স্ক্রিম (২০১৬): যুক্তরাষ্ট্র, যুবসমাজ ও জিঘাংসা
ওয়েব সিরিজ: স্ক্রিমনির্মাতা: জিল ব্লটভোগেল, ড্যান ডোয়ার্কিন, জে বিটি, ব্রেট ম্যাথুজশ্রেষ্ঠাংশে: উইলা ফিটজেরাল্ড, কার্লসন ইয়ং, বেক্স টেলর ক্লজ, জন কার্না, টম ম্যাডেন প্রমুখ
চুম্বনোদ্যত প্রেমিক টাইলারকে নিরস্ত করে গাড়ি থেকে নেমে আসে নিনা, বিলাসবহুল গৃহে প্রবেশের পর ভয়েস কম্যান্ডে চালু করে স্বয়ংক্রিয় মিউজিক সিস্টেম। সুইমিং পুলে নামবার পূর্বমুহূর্তে তার টেলিফোনে ভেসে আসে অচেনা কণ্ঠস্বর, “হ্যালো নিনা, আমার সঙ্গে খেলবে?” অবিলম্বে তার কোলের উপর আছড়ে পড়ে টাইলারের রক্তাক্ত মাথা, ভালো করে আর্তনাদ করে ওঠার আগেই অতর্কিতে অজানা আততায়ীর ঝলসে ওঠা ছুরি এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় নিনাকে।
যে কোনও পরিচিত স্ল্যাশার ছবির মতোই শুরু হয় ‘স্ক্রিম’, ওয়েস ক্র্যাভেন ও কেভিন উইলিয়ামসনের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সিরিজ অবলম্বনে নির্মিত নেটফ্লিক্সের ওয়েব সিরিজ। আলফ্রেড হিচককের সাইকো, রেয়ার উইন্ডো প্রভৃতি কিংবদন্তি ছবির প্রভাবে গড়ে ওঠা মার্কিন চলচ্চিত্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপধারা এই স্ল্যাশার ছবি। সমালোচকদের কুলীন সমাজে বিশেষ পাত্তা না পেলেও সত্তর ও আশির দশক থেকে স্ল্যাশার ছবির ধারাবাহিক জনপ্রিয়তা দেখে বোঝা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সমসাময়িক সমাজের অত্যন্ত বাস্তব কিছু দিক তুলে ধরছে এই ছবিগুলি। যৌনমিলনে লিপ্ত তরুণ তরুণীদের অকস্মাৎ আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার অতিপরিচিত মুহূর্তে দর্শকের গোপন সুখানুভূতি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, আমেরিকার প্রথমদিকের ইতিহাসে বিশুদ্ধবাদী প্রোটেস্টান্ট সমাজের যৌনতা সম্বন্ধে যে প্রবল ছুৎমার্গ ছিল, তার রেশ এখনও কোথাও রয়ে গিয়েছে মার্কিন মননে। আরেকটি যে বিষয় বারেবারেই উঠে আসে, তা হল ধনতান্ত্রিক স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে ব্যস্ত স্বার্থসর্বস্ব পরিণতবয়স্ক আমেরিকানদের যুবসমাজের প্রতি অবহেলার সমস্যা। টেক্সাস চেইনস ম্যাসাকার, আই নো হোয়াট ইউ ডিড লাস্ট সামার, হাউস অফ ওয়াক্স প্রভৃতি একাধিক স্ল্যাশার ছবিতে দেখা যায়, হাইস্কুলে পাঠরত একাধিক তরুণ তরুণী ছুটি কাটানোর নামে উচ্ছৃঙ্খল আচরণে লিপ্ত হয়, তাদের অসতর্কতার সুযোগে অতর্কিতে হামলা চালায় কোনো রহস্যময় হত্যাকারী। বস্তুত এই