উচ্চপদস্থ সেনা-অফিসার থেকে ভারতবিশারদ : কর্নেল জেমস টড
অনেকেরই পেশা আর নেশার মধ্যে কয়েক সহস্র আলোকবর্ষের দূরত্ব হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ কেউ চমৎকারভাবে দুই বিপরীত মেরুকে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলতে পারেন। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের এমনই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র কর্নেল জেমস টড। পেশায় ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর কূটনীতিক, কিন্তু বিশেষ আগ্রহ ছিল ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাকাহিনিতে। পেশাগত সুবিধেকে কাজে লাগিয়ে তিনি শুধু নিজের শখপূরণ করেননি, ভাবীকালের জন্য রেখে গেছেন বেশ কিছু মহামূল্যবান পুরাতাত্ত্বিক কাজ।
১৭৮২ সালে লন্ডনে জন্ম। ১৭৯৯ সালে বাংলাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনিতে যোগ দেন এবং পরের বছরই চতুর্দশ বেঙ্গল ইনফ্যানট্রিতে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। পরবর্তী দীর্ঘ সতেরো-আঠেরো বছর ধরে তিনি বিভিন্ন ভৌগোলিক সমীক্ষা ও মানচিত্র তৈরির কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তাঁর সমীক্ষকেরা তাঁর জন্য প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে আনতেন। ১৮১৩ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ১৮১৫ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসকে যে মানচিত্র তৈরি করে দেন, তাতে দেশীয় রাজ্যগুলিকে তিনি একসঙ্গে ‘Central India’ নামে উল্লেখ করেছিলেন। ছিন্নবিচ্ছিন্ন প্রদেশগুলিকে এভাবে একসঙ্গে একটি নামের ছত্রছায়ায় উল্লেখ করার ঘটনা এই প্রথম।
১৮১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার পিণ্ডারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলে টডকে গুপ্তচর বাহিনির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই অভিযানে ব্রিটিশ বাহিনির জয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিলেন। পরের বছর তাঁকে পশ্চিম রাজস্থানের রাজ্যগুলির পলিটিকাল এজেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর কিছু সংঘাত তৈরি হয়। প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিযোগ এনে চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকে। তারপর অসুস্থতার অজুহাত খাড়া করে ১৮২২ সালে তাঁকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়।
কিন্তু ভারতের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে না থাকলেও টড আরও বছর তিনেক মাতৃভূমির সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি ইংল্যান্ড ফিরে যান এবং ১৮২৫ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে কাজ থেকে অবসর নেন। ভারতে থাকাকালীনই তিনি লিখে ফেলেছিলেন ‘Travel in Western India’ নামে একটি বই (বইটি প্রকাশ পায় ১৮৩৯ সালে, তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর)। অবসরের পর পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন পুরাতত্ত্বে। ভারতে সংগৃহিত তথ্যাবলি অতি যত্নে তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। সেসব গুছিয়ে বেশ কয়েকটি ভাষণ দেন। এরপর রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তাঁর বেশ কিছু কাজ গ্রন্থাকারে পরিবেশিত হয়। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা দুই খণ্ডে লেখা ‘Annals and Antiquities of Rajasthan, or the Central and Western Rajpoot States of India’। প্রথম খণ্ড বেরোয় ১৮২৯ সালে, দ্বিতীয়টি ১৮৩২। এই গ্রন্থে তিনি রাজপুতানার রাজবংশগুলির বহু কাহিনি সংগ্রহ করেছিলেন। মধুসূদন দত্তের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ট্রাজেডি ‘কৃষ্ণকুমারী’-র কাহিনিসূত্র টডের এই বই থেকে নেওয়া। এছাড়া রমেশচন্দ্র দত্তের দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একাধিক ঐতিহাসিক নাটক সহ আরও বেশ কিছু বাংলা রচনার মূল কাহিনি-উৎসও এই বইটিই। কর্নেল টডের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘Comments on an Inscription upon Marble, at Madhucarghar, And Three Grants Inscribed on Copper, Found at Ujjayani’ (১৮২৬), ‘On the Religious Establishments of Mewar’ (১৮২৯), ‘An Account of Greek, Parthian and Hindu Medals, Found in India’ (১৯২৬), ‘Remarks on Certain Sculptures in the Cave temples of Ellora’ (১৮২৯), ‘Observations on a Gold Ring of Hindu Fabrication found at Montrose in Scotland’ (১৯৩০), ‘Comparison of the Hindu and Theban Hercules, illustrated by an ancient Hindu Intaglio’ (১৯৩১) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে ‘Annals and Antiquities of Rajasthan...’ এর জন্যই প্রধানত তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
শেষজীবনে বইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি কিছুদিন রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিতে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ১৯৩৫ সালে আচমকা অ্যাপোপ্লেক্সি-র আক্রমণে তিনি অশক্ত হয়ে পড়েন এবং মারা যান।
#Colonel #Lieutenant-Colonel # British East India Company # Oriental scholar #প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ #ভারতবিশারদ #জেমস টড #টিম সিলি পয়েন্ট #ব্যক্তিত্ব #James Todd #Annals and Antiquities of Rajasthan