পরিবেশ ও প্রাণচক্র

<strong>তাল উৎসব</strong>

বিবর্তন ভট্টাচার্য Aug 12, 2020 at 9:44 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ট্রেন ধরবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। একজন প্রবীণ মানুষ আমায় প্রশ্ন করলেন, “কোথায় চললে?” বললাম, “তাল উৎসবে, পুরুলিয়ায়।” উনি তো হেসেই খুন। “তাল মানে পাকা তাল? তার উৎসব?” হাসি আর থামে না। আমিও বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। আমি নিজেই তো ভালো করে জানি না তাল উৎসব বিষয়টা কী! রাতের পুরুলিয়া-চক্রধরপুর এক্সপ্রেস ছাড়বে রাত ১১ঃ০৫-এ। এসি থ্রি-টায়ারে আমি আর অভিজিৎ সরকার (ও এই প্রথম এক্সপ্রেস ট্রেনে চাপল)। বাড়ি থেকে নেওয়া লুচি, তরকারি, আচার আর সন্দেশ খেয়ে সাদা চাদর গায়ে দিয়ে ঘুম দিলাম। অভিকে বললাম মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতে। ভোর ৫ঃ২০-তে পুরুলিয়া ঢুকবে ট্রেন। ট্রেন শেষমেশ সকাল ৭ টায় পুরুলিয়া পৌঁছল। স্টেশনেই গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আমাদের হোটেলে নিয়ে যাবার জন্য। তিনজনে মিলে একটু চা খেয়ে রওনা হলাম লেক রোড অর্থাৎ সেই বিখ্যাত সাহেব বাঁধ, যে জলাশয় থেকে পুরুলিয়ার মানুষ জল খান। তার পাশেই আমাদের হোটেল। গেট হয়েছে তাল উৎসবের। তা টপকে আমাদের গাড়ি দাঁড়াল হোটেলের দরজায়। আমাদের ঘর তিনতলায়। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

৩০-৩১ আগস্ট তাল-উৎসব হবে পুরুলিয়া শহরে। আমি ভাবছিলাম পুরুলিয়াতে রাস্তায় তাল পড়ে থাকলেও এখানকার বহু মানুষ তাকায় না, তারপর এই পাণ্ডববর্জিত এলাকায় কী যে উৎসব হবে! আমার ঠিক ভালো ঠেকছিল না। সুজিতদা, সৌম্য, সৌরভ, গায়ত্রীদের জিগ্যেস করলাম, তাল উৎসব কেন? “এটার পিছনে কী উদ্দেশ্য আছে?”

আসলে তাল গাছ প্রায় সম্পূর্ণই মানবকল্যাণে ব্যবহৃত। গাছ, পাতা, তাল সবই কাজের - কিন্তু ওরা মূলত এই দেশীয় ফলের যে প্রাচীন ব্যবহার ছিল তা ফিরে দেখার জন্যই এই উৎসবের আয়োজন করেছে। পাকা তালের প্রচলিত ও নতুন ধরনের খাবারদাবারই মূল ভাবনা।

“আচ্ছা তাল নিয়ে এত মাতামাতি খানিকটা আঁতলামি হচ্ছে না কি?” সৌরভের কাছে প্রশ্ন রাখি। সৌরভ জানায় বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলায় অব্যবহৃত ও অবহেলিত প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জীবন ও জীবিকার উন্নয়নের লক্ষ্যেই এই উৎসব।

কেন খেজুর নয়? সৌরভের উত্তর - “না না, খেজুর নিয়েও আমরা ভাবছি। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে তাল গাছের তলায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর যেহেতু এই ফল সহজলভ্য আর এর বিভিন্নরকম ব্যবহার বিষয়ে মানুষ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নয়, তাই সিংহভাগ তালই গাছের তলায় নষ্ট হয়, বা গবাদি পশুর খাদ্যে পরিণত হয়। কিছু মানুষ তালের মাড়ি, তালের রুটি-লুচি-ফুলুরি তৈরি করে খায়, তালের রস থেকে হাঁড়িয়াও তৈরি হয়। তবে এসব করেও অন্তত ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ তাল পচে নষ্ট হয়। কিন্তু এই পাকা তাল থেকে বহু লোভনীয় খাবার তৈরি করা সম্ভব। কাঁচা তালের শাঁসও দারুণ। এছাড়া তালের তন্তু দিয়ে তৈরি বাবুই পাখির বাসা সারা পৃথিবীর বিস্ময়।

আরেকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য। পুরুলিয়াতে এ বছরই বাজ পড়ে পাঁচজন মারা গেছেন। কথাটা আচমকা অপ্রাসঙ্গিক লাগতে পারে, কিন্তু আসলে ঘোরতর প্রাসঙ্গিক। অনেকেই জানেন না যে তালগাছ বজ্র-নিরোধক। ২০১৯ সালে সারা পশ্চিমবঙ্গে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা প্রায় তিরিশ। তালগাছ কমে আসা এর অন্যতম একটা কারণ। পুরুলিয়ার বহু এলাকায় দেখা যায় তালগাছের মাথাটা পোড়া, কারণ তালগাছের মাথা বজ্রপাতের ধাক্কা সামলে নিয়ে সবাইকে বাঁচায়। আর মানুষ মূর্খের মতো তালগাছ কেটে নিজেরা মাথা পেতে বাজকে গ্রহণ করছে।

শুরু হল তাল উৎসব। প্রথম দিন দুপুর ২ টো থেকে। মানুষের আনাগোনা শুরু হল বিকেল ৪ টে থেকে। চারিদিকে টেবিল সাজিয়ে বড়ো বড়ো ট্রে-তে কোনওটায় তালের ফুলুরি, তালের মালপোয়া, তালের মোমো, তালের পাটিসাপটা, তালের ক্ষীর, কেক, রুটি, লুচি, তালের সেদ্ধ পুলি, তালের পুলি-ফ্রাই, পোড়া পিঠে, তালের রস দিয়ে তৈরি সিরাপ। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত বহু মানুষ উপস্থিত। সব মিলিয়ে যেন এক মহাভোজ, যেমন গ্রামীণ মেলাতে হয়। একেবারে সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ ও আদিবাসী মানুষ এই উদ্যোগ নিয়ে কী ভাবছে, সেটা জানা দরকার; টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। “আরে বাবু বিনা পুঁজির ব্যবসা। ভালোই কামাই। ভালো কাজ করছে D.R.C.S.C.। তাল তো বিনে পয়সায়, শুধু গ্যাস, চিনি আর অল্প একটু তেল। একটা ফুলুরিতে ৫ টাকায় ৪ টাকাই লাভ।”

দেশীয় খাবার খেয়ে মধ্যবিত্তও গদগদ। বিগ বাজারের পাশে বড় বিরিয়ানির দোকানটায় আজ ভিড় কম। দেশীয় উপাদেয় এই খাবার খেয়ে মানুষ অভিভূত। আমাদের অবচেতন জায়গা থেকে কবে যে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল এইসব দেশীয় খাবার, সেটা চিহ্নিত করা মুশকিল। শুধু কি খাবার? ঘড়া, গ্লাস এসবও তো আজ ট্রাঙ্কে। এখন আমরা বোতলেই অভ্যস্থ। জল চাইলে গৃহস্থ বাড়িতে বোতল এগিয়ে দেওয়া হয়। বহুজাতিকের সূক্ষ্ম পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে এমন অনেক খাবার আমাদের খাদ্যতালিকায় ঢুকে পড়েছে এবং জাঁকিয়ে বসে আছে, যা সাহেবরা ফেলে দিয়েছে। আজিনামোতো-যুক্ত চাউমিন, চিলি চিকেন, মেটানিল ইয়েলো (কেশরি রঙ) যুক্ত বিরিয়ানি, বার্গার, প্যাটিস - এইসব বিষ খেয়ে খেয়ে আমরা এখন বিষহরি। দেশীয় খাবার উপস্থাপিত করে বহুজাতিকের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করছে এই তাল উৎসব। আমরা তার সাক্ষী থাকলাম। ফিরে গিয়ে ওই প্রবীণ ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করব, যিনি এই তাল-উৎসবে আসা নিয়ে বিদ্রূপের হাসি হেসেছিলেন।

* D.R.C.S.C - Development Research Communication and Services Centre।

আরও পড়ুন:

উন্নয়ন বনাম পবিত্রতাঃ পিয়ের রাভির অ্যাগ্রো-ইকোলজির দর্শন

#পরিবেশ ও প্রানচক্র #তাল উৎসব #বিবর্তন ভট্টাচার্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

5

Unique Visitors

219107