গল্প

সনাতন হেমব্রম

রোহন রায় Aug 9, 2020 at 6:42 am গল্প

- রাস্তাঘাট কেমন ফর্সা দেখছ?
- সত্যি। ভাবা যায় না। একেবারে কুমারী মেয়ের সিঁথির মতো।
- পেলবান্টু, ট্রপোস্ফিয়ারে ঢোকামাত্র তোমার রুচিবোধ গোড়ালিতে নেমে যায়। ফারদার আমার সামনে এসব মিসোজিনিস্ট উপমা ইউজ করবে না।
- সরি সরি। আসলে পৃথিবীর জলহাওয়াটা এত টক্সিক। মনটা কেমন তলতলে হয়ে যায়।
- কিন্তু এতদিনে ইউ শ্যুড হ্যাভ বিন টোটালি ইমিউন টু দিজ। আর কাউকে নিয়ে তো প্রবলেম হয় না। তোমাকে নিয়েই কেন বারবার এই এক প্রবলেম হয় বলো তো?
- সরি বললাম তো। আচ্ছা ওইখানে অতগুলো লোক মিলে কী করছে?
- তাই তো। জুম করো দেখি।
- বাজার মনে হচ্ছে?
- হ্যাঁ। মানিকতলা বাজার।
- এই ভয়ংকর সংক্রমণের মধ্যে অতগুলো লোক জড়ো হয়েছে? লোকগুলো ঘাড়ের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
- সত্যি! এই নাকি এদের লকডাউন!
- ওরা কি বুঝতে পারছে না, নাকি ওদের ভয়ডর বলে কিছু নেই?
- দুটোই। প্রথমটা থেকেই তো দ্বিতীয়টা আসে।
- কানকো টিপে মাছ কিনছে। আক্কেল দ্যাখো।
- আক্কেল দেখে কাজ নেই। জিপিএস দ্যাখো। মেদিনীপুরের দিকে যেতে কিন্তু কয়েকটা বিচ্ছিরি টাইপের এয়ার পকেট আছে। সামলে চালাবে।
- আচ্ছা বুমচাক, ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছে না? সনাতনবাবু যদি ইতিমধ্যে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন?
- সাতকাণ্ড রামায়ণ, সীতা কার ভায়রাভাই? তোমায় দেখে হতাশ লাগে মাঝে মাঝে।
- বলো না। বুঝতে পারছি না বলেই তো জিগ্যেস করছি।
- আমাদের ইন্টেলিজেন্স অলরেডি চেক করে গ্রিন সিগনাল দিয়েছে। ওইদিকে এখনও সংক্রমণ হয়নি।
- ও। আচ্ছা, সনাতনবাবু যদি আমাদের সঙ্গে আসতে না চান?
- বলপ্রয়োগ করতে হবে। সঙ্গে একদল মিলিটারি কেন দিয়েছে? শোনো ব্রাদার, সনাতন হেমব্রম ইজ দ্য মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন ইন আওয়ার প্ল্যানেট রাইট নাউ। তাঁকে নিয়ে যেতেই হবে। আর কোনও অপশন নেই। আমাদের গ্রহে এই ভাইরাসের সংক্রমণ হতে তো বেশি দেরি নেই। এখন থেকেই তৈরি থাকতে হবে।
- বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না। এত বড় বিজ্ঞানী ইউরোপ বা আমেরিকায় বা নিদেনপক্ষে কলকাতায় না থেকে মেদিনীপুরে কেন থাকেন?
- কে বিজ্ঞানী?
- সনাতন হেমব্রম, আবার কে? তার কথাই তো হচ্ছে।
- সনাতন হেমব্রম বিজ্ঞানী কে বলল তোমায়?
- কেন? সনাতন হেমব্রম করোনার টিকা বের করছেন না? ১৫ আগস্ট?
- কোথাকার হরিপদ তুমি? পরশু কী বললাম?
- ইয়ে... মেমারি ডিস্কটা কাল কেচেকুচে রোদে দিয়েছিলাম। সেই থেকে বোধহয় একটু গণ্ডগোল করছে।
- তুমি একটা টোটাল মেস। সনাতন হেমব্রম কেন করোনার টিকা বের করতে যাবে?
- যাত্তারা! আমি তো তাই ভেবে বসে আছি। তাহলে সনাতন হেমব্রম কে?
- সনাতন হেমব্রম একজন রসুয়ে।
- রসুয়ে কী?
- মানে রান্নার ঠাকুর। নিজস্ব ক্যাটারারও আছে ওঁর। মা নাচিন্দা ক্যাটারার।
- রান্নার ঠাকুর দিয়ে আমরা কী করব?
- উফফ! সবটা আবার গোড়া থেকে বলতে হবে। আচ্ছা বলো দেখি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার কোনটা, যা কিছুদিন আগে আমরা আমাদের জাতীয় খাবার করেছি? মনে আছে?
- খাসির মাংস।
- যাক। সব তার কাটেনি। শোনো, পৃথিবীতে যিনি সবচেয়ে ভালো খাসির মাংস রাঁধেন তিনি সনাতন হেমব্রম।
- অ্যাঁ!
- ইয়েস। দীর্ঘ ছ’মাসের নিবিড় গবেষণার ফলে সনাতন হেমব্রমের নাম বেরিয়েছে।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
- এতে না বোঝার কী আছে? পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়ারি ব্লকের সুতারহাট গ্রামের সনাতন হেমব্রম হচ্ছেন এ ধরাধামে খাসির মাংসের শ্রেষ্ঠ রূপকার।
- তো আমরা ওঁকে নিয়ে যাচ্ছি কেন?
- তিন বছরের মাথায় আমাদের গ্রহে করোনা সংক্রমণ হবে মনে আছে, নাকি সেটাও ভুলে মেরে দিয়েছ?
- মনে আছে মনে আছে।
- এটা কি মনে আছে যে আসন্ন সেই অ্যাপোক্যালিপ্সে আমাদের বাঁচার আশা নেই বললেই চলে?
- একেবারেই কি নেই?
- এই বেসিক জিনিসগুলো যদি এতদিন পর কাউকে বলতে হয়, কিছু বলার নেই।
- ডিস্কটা গণ্ডগোল করছে বলেই...।
- পৃথিবীর জীবের তুলনায় আমরা অনেক বেশি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর বলে আমাদের নিজস্ব ইমিউনিটি খুবই দুর্বল। ফলে খুব মিরাকল কিছু না ঘটলে আমরা সারভাইভ করতে পারব না।
- বুঝতে পারছি। কিন্তু তাহলে সনাতন হেমব্রমকে নিয়ে আমাদের কাজ কী?
- তুমি এমনিতে তিলেখচ্চর হলে কী হবে, কিছু কিছু ব্যাপারে একেবারে ল্যাংটো শিশুর মতো সরল। ট্যাবলেট আর সলিউশন ছেড়ে আমরা এখন ন্যাচারাল খাবার খাওয়া অভ্যেস করছি কেন? পুঁইশাক, চালকুমড়ো, পোস্ত এসব পৃথিবী থেকে কেন আমদানি করছি আমরা?
- হার্ড ইমিউনিটির জন্য?
- ধুর মড়া! হার্ড ইমিউনিটি আমাদের জন্য বামন হয়ে চাঁদ ধরার মতো ব্যাপার। ওসব আমাদের জন্য নয়। আমরা মরছি এটা একরকম নিশ্চিত। আর মরছি যখন নিশ্চিত, তখন তো মনখারাপ করার কোনও জায়গাই নেই। যেটুকু সময় পড়ে আছে তাতে মনখারাপ করাটা বিলাসিতা। বুঝতে পারছ কী বলছি?
- সেলিব্রেশন অব লাইফ?
- যাক, কিছু ঘিলু এখনও বেঁচে আছে। আর সেরা সেলিব্রেশন কী?
- খাওয়াদাওয়া?
- নট খাওয়াদাওয়া। ওরকম গোদা শব্দ ব্যবহার কোরো না। ইটস রন্ধনশিল্প। ইটস আ ক্রাফট। এই একটা জিনিসই তো মহাবিশ্বকে মানুষের শ্রেষ্ঠ দান। এই একটা কারণেই তো মানুষের মতো গাছহারামি একটা জাত ইতিহাসে অমর হয়ে থেকে যাবে।
- কারেক্ট। এবার সব জলের মতো বুঝতে পারছি।
- এবার নিয়তিকে যখন স্পষ্ট দেখতেই পাচ্ছি, তখন তো দ্বিধার কোনও কারণই নেই। মরবই যখন ভালোমন্দ খেয়ে মরব। এটাই তো এখন আমাদের গভর্নমেন্ট পলিসি। প্রেসিডেন্ট ডবাংডুলুর সেদিনের সাংবাদিক সম্মেলনটা মনে নেই? কী বললেন উনি? শেষের কদিন ক্রেনিয়াসের সবাই মিলে একসাথে রান্নাবান্না হবে, একসাথে খাওয়াদাওয়া হবে। গরম ভাত, পাঁঠার মাংস, আর আমের চাটনি। উফফ! ভাবলেই জিভটা কেমন ভিজে যাচ্ছে। এই দ্যাখো। এসে গেছি। জুম করো দেখি, ভদ্রলোক কী করছেন। এ মা!
- হাগছেন। একটু অপেক্ষা করি তাহলে?
- না তো কী? মাঝপথে তুলে নেবে নাকি? এমন ক্যালানের মতো প্রশ্ন করো না, গা-পিত্তি জ্বলে যায়!
- সরি সরি। কিন্তু বুমচাক, এটা কি আনএথিকাল নয়? পৃথিবীকে সনাতন হেমব্রম থেকে বঞ্চিত করা কি উচিত হবে?
- পৃথিবীতে গুণী মানুষের কদর কজন দেয় হে?
- তা ঠিক। কদর দিতে জানলে কি সনাতন হেমব্রম মেদিনীপুরে পড়ে থাকেন? এতদিনে তাঁর মিয়ামি চলে যাবার কথা।
- সেটা বলিনি। কদর পাওয়া মানেই আমেরিকা চলে যাওয়া নয় পেলবান্টু। ট্রপোস্ফিয়ারে ঢুকলেই দেখি তুমি পুঁজিবাদের পোষা ডালকুত্তা হয়ে যাও। আমি বলতে চাইছি, পৃথিবীতে সনাতন হেমব্রমের মতো একজন ব্যক্তিত্বের যথেষ্ট কদর হওয়া কোনও দিনই সম্ভব নয়।
- কেন?
- যে গ্রহে সেভেন্টি পারসেন্ট মানুষ খালি পেটে শুতে যায়, সেখানে আর যাই হোক, সনাতন হেমব্রম মানায় না।



[লেখকের কথা : শ্রীমতী সুচরিতা বসুর লকডাউন বিষয়ক একটি গল্প পড়ে খাদ্যরসনা নিয়ে কিছু লেখার কথা ভেবেছিলাম। সেই প্রেরণা থেকেই এ গল্প লেখা। এতদ্বারা শ্রীমতীকে জানাব বলে অপেক্ষা করছিলাম। আশা করি তিনি অপরাধ নেবেন না। নিলেও বা কী! :)]

[অলংকরণ : অভীক।]

#গল্প #লকডাউন #আহ্নিক বসু

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

56

Unique Visitors

181977