শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও একটি ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য
“এত কবি কেন?”প্রশ্নকর্তা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। প্রশ্নটি, প্রশ্নের কারণ সমেত, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৭ সালের ২রা অগাস্ট, আনন্দবাজার পত্রিকায়। সে সময়ের কবিতাপ্রেমী/ সাহিত্যপ্রেমী/ রুচিশীল/ সুশিক্ষিত/ বিদ্বজ্জন সম্প্রদায় আজও এক বাক্যে স্বীকার করেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে আর কখনও একজন কবি-কৃত প্রশ্ন এমন ধুন্ধুমার ফেলে দেয় নি সাহিত্যমহলে। অনেকের কাছেই নিন্দিত হন কবি। যেখানে বাংলা কবিতায় তাঁর বিকাশ, তাঁর রমরমা, জনপ্রিয়তা এমন আকাশছোঁয়া আর ক্রমবর্ধমান, এমন প্রশ্নের কি কোনও প্রয়োজন ছিল? কবিজীবনের প্রায় সায়াহ্ন ছুঁয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় কি ভীত হচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভেবে? একটু খতিয়ে দেখা যাক।
অবশ্য খতিয়ে দেখা সম্ভব একমাত্র এখনকার নিরিখে, আজকের সময়ে। কারণ ১৯৮৭ থেকে তেত্রিশ বছর কেটে গেল, এবার বিচার্য – সত্যিই কি কেউ কথা রাখেনি? যে সব কবির উপস্থিতিতে শক্তির এই প্রশ্ন করা, তাঁদের অনেকে আজ নেই; যারা আছেন, হয় জীবনসায়াহ্নে, নয় তো নিদেনপক্ষে তাঁদের কবিজীবনের মধ্যগগন পার করে। তবু, বর্তমানের কথা বলতে গেলে ইতিহাসে ফিরে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী। তাই, যদি ফিরে তাকাই, দেখি, সে সময় কবিতা লিখছেন শক্তি নিজে, এবং তাঁর পাশাপাশি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, শরৎ মুখোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, প্রমুখ; এবং নতুন স্বরের মধ্যে উঠে আসছেন জয় গোস্বামী, সুবোধ সরকার, ও অন্যান্য নাম। কাব্য এবং কাব্যপ্রতিভার বিকাশের এমন দুর্দান্ত শিখরে দাঁড়িয়ে শক্তির হঠাৎ কবিদের প্রতি এমনতর বিতৃষ্ণা প্রকাশের কারণ অনেকেই খুঁজে পান নি, যার ফলে প্রশ্নের সঙ্গে প্রকাশিত প্রশ্নের কারণগুলিও তাঁদের কাছে সাজানো ‘বর্ম’ বলে মনে হয়, আসল কারণ হয়তো বা কবির ব্যক্তিগত কোনও ক্ষোভ।
এবার বিচার-বিশ্লেষণে আসা যাক। তাঁর নিবন্ধে শক্তি খুব সোজা-সাপটা ভাবেই বলছেন কবিতার ভাষা, লেখনী, আঙ্গিক ও প্রচার নিয়ে। কাজেই, তাঁর মূল প্রশ্নের খুঁটিগুলো প্রশ্নাতীত সাহিত্য সম্বন্ধীয়। শক্তির বিরাগ স্বাভাবিক ভাবেই কবিতার commodification নিয়ে। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, কবিতার মূল্য এখন আর তাঁর গুণগত মানের উপর নির্ভর করে না, বরং তা অনেক বেশি প্রতিষ্ঠান-নির্ভর – কাদের সঙ্গে কবির ওঠাবসা, কারা কবির কবিতা ছাপাচ্ছে, কাদের স্টলে সেই বই পাওয়া যাচ্ছে, ইত্যাদি। একেবারে সরাসরি উল্লেখ করছেন ‘দেশ’ পত্রিকার, যা তখন (এবং এখনও) কবিতার কৌলীন্য নির্ধারণের মাপকাঠি। কবিতার এই বাজার ক্রমশই থাবা বসাচ্ছে কবিতার ভাষায়, আঙ্গিকে। কবিতার ভাষা নিয়ে শক্তি যখন কথা বলেন, কবিতার কৌলীন্যে তাঁর বিশ্বাসও প্রকাশ পায়, তবে তা গুণগত কৌলীন্য – যে কারণে শক্তি নিজের কবিতাকে ‘পদ্য’ বলেন, অন্যান্য ‘সহজলভ্য’ কবিতার থেকে আলাদা করে। আলাদা কোথায়? তার বক্তব্যে? তার ভাষায়? তার রূপকে? আসলে শক্তির পদ্য আলাদা সাধনায়। কবি মানেই “গদ্যের ঘাড় মটকে কবিতা আদায়” করা নয়, কবি মানে নিয়ত অনুশীলনের মাধ্যমে আরও, আরও, আরও ‘হয়ে ওঠা’। ২০১৪ সালে ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে শঙ্খ ঘোষ ‘সমর সেন স্মারক বক্তৃতা’য় বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘হওয়ার দুঃখ’। সমগ্র জীবন জুড়ে কিভাবে রবীন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথতর’ হয়ে উঠলেন, এবং তাঁর সেই হয়ে ওঠা যে জীবনের শেষ দিন অব্দি থামল না, সে কথাই বলছিলেন শঙ্খবাবু। একজন শিল্পীর, এবং তাঁর শিল্পের অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র এই হয়ে ওঠার সাধনায়। তাঁর বহুমাত্রিক জিনিয়াস কখনও মুহূর্তযাপনের উপর নির্ভর করে থাকতে পারে না, কারণ শিল্প, জীবনের মতোই, সমগ্র। লক্ষ-কোটি টুকরোয় ভেঙে সে শিল্পীর সামনে এসে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু তাকে পূর্ণ নান্দনিকতা দেবেন সেই শিল্পী, সজ্ঞান চেতনার মাধ্যমে। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের যে কাব্যদর্শন, সেখানে তিনি কখনও কবিতাকে বলছেন “spontaneous overflow of powerful feelings”, আবার কখনও বলছেন “emotions recollected in tranquility”, এবং সেই সূত্রে যা কিছু একধরনের কাব্যিক free will বা poetic license-এর জন্ম দিচ্ছে, শক্তি তার সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থিত – “কবিদের অত বিহ্বল হলে চলে না। ... বক্তব্য যত মহান হোক, আমরা সবাই কবিতার নির্মাণের কাছেও বেশ খানিকটা দায়বদ্ধ।”
এই কবিতা-নির্মাণই হল হয়ে ওঠার একটি অংশ, এক ধরণের অনুশীলন। সে কথা বলতে গিয়ে শক্তি ‘এত কবি কেন?’ লেখাটিতেই বলছেন, “আমার কাছে যদি কোনও তরুণ কবি আসে, লেখা দেখায়, আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে শেক্সপীয়রের সনেট অনুবাদ করতে বলি। বলি, বেশ কিছুকাল কর, তারপর অনুবাদগুলো নিয়ে আমার কাছে এস। নিজস্ব কবিতা পরে লিখবে।” এবং এর পরেই প্রচণ্ড হতাশায় বলছেন, “আমি এখনও সেই তরুণের প্রতীক্ষায় আছি যে অনুবাদ নিয়ে আসবে।” একইসঙ্গে উল্লিখিত হচ্ছে তাঁর প্রিয় বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গও, “সুনীল কবিতার যত বড় পৃষ্ঠপোষক, তত বড় শত্রু”। কারণ? “সহনশীলতা আর সম্পাদকীয়তা ওর রক্তে। ও ঘষে-মেজে সেই তরুণের (যাকে শক্তি শেক্সপীয়র অনুবাদ করার অনুশীলন দিয়েছিলেন নিজস্ব কবিতা লেখা থামিয়ে) একটি কবিতা ‘দেশ’-এ ছেপে দেয়। হয়তো বছরে ওই একটিই প্রকাশিত হল। সেই তরুণ কিন্তু হয়ে উঠল জবরদস্ত কবি।” এখান থেকে বোঝা বেশ সহজ নয় কি যে কবির তীব্র প্রশ্নের উৎস কোন ঘটনাক্রম? কোনোরকম অনুশীলন, অভ্যেস ছাড়া হাজার হাজার পত্রপত্রিকায় অনবরত প্রকাশিত হয়ে চলেছে প্রায় সমসংখ্যক ‘প্রতিশ্রুতিবান’, ‘উদীয়মান’, ‘তরুণ’ কবির লেখা। তাঁরা কবিতা লেখেন – পয়ারে নয়, “এক ধরণের ভাঙচুরময় গদ্যে”। এককালে ‘আরও কবিতা পড়ুন’ আন্দোলনে মানুষের মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া কবিতা শেষ অব্দি বাজারের সামগ্রী হয়ে উঠবে, তাঁর গুণগত মান হারিয়ে ফেলে সে হয়ে উঠবে ব্র্যান্ড-সর্বস্ব একটি ‘প্রোডাক্ট’, তাঁর নিরিখেই কবির বক্তব্য, “এখনকার কবিদের দেখি আর দুঃখ হয় এজন্যে যে ‘দেশে’ একবার অন্তত প্রকাশিত হতে পারলে তারা কৃতকৃতার্থ বোধ করে। এমন লালচ দেখে আমার ঘেন্না হয়”। এরই সার্বিক মূল্যায়নে বোধ করি তাঁর প্রশ্ন, “এত কবি কেন? কবিতা লিখে ফেলা আপাতত সহজ বলে?”
বর্তমান সময়ের কথায় আসি। তর্কের খাতিরে ধরে নিই যদি শক্তি তাঁর মূল্যায়নে অত্যধিক কঠোর ও ভুল ছিলেন, তাহলে প্রশ্ন – তৎকালীন ‘দেশ’-স্নেহধন্য কবিদল আজ কোথায়? আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়া-সর্বস্ব যুগে, ঠাণ্ডাঘরে কবিতাপাঠের দিনে, যেখানে কবিতা আমাদের আরও বেশি ভাবে ‘কাছের’ হয়ে উঠছে, সেখানে প্রথম সারির পূর্বসুরীদের অনুশীলনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে না কেন? ব্র্যান্ড, প্রেডিক্টেবিলিটি আর মিডিওক্রিটির যুগে উত্তরসুরীদের জন্য কোন কাব্যভাষা রেখে যাওয়া হচ্ছে, যেমন শক্তি বা শঙ্খ রেখেছেন তাঁদের উত্তর-প্রজন্মের জন্য? বোধের, পাঠের কি এমনই দৈন্য এসে উপস্থিত হয়েছে যে কাব্যনির্মাণ আর stylization-এ গুলিয়ে ফেলছি আমরা? কিছু লোক-নাচানো, মুখরোচক শব্দ/ ক্যাচলাইন ব্যবহার করা বা ছন্দ ও মিল রাখতে পারা নিশ্চয়ই কবি হয়ে ওঠার সমার্থক নয়? কাজেই, প্রশ্নটি কি থেকেই যায় না, যে এখনকার কারিগরেরা কবিতাকে ‘নতুন ভাষা’র মোড়কে ক্রমশই ম্যাকডোনাল্ড কালচারের অংশ করে তুলছেন? সেই অস্পষ্ট ভাঙাচোরা গদ্যে লিখে ‘পোস্টমডার্নিজম্’-এর আড়ালে কি কাঁচকলাই দেখানো হচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে? আমরা যারা কবিতা লিখি, কখনও সখনও যদি আজকের শহর কলকাতার কবিতা-মনস্কতার দিকে মুখ তুলে তাকাই, দেখি – কবিতার উত্তর হয় উদাসীনতা, নয় স্তাবকতা, অন্ধ প্রশংসা, নয় ব্যক্তিগত আক্রমণ। আমরা কি তাহলে কবিতা, এবং বৃহদর্থে শিল্পের সমালোচনা করতেও ভুলে গেলাম? সমালোচনা মানেই কি দাঁতনখ বার করা জান্তব অভিবাদন? সমালোচনা মানে গভীর বিশ্লেষণ নয়? ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বলা নয়? প্রসঙ্গত, এই নিবন্ধেই শক্তি আরও বলেছিলেন, “কবিতা লেখা ছেড়ে কবিতার সমালোচক হিসেবে জায়গা করে নাও। তাতে উপকার হবে।”