অবসর, বসন্তসময়
...............
১.
নেহাতই সাদামাটা কেজো সন্ধে। শুরু হয়েছিল লেমন গ্রাসের গন্ধমাখা চা দিয়ে। ভিড় না জমা মেট্রোর পথে ছড়িয়েছিল পাহাড়ি বিকেলের মন্তাজ। একলা সফরের রূপকথা। ক্রমে রিয়েল টাইমে বাঁক নেয় স্বপ্নের গলিঘুঁজি...
২.
কেউ বাড়িতে এলে আগের মতো উৎসবের মরশুম জাগে না। তবু, যে ঘরে ঢুকছে তাকে আপাদমস্তক জীবাণুমুক্ত করার জন্য কেনা হয় নতুন স্যানিটাইজার। কাপড়ের এলো স্তুপ হাতড়ে খোঁজ চলে এমন পোশাকের যা গায়ে বসবে বাধ্য হয়ে। বারকয়েকের ব্যর্থতা পেরিয়ে যে জামাটি উৎরে যায় তার টেক্সচারে শিউলি রঙ। ক্লাস ওয়ানের স্কুল-নাটকে শিউলিফুল সেজেছিলাম - তাকে দেখে সে কথা মনে পড়ে।
৩.
আর্ল গ্রের স্বাদ-গন্ধে জারিয়ে নেওয়া বিশ্রামপর্ব। গোপন ভাণ্ডারের দরজা হাট করে উঁকি দেয় ছেলেবেলার কারুকল্পনা। কাঁচা হাতের কবিতা, আঁকিবুকি, যত্নে রাখা ডায়েরি, মুদ্রার পিঠে রোমাঞ্চকর ইতিহাস। দেখতে দেখতে সন্ধে উজাড়। রাত নামে। ল্যাপটপের স্ক্রিনে প্রিয় ওয়েব সিরিজ। কয়েক ঘন্টায় আমাদের বয়স কমে কয়েক দশক। ভালোবাসার অভিনেতা নিয়ে সোহাগের ভাগবাঁটোয়ারা। সইমহলের গুঞ্জন। শুনতে পেলে কাজললতাটিও লাল। ছিটিয়ে থাকা উচ্ছ্বাস আর শেষ-না-হওয়া গল্পের মাঝখানে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
৪.
বসন্তের সকাল আসে ছুটির খবর নিয়ে। যে ছুটি শান্ত, নরম...আর পিছুটানহীন। নদীর ধারে হাঁটতে বেরোই। অন্যজন দক্ষিণ কলকাতা নিবাসী। উত্তরের সাবেক ছন্দ তাকে মুড়ে নিচ্ছে খুব ধীরে। কয়েক বছর আগে এখানেই বেজেছিল বিসর্জনের বাজনা। সেই স্মৃতি এখনো আলোময়। জেটির গায়ে রোদ্দুর বুঝিয়ে দেয় বেলা হল। নদী পেরোনোর ইচ্ছে জাগত অন্যদিন। বুঝদার হয়েছি বলে আমরা কিন্তু এ পারেই থাকি। বদলে দেখে নিই স্কুল ড্রেসের আপ্রাণ ছুট কীভাবে ধরে নিচ্ছে সময়ের ফেরি। একজনকে ডেকে নেয় পুরোনো পার্কের বেঞ্চ। দোলনা। ছোটবেলার অমোঘ চুয়াচন্দন। আরেকজনের চোখ টানে পোড়ো ইস্কুলবাড়ির ফাঁকা মাঠ আর বুক। উঠে যাওয়া বাংলা মিডিয়াম। দক্ষিণেশ্বর কোনদিকে এমন বেমক্কা তর্কে বাজি ধরে যারা, তারা দুই দিকহারা কিশোরী।
৫.
সকালের মিহি জমিনে রোদ্দুরের সোনালি পাড়, যে মৌতাত কেবল বসন্তই দিতে পারে। আশেপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে ব্যস্ত গলার আওয়াজ, রান্নাঘর থেকে মশলার গন্ধ, কার্নিশ থেকে শালিখ-চিৎকার, পাখিদের ডাকাডাকি...নব্বইয়ের আটপৌরে দিন যেন পথ ভুলে হাজিরা দিয়েছে অবিকল। কতগুলো যুদ্ধ, মৃত্যু আর আগুন পেরিয়েও আমরা আঁচহীন - এমন ভাবতে সাধ যায়। ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে কলেজবেলার প্রাচীন দস্তাবেজ। বসন্ত উৎসবের দিনলিপি। জমিয়ে রাখার নেশা বড়ো নাছোড়। তবু দিন ফুরোলে ছাড়তে হয় সবাইকেই।
৬.
সুন্দরকে দেখলে ব্যথা বাজে কেন - এ নিয়ে শেষবেলায় আলোচনা ঘন হয় আমাদের। আমি বলি কালিদাসের কথা। কোন ফাঁকে দেখি সে গল্পে ঢুকে পড়েছে রাজার বাড়ি। রাজার চিঠিও। চাঁদের পাহাড় ঠিক কতদূর আলভারেজও কি জানে? আমরা উত্তর পাই না, প্রশ্নে প্রশ্নেই বেলা কেটে যায়। ভাসানের পর আগলে রাখতে হয় একত্রযাপনের পল। ফেলে আসা সময়কুচি। আর সন্তর্পণে ভাবতে হয়, অবসরের সংজ্ঞা সম্ভবত এমনটাই!