কাহিনিক্রম সমসাময়িক মার্কিন সমাজের দুটি গভীর আশঙ্কার প্রতি নির্দেশ করে- অত্যধিক বৈষয়িক স্বাচ্ছন্দ্য ও যথাযথ শাসনের অভাবে যুবসমাজের ক্রমবর্ধমান উচ্ছৃঙ্খলতা ও মানসিক বিকৃতি, এবং নব্য ধনতন্ত্রের সুখ থেকে বঞ্চিত জনগণের সম্ভাব্য প্রতিশোধপরায়ণতা, যেহেতু এই ধরনের একাধিক ছবিতে হত্যাকারীকে অনেক সময়েই প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হয়।
ওয়েস ক্র্যাভেনের স্ক্রিম প্রকৃতপক্ষে একটি উত্তরাধুনিক শিল্পকর্ম, যেখানে আততায়ীদের মোটিভ হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক বিকারের সঙ্গে তাদের অতিরিক্ত স্ল্যাশার ছবি দেখবার প্রবণতাকেও দায়ী করা হয়। এ যেন জাঁ বদ্রিলার্ডের দেখানো উত্তরাধুনিক সমাজ, যেখানে অত্যধিক শক্তিশালী গণমাধ্যমের পাল্লায় পড়ে মানুষ প্রকৃত ও কৃত্রিমের পার্থক্য গুলিয়ে ফেলে। এছাড়া উত্তরাধুনিক শিল্পকর্মের নিয়ম মেনে ছবিগুলি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে নানা জনপ্রিয় বই সিনেমা সিরিয়াল প্রভৃতির উল্লেখ, জনমানসে তাদের প্রভাব স্বীকার করে নেবার পাশাপাশি দেদার ঠাট্টাও করা হয়েছে সেগুলি নিয়ে। ‘স্ক্রিম’ সিরিজের মেজাজ তুলনায় অনেকটাই গম্ভীর, তবে সাইকো থেকে শুরু করে গেম অফ থ্রোনস অবধি অসংখ্য জনপ্রিয় শিল্পকর্মের উল্লেখ রয়েছে এখানেও, এবং দুটি সিজনেরই প্রথম এপিসোডের নামকরণ হয়েছে একটি করে বিখ্যাত স্ল্যাশার ছবি অনুসারে- হোয়েন আ স্ট্রেঞ্জার কলস এবং আই নো হোয়াট ইউ ডিড লাস্ট সামার। এছাড়াও স্ল্যাশার ছবির বৈশিষ্ট্য, ছবি ও সিরিজের গঠনগত পার্থক্য ইত্যাদি শিল্পভাবনা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে অবাধে আলোচনা চলতে থাকে সিরিজের চরিত্রদের মধ্যেই। মূল চরিত্রগুলি নির্মিত হয়েছে স্ল্যাশার ছবির চেনা ছক অনুযায়ী- ‘ফাইনাল গার্ল’ এমা ডুভাল, লাস্যময়ী ব্রুক ম্যাডক্স, স্বাস্থ্যবান ক্রীড়ামোদী তরুণ জেক ফিটজেরাল্ড, পুরুষোচিত তরুণী অড্রে জেনসেন এবং ‘গিক’ নোয়া ফস্টার, চলচ্চিত্র সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির খুঁটিনাটি বিষয়ে যার অগাধ জ্ঞান। লক্ষণীয়, উভকামী অড্রের প্রিয় বন্ধু হবার পাশাপাশি মূল চরিত্রগুলির মধ্যে একমাত্র নোয়াই ভিন্নজাতের সঙ্গিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়- প্রথমে এশীয় বংশোদ্ভূত রাইলি ও পরে কৃষ্ণাঙ্গী জোয়ি। কে না জানে, শিক্ষা ও জ্ঞান মনের প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে!
কাহিনির শুরুতে এসেছে ত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কিছু নৃশংস খুনের প্রসঙ্গ, যেগুলির মূলে ছিল ব্র্যান্ডন জেমস নামক ছোট্ট শহর লেকউডের এক বিকলাঙ্গ যুবকের ম্যাগি নামক এক সুন্দরী তরুণীর প্রতি অদম্য আকর্ষণ। পূর্বকাহিনি রোমন্থনের মাধ্যমে বারংবার প্রমাণ করবার চেষ্টা হয়েছে, শারীরিক বিকৃতির কারণে পারিপার্শ্বিক সমাজের নিষ্ঠুর আচরণ কীভাবে ব্র্যান্ডনকে ঠেলে দেয় মানসিক বিকারের দিকে। ম্যাগির কন্যা এমাকে ঘিরে ঘটে চলা একের পর এক নির্মম খুন অনিবার্যভাবে জাগিয়ে তোলে লেকউড শহরের রক্তাক্ত স্মৃতি। হত্যাকাণ্ড প্রদর্শনের পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যুবসমাজের প্রতি মানসিক অবহেলার দিকটি, এমার মা ছাড়া মূল চরিত্রগুলির সবার অভিভাবকরাই হয় অনুপস্থিত, নয়তো তাদের মন বুঝতে শোচনীয়ভাবে অক্ষম। এসেছে হাই স্কুলে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র বা লাজুক ছাত্রছাত্রীদের উত্যক্ত করবার সমস্যাটি, যা মনে পড়িয়ে দেবে অধুনা জনপ্রিয় থার্টিন রিজনস হোয়াই সিরিজটিকে। শিক্ষক ব্র্যানসনের সঙ্গে ব্রুকের শারীরিক সম্পর্ক ব্রুকের মানসিক নিরাপত্তার অভাব এবং শিক্ষাসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়, উভয়ের প্রতিই নির্দেশ করে। হত্যাকারীদের পরিচয় নির্মাণে বিরাট কোনো অভিনবত্ব নেই, স্ল্যাশার ছবির নিয়মিত দর্শকদের কাছে তা মোটেই অপ্রত্যাশিত ঠেকবে না। কিন্তু কাহিনির বিন্যাসটি চমৎকার, দুটি সিজন ব্যাপী তেইশটি এপিসোড ধরে যেভাবে টানটান রহস্যের বাতাবরণ তৈরি করে দর্শকের আগ্রহ জিইয়ে রাখবার প্রচেষ্টা করা হয়েছে তার জন্য নিঃসন্দেহে নির্মাতাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে আই স্টিল নো হোয়াট ইউ ডিড লাস্ট সামার অবলম্বনে নির্মিত দ্বিতীয় সিজনের শেষ এপিসোডটির কোনো প্রয়োজন ছিল না, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি কাহিনির পিছনে ল্যাংবোটের মত তা গুঁজে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় এপিসোডের অন্তিমে এমা যখন বলে ওঠে, “আমি এমা ডুভাল, এবং আত্মরক্ষার জন্য আমার কোনো পুরুষের প্রয়োজন নেই”, আমরা বুঝি এ হল স্ল্যাশার কাহিনির শেষে ফাইনাল গার্লের পরিচিত নারীবাদী নির্ঘোষ। অভিনয়ে প্রত্যেকেই যথাযথ, কিন্তু আলাদা করে বলতে হবে এমার চরিত্রে উইলা ফিটজেরাল্ড ও নোয়ার চরিত্রে জন কার্নার কথা। এছাড়া পার্শ্বচরিত্রদের মধ্যে জোয়ি ভনের চরিত্রে কিয়ানা ব্রাউনের অভিনয়ও মন ছুঁয়ে যায়। অড্রের চরিত্রে অভিনয় করা বেক্স টেলর ক্লজ ব্যক্তিগত জীবনেও উভকামী, আমাদের হিন্দি ছবিতে ফর্সা নায়ককে কৃত্রিমভাবে কালো দেখানো পরিচালকের দল নিঃসন্দেহে এ ঘটনা থেকে অনেক শিক্ষা লাভ করতে পারেন। তবে এমার দ্বিতীয় প্রেমিক কিয়েরানের চরিত্রে অ্যামেদিউস সেরাফিনি বড্ড আড়ষ্ট, সুন্দর চেহারা দিয়েই বাজিমাত করবার চেষ্টা করেছেন তিনি। প্রশংসা করতে হবে সঙ্গীত পরিচালক জেরেমি জাকারম্যানের, কাহিনির পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নির্বাচন করা বিভিন্ন গান আলাদা মাত্রা দিয়েছে অনুষ্ঠানটিকে। এমটিভি চ্যানেলে সম্প্রসারিত হবার কারণেই সম্ভবত এই সিরিজে সঙ্গীতের ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিজয় নাম্বিয়ারের শয়তান, রিচি মেহতার ডেলহি ক্রাইম প্রভৃতির সাম্প্রতিক সাফল্যের কথা মাথায় রেখে বলা যায়, মার্কিন সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে ভারতীয় সমাজে স্ল্যাশার জাতীয় কাহিনির প্রাসঙ্গিকতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কে বলতে পারে, হয়তো খুব অল্পদিনের মধ্যেই আমরা যথার্থ একখানা ভারতীয় স্ল্যাশার ছবি বা সিরিজ পেতে চলেছি!
#Scream #Web Series #Netflix #Kevin Williamson # Jill Blotevogel #Dan Dworkin #Brett Matthews # Willa Fitzgerald #Bex Taylor-Klaus #John Karna #Amadeus Serafini #Review #Wes Craven #Jay Beattie #ওয়েব সিরিজ #নেটফ্লিক্স #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য