সবার আগে বিপাকক্রিয়ার বলি হয় সে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শক্তি উৎপন্ন হয় প্রোটিন ভাঙলে, আর সেই প্রোটিন পুষ্টি জোগায় আমাদের পেশিতে। তাই শরীর এবং সামর্থ্যের সঠিক বিকাশের জন্য, হরলিক্স নয়, চাই প্রোটিন। আরও স্পষ্ট করে বললে প্রাণিজ প্রোটিন, কারণ উদ্ভিজ্জ খাদ্যে প্রোটিনের পরিমাণ তুলনামূলক ভাবে কম, তাছাড়া প্রাণিজ প্রোটিনের বিপাকের হারও বেশি। সেক্ষেত্রে যারা নিরামিষাশী তাদের জন্য রইল ডাল, সয়াবিন, টোফু ইত্যাদি। আর সেইসঙ্গে রইল ছত্রাক। না, শুধু মাশরুম নয়। ছত্রাকের কোশ থেকে পাওয়া নির্ভেজাল প্রোটিন – এককালে একে বলা হত ‘এককোশীয় প্রোটিন’ (Single Cell Protein, SCP), এখন বলা হয় মাইকোপ্রোটিন (ছত্রাক সংক্রান্ত পড়াশোনাকে বলে Mycology, তাই অমন নাম)।
এই মাইকোপ্রোটিনের চল কিন্তু হাল আমলের নয়, আগেই বলেছি এর শুরু সেই আশির দশকের শেষে। ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী লর্ড জোসেফ র্যাঙ্কের হাত ধরে অজ পাড়াগাঁয়ের এক অখ্যাত ছত্রাকের দেহনিষ্কাশিত প্রোটিন অভিজাত ইংরেজদের খাদ্যতালিকায় আস্তে আস্তে ঢুকে পড়তে শুরু করে। পোশাকি নাম ‘Quorn’, যা আজ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ ১৭টি দেশে জাঁকিয়ে বসেছে। রূপকথার মতো শোনালেও এর পিছনে আছে দীর্ঘ কুড়ি বছরের গবেষণার শ্রম। বিজ্ঞানীরা প্রায় তিন হাজারেরও বেশি ছত্রাকের নমুনা সংগ্রহ করে, পরীক্ষা করে, অবশেষে পেয়েছিলেন একটি ছত্রাক যার উপর নিরন্তর কারিকুরি চালিয়ে মাইকোপ্রোটিনের অতি-উৎপাদন সম্ভব হয়েছিল। ছত্রাকটি ছিল Fusarium venenatum – দেখতে সুতোর মতো জড়ানো-প্যাঁচানো আর মূল সাকিন বাকিংহ্যামশায়ারের মাঠঘাট। এর পেট থেকে যে প্রোটিন পাওয়া যায় তাতে ফাইবারের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি, এতটাই যে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখলে এর ফাইবারের বুনোটের সঙ্গে মাংসের ফাইবারের বুনোটের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি, তারা নিরন্তর প্রচেষ্টায় Fusarium-এর ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়াকে এমন ভাবে সাজিয়ে তুলেছেন যাতে উৎপন্ন প্রোটিনের তাল দেখলে মুরগির সিনা বলে ভ্রম হবে! ফলে নিরামিষাশীদের পাতে প্রোটিনও তুলে দেওয়া গেল, আবার আমিষাশীদেরও লোভ দেখানো হল। খাদ্যগুণেও কিন্তু মাইকোপ্রোটিন কারও থেকে কোনও অংশে পিছিয়ে নেই – প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড, খনিজ মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট, ডায়েটারি ফাইবার, ফ্যাটি অ্যাসিড, সামান্য শর্করা – সবকিছুই পাওয়া যায় এতে।
প্রশ্ন হল, এত কিছু করার প্রয়োজন কী? পনির-পালং-পমফ্রেট খেয়ে কি আমরা যথেষ্ট সুখে নেই, নাকি নিরামিষভোজীরা এত শত বছর ধরে কোনও প্রোটিনই পাচ্ছিলেন না? অবশ্যই তা নয়; মাইকোপ্রোটিন প্রকৃত অর্থে একটি ‘ফিউচার ফুড’। গোটা পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং কৃষিজমি বনাম বাসজমির বিবাদ, তদুপরি রাসায়নিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে কৃষিতে উৎপাদনের ঘাটতি আমাদের বাধ্য করেছে বিকল্প খাদ্যের সংস্থানের কথা ভাবতে। বার্ধক্যজনিত পেশিক্ষমতার ক্ষয় বয়সকালের নানা বিপদ-আপদের মূল কারণ; পেশিক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার দায় অনেকটাই বর্তায় বৃদ্ধ বয়সে বদলে যাওয়া প্রোটিনের বিপাকক্রিয়ার উপর। বাড়তি প্রাণিজ প্রোটিনের জোগান দিতে মাইকোপ্রোটিনের পুষ্টি ধীরে ধীরে ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে। আরও একটা জোরের জায়গা হল, এর পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থা। মুরগি-ছাগলের খামারের তুলনায় ছত্রাকের ছাপাখানা চালাতে জল-জমি-কার্বন নিঃসরণ সবই কম লাগে।
তবে এসবের পরেও একটা সংশয় মনের মধ্যে গোঁত্তা মেরে চলে। খাদ্যের অধিকার নাহয় আমার-আপনার সবার, কিন্তু পুষ্টির প্রয়োজন সবচাইতে বেশি কাদের? যাদের সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে পাতে জোটে নুন-লঙ্কা দিয়ে শাক-ভাত। ভাতটুকুও জোটে না অনেকক্ষেত্রেই। তাদের গ্রাসে ওঠার দায় মাইকোপ্রোটিনের বাজারের অন্তত নেই, এটুকু নিশ্চিত। ব্রিটেনের ‘মার্লো ফুড্স’ বা বুয়েনস আইরেসের ‘কার্নেল মাইকোফুড্স’, ‘কেলগ্স’, ‘মাইকোরেনা’ – প্রথম বিশ্বের সবকটি সংস্থার শেয়ার-দর এখন চনমনে, তারাও চেষ্টা করছে মাইকোপ্রোটিনকে বিকল্প খাদ্যের গণ্ডি থেকে বের করে রোজকার রান্নার উপাদান বা উপকরণ হিসেবে বাজারজাত করতে। সুসজ্জিত সুপারমার্কেটে বিক্রিত এই সম্ভার কি অপুষ্টিকে আঁকড়ে থাকা মানুষগুলোর কাছে একটা মারাত্মক পরিহাসের চেয়ে খুব কম কিছু?
তথ্যসূত্র :
১) Mycoprotein: The Future of Nutritious Nonmeat Protein, a Symposium Review – Current Developments in Nutrition, 2019
২) Mycoprotein: environmental impact and health aspects – World Journal of Microbiology and Biotechnology, 2019
#মাইকোপ্রোটিন #mycoprotein #protein source #বিজ্ঞান #smart food #future food #সিলি পয়েন্ট