কলকাতার রয়্যাল সোসাইটি
১৯০৭ সালের আগস্ট মাস। বৌবাজার দিয়ে ট্রামে করে সেদিন রোজকার মতো অফিস যাচ্ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় এক সরকারি অফিসার। পদার্থবিদ্যার স্নাতক উনিশ বছরের এই যুবা সদ্যই চাকরি পেয়েছেন অর্থ-বিভাগে। ট্রামের জানলা দিয়ে সেদিন তাঁর চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড, যেটা পড়ে তাঁর মনে রয়ে গেল ব্যাপারটা। অফিস থেকে সেদিন ফেরার পথে তিনি সেই জায়গায় নেমে গেলেন ট্রাম থেকে। যে বাড়িটির গায়ে সাইনবোর্ডটি লাগানো, সেখানে গিয়ে দেখলেন এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি টেবিল-চেয়ার পেতে একাই বসে আছেন।
প্রতিষ্ঠানটি ওই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির প্রয়াত বাবা তৈরি করেছিলেন বছর একত্রিশ বছর আগে। মানুষের কাছে তখনও খুব বেশি পরিচিত নাম নয় প্রতিষ্ঠানটি। খুব একটা কেউ আসে না, নিয়মরক্ষার মতো করেই চলছে যেন, বিরাট বাড়িতে হরেকরকমের যন্ত্রপাতিগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে। উনিশের যুবকটির সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগে গেল মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির, যাঁর নাম অমৃতলাল সরকার। তিনি দু’হাত বাড়িয়ে বললেন, এসো হে, এতদিন তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
১৪১ ফুট লম্বা আর ৬৬ ফুট চওড়া ল্যাবরেটরিতে দিন কয়েক পর থেকেই কাজে লেগে গেলেন যুবকটি। বিজ্ঞানের গবেষণা করবার নেশা তাঁর ছিলই, আর বাড়িটিতে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি সাজানোও ছিল; আরও অনেক যন্ত্রপাতি কেনা হল এবং অফিস সেরে প্রায় রোজই তিনি এখানে আসতে লাগলেন, সন্ধে গড়িয়ে রাত হলে বাড়ি ফেরাও চলতে লাগল। আস্তে আস্তে তরুণটির পরিচিতি বাড়ল, আরও বছর দশেক পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য স্থাপিত বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক হলেন; আর রোজ সকাল-বিকেলে এসে গবেষণা করতে লাগলেন বৌবাজারে।
যুবকটি বেশ কয়েক বছর পর তাঁর পরিশ্রমের ফসল পেয়েছিলেন অবশ্যই, আর প্রতিষ্ঠানটিও এক ধাক্কায় পরিচিতি পেয়ে গেল বিশ্ব জুড়ে। ১৯৩০ সালে তিনি নির্বাচিত হলেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য। বিষয়? বছর দুই আগে তাঁরই নামে আবিষ্কৃত আলোকতরঙ্গের বিশেষ এক ধর্ম, যেটা তাঁর নামেই পরিচিতি পেল— ‘রামন এফেক্ট’।
সেদিন সেই তরুণটি, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরামন ট্রামে বসে ওদিন ওই সাইনবোর্ড না দেখতে পেলে আরও কতদিন লাগত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ (বা সংক্ষেপে ‘আইএসিএস’)-কে বিখ্যাত হতে? বলা খুবই মুশকিল।
‘আইএসিএস’ তৈরির বছর সাতাশ বছর পরে মৃত্যু হয় এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ওই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটির বাবা মহেন্দ্রলাল সরকারের (১৮৩৩-১৯০৪)। শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ড এবং কিছু কথা অনেকেই জানেন ‘প্রথম আলো’র কল্যাণে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে অনেক কষ্ট পেয়ে রামকৃষ্ণ যখন প্রয়াত হন ১৮৮৬ সালে, তার ন’বছর আগে কলকাতার বিশিষ্ট এই হোমিওপ্যাথির ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার তৈরি করে ফেলেছেন কলকাতার, না শুধু কলকাতার না, ভারতের প্রথম সত্যিকারের বিজ্ঞান-গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান-সভা, যার ফর্ম্যাল নাম ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’। প্রতিষ্ঠা-তারিখ ২৯ জুলাই, ১৮৭৬। ভারতের বিজ্ঞানচর্চায় সে এক একটি উজ্জ্বল দিন।
তৈরির আগে প্রায় বছর পাঁচেক ধরে তিনি চাঁদা সংগ্রহে এবং মানুষকে বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা বোঝাবার কাজে মন দিয়েছিলেন। প্রথম পাঁচ বছরে ওঠে আশি হাজার টাকা। মহেন্দ্রলাল একাই এর প্রচারের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম শুরু করেছিলেন। দেশীয় জমিদারদের কাছ থেকেই বেশিরভাগ অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি। ২১০ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটের আদি ঠিকানায় (এখন সেখানে গোয়েঙ্কা কলেজ অব কমার্স। পঞ্চাশের দশকে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান ঠিকানা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে উঠে আসে) প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানচর্চার জয়যাত্রা শুরু হয়। বছর চারেক পরে বাড়ি আর জমি সংস্থার নিজস্ব হিসেবে ক্রয় করা সম্ভব হয়।
জমি-বাড়ি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা, বইপত্র সংগ্রহ, লেকচার হল তৈরি ইত্যাদি প্রায় সমস্ত কাজ মহেন্দ্রলালকে একাই করতে হয়েছিল। সন্ধের দিকে বক্তারা আসতেন, আর অল্প কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে যে কেউ শুনতে পারতেন তাঁদের বক্তৃতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা অনেকেই উৎসাহ নিয়ে আসত প্রথমদিকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উঁচু ক্লাসে বিজ্ঞানশিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় আস্তে আস্তে ছাত্রদের উৎসাহ কমে আসতে থাকে। তবু মহেন্দ্রলাল একা কুম্ভের মতো এই প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তৈরির বছর কয়েক পরে বাড়িটি জীর্ণদশাপ্রাপ্ত হলে ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজার আনুকূল্যে নতুন এক গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি তৈরি সম্ভব হয়, তাঁর নামেই এই ল্যাবের নামকরণ করা হয়।
তৈরির পর প্রথম প্রায় বছর কুড়ি এখানে নিয়মিত বক্তৃতা দিতেন মহেন্দ্রলাল নিজে, তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করতেন ফাদার ইউজিন লাফোঁ। ফাদার লাফোঁ ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক, তাঁকেই মহেন্দ্রলাল জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বক্তৃতার জন্য নির্দিষ্ট করেন। তাঁদের দেখে উৎসাহিত হয়ে বেশ কয়েকজন নব্য তরুণ এখানে বছর কয়েক উৎসাহের সঙ্গে এসে বক্তৃতা বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে শুরুতেই আসে পদার্থবিদ্যার জগদীশচন্দ্র বসু, মহেন্দ্রনাথ রায়, শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়; গণিতের আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রসায়নের কানাইলাল দে, রামচন্দ্র দত্ত; ভূবিদ্যার প্রমথনাথ বসুর নাম। জীববিদ্যার ক্লাস নিতেন মহেন্দ্রলাল স্বয়ং।
শুরুর দিকে ছাত্রসংখ্যা হত মোটামুটি পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে, বছর পনেরো বাদে সংখ্যাসীমাটা দাঁড়ায় দুইশোর কাছাকাছি। তবে একটাই দুঃখের ব্যাপার, মহেন্দ্রলাল অনেক চেষ্টা করেও এখানে স্থায়ী কোনও অধ্যাপককে নিযুক্ত করতে পারেননি অর্থাভাবে।
জীবনের শেষদিকে একাধিক বক্তৃতায় মহেন্দ্রলাল তাঁর এই প্রচেষ্টায় দেশবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণের অভাবে ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ মনোভাব ব্যক্তি না করে পারেননি। তাছাড়া দেশের শাসক ইংরেজরাও নেটিভদের এই প্রচেষ্টায় মাথা ঘামাতেন না, তাঁদের তরফে উৎসাহ বা উপস্থিতি দেখা গেলেও অর্থসাহায্যের সময় তাঁরা খুব বেশি এগিয়ে আসতেন না। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য মহেন্দ্রলালের এই দেশবাসীর প্রতি বিক্ষুব্ধ মনোভাবের কিঞ্চিৎ সমালোচনা করেছিলেন (দ্রষ্টব্য আশীষ লাহিড়ীর ‘মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান’)। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন দেশের মানুষকে আগে বৈজ্ঞানিক বিষয়সমূহের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে হবে, তাঁদের নিজেদের বোঝার মতো ভাষায় বিজ্ঞানের বিষয়কে তুলে ধরতে হবে তাঁদের সামনে, এর জন্য বই বা পত্রপত্রিকা প্রকাশ করতে হবে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। বিজ্ঞানের পরিভাষা তৈরির দিকেও জোর দিয়েছিলেন তিনি। এসব না করে আগেই পাশ্চাত্যের অনুসরণ করে বিজ্ঞানচর্চার জন্য ব্যবস্থা শুরু করে দিলে মানুষের যথেষ্ট অংশগ্রহণ সম্ভব না বলেই ছিল তাঁর বিশ্বাস।
জীবনের একটা বড় অংশ এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় করলেও মহেন্দ্রলালের জীবদ্দশায় ‘আইএসিএস’ তাঁর কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি বলে মহেন্দ্রলাল মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি কি জানতেন, তাঁর মৃত্যুর মাত্র বছর তিনেক পরেই তাঁর স্বপ্ন সার্থক করবার জন্য উপস্থিত হবেন এক ‘দেবদূত’?
খেয়াল রাখা দরকার, যে সময়টায় এইরকম এক প্রতিষ্ঠান তৈরির স্বপ্ন দেখছেন মহেন্দ্রলাল, তখন এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানচর্চা শুরুই হয়নি। পশ্চিমের দেশগুলোয় ততদিনে হইহই করে শুরু হয়ে গিয়েছে তত্ত্বীয় বা প্র্যাকটিক্যাল (যন্ত্রপাতির সাহায্যে হাতেকলমে) বিজ্ঞানচর্চার সু-অভ্যাস। ভারত পড়ে রয়েছে সাহিত্য, শিল্প বা কলাবিভাগের অন্য বিষয়গুলি নিয়েই। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর ‘হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন এ দেশীয়রা কেন মধ্যযুগ থেকেই বিজ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে পড়েছিলেন ওদের দেশের মানুষের চেয়ে।
‘আইএসিএস’ তৈরির বেশ কয়েক দশক আগে রাজা রামমোহন রায়ই প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন বিজ্ঞানশিক্ষার প্রকৃত প্রয়োজনীয়তা। লর্ড আর্মহার্স্টকে লেখা তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানশিক্ষা না হলে দেশের উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার পরে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের কয়েক জায়গায় আস্তে আস্তে গড়ে উঠলেও বিজ্ঞানের পঠনপাঠন প্রথম থেকে মোটেই গুরুত্ব পায়নি। যাঁরা সিরিয়াসলি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইতেন, চলে যেতেন বিদেশে। বিজ্ঞান পড়বার চেয়ে তখন ডাক্তারি বা ওকালতি পড়ার দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। বিশ শতকে এসে অবস্থাটা বদলাতে শুরু করে।
উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁর সময়কালে ‘আইএসিএস’-এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল এই কলকাতায়, যার সম্পূর্ণ উদ্যোগ এককভাবে একজন বাঙালিরই, এর চেয়ে গর্বের আর কী হতে পারে?
...................................................................................................
মুখ্য সূত্র—
১/ বাঙালির বিজ্ঞানভাবনা ও সাধনা- অরূপরতন ভট্টাচার্য। দে’জ।
২/ C. V. Raman/ A Biography- Uma Parameswaran. Penguin Books